করোনা: অন্তরীণেই আলোক শিখা
এই লেখা যদি কেউ পড়ে থাকেন, আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি তাদের সকলেই করোনা সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা সকল তথ্যই জানেন। সুতরাং এমন কিছুই লেখার নেই যা আমাদের কারো জানার বাইরে। তবে এটা নিশ্চিত বলতে পারি যে আমাদের সকলেই জানা সত্য মেনে চলছি না। চীনের সফলতার পিছনে নাগরিকদের স্বেচ্ছা গৃহবন্দীত্বের কথা জেনেও ‘কোয়ারান্টাইন’কে উপহাস করি সদম্ভে! আমরা বীরের জাতি সন্দেহাতীত। কিন্তু বীরত্বের সাথে বুদ্ধির মিথষ্ক্রিয়া কতটুকু বজায় আছে তা সন্দেহাতীত নয় কিছুতেই!
৩ শতাংশ মৃত্যুর হার মাথায় নিয়ে অপ্রয়োজনে জনসমাগম করা বুদ্ধি প্রতিবন্ধিরা ক্যালকুলেটার চেপে ১৬ কোটিতে কত লক্ষ দাড়ায় তার হিসেব বের করতে অক্ষম। আমাদের মগজের মালগাড়ী চীন থেকে এখনো ইটালি পৌঁছোতে পারেনি। বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা দেয়ার পরও আমরা অপেক্ষা করি, বিশ্ব পেড়িয়ে এই প্রাণঘাতি ভাইরাস কবে আমাদের কাছে আসবে তার পরে আমরা প্রস্তুতি নেবো। কোন এক সংস্থা দশ হাজার মাস্ক দেয়ার ঘোষণা করবে আর আনন্দে আমরা ফেইসবুক ভাসাবো তাদের উদারতা আর দানের মহত্ব প্রচারে। আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত- দান গ্রহণের জন্য; নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো যায়- কারণ চীন থেকে ডাক্তার আসছে। আমাদের ডাক্তাররা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পোষাক পরে আপতত ভাইরাস পরিষ্কার অব্যাহত রাখুক, আর আমরা ভীড় করে দেখতে থাকি প্রবাসীর কোয়ারেন্টাইন! আমি দুঃখিত, আমি ভালো কিছু ভাবতে পারছি না, ভালো কিছু লিখতে পারছি না।
আমেরিকায় বন্দুক, পিস্তলের বাজারে ব্যাপক সংকট চলছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ পরবর্তী সাম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলতায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে রাখার হিড়িক! জার্মানে টয়লেট পেপার, স্পেনে ওয়াইন সংকট! আর ইটালীতে সংকট ছিলো গুরুত্বের। তাই রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবহেলার প্রতিচ্ছবি এখন দেখতে পাচ্ছে সারা বিশ্ব। এ সব তথ্য ওই সব অঞ্চলে থাকা পরিচিত-আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া। এখানে গুরুত্ব দেয়াটাই উল্লেখ্য! ১৪ দিনের পারিবারিক কোয়ারান্টাইন বা লক ডাউনে যেতে হলে ১৪ দিনের খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে নিতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয়, যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পণ্য পৌঁছে দেয়ার নজির বিরল! যেহেতু খাদ্য গুদাম ভরপুর, ঘাটতি নেই কোন পণ্যের, সেহেতু প্রস্তুতিটা আর একটু আগে নিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর দেশ-ব্যপস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া যেত! আমাদের সুযোগ ছিল হিড়িকে কেনাকাটা এড়াতে- জন প্রতি ১৫ দিনের প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা প্রচার করার। যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা আছে হুজুগে পেঁয়াজ কিনে পঁচানোর, লবণ কিনে হাহাকারের। যেটা পিস্তল, টয়লেট পেপার কিংবা ওয়াইন কেনা জাতির ছিলো না। আমাদের সুযোগ ছিলো দেশের প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ রেখে গুজবের কারখানা উদ্বোধন না করার এবং আমাদের প্রবাসীদের নায়ক থেকে ভিলেন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া প্রতিহত করার।
রাশিয়ায় নাকি সিংহ ছেড়ে দেয়া হয়েছে জনগণকে ভয় দেখিয়ে ঘরে তুলতে- আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছি, আমরা বিশ্বাস করেছি। ভোর রাতে তিনটি থানকুনি পাতা খেলে করনো ভাইরাস সুবিধা করতে পারবে না- আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছি, আমরা বিশ্বাস করেছি। সূর্য দেখে কেয়ামত আর আম গাছের মধুতে মুক্তি- আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছি, আমরা বিশ্বাস করেছি। মানব দেহ থেকে মানব দেহে করোনা ভাইরাস ছড়ায়- আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছি, কিন্তু এবার আর বিশ্বাস করিনি! অন্যান্য গুজবের মতো গুজব ভেবেই যদি আমরা বিশ্বাস করতাম, গভীর রাতে থানকুনি পাতার পিছনে ছুটাছুটি করে আমরা যদি যার যার ঘরে বন্দী হয়ে যেতাম তাহলে কিটো ভাইকে আর ‘শিক্ষিত পাঠা’দের নিয়ে গাইতে হতো না! একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ভাইরাসে... ওহ, বেশির ভাগ অসুস্থ এবং বৃদ্ধ (বয়স ফোকাস করুন)! তাহলে যেন ব্যাপার না কোন। অসুস্থ এবং বয়স্কদের বাঁচতে চাইতে নেই, তারা আমাদের কেউ নন, তারা মানুষ নন। যদিও ইটালীর অভিজ্ঞতা ভিন্ন, হায়রে মগজের মালগাড়ী- এখনো চীনে! সকল বয়সের মানুষই এই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হতে পারে। যারা কম বয়সের, তাদের রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে তারা বাহক হয়ে অন্যদের মাঝে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে কাজ করবে অনায়সেই।
এই মহামারী দুর্যোগে অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবায় অন্যের উপকারে আত্মনিয়োগ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। অনেক সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং প্রতিহত করতে সংঘবদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এসব অবশ্যই আশা জাগানিয়া, তবে আমরা যেন এই সব স্বেচ্ছাসেবীদের প্রয়োজনীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রাখি সর্বাগ্রে। বিভিন্ন ধরণের পোষাকের নিরাপত্তা বিধান করেও উন্নত দেশের ডাক্তার, সেবিকারা আক্রান্ত হচ্ছে তা আমাদের বিবেচনায় আছে নিশ্চয়ই। আমরা যেন আমাদের সাহসী দেশপ্রেমিক স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের মানব বোমায় রূপান্তরিত না করে ফেলি। এসব বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করে যারা কাজ করবেন তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত মানুষেকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করা এবং একমাত্র এটা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই অন্যান্য প্রয়োজন কমিয়ে আনা সম্ভব। এই মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবার সবচেয়ে বেশি কার্যকর একটি পদ্ধতি আছে যা আমরা সকলেই করতে পারি। সেটি হচ্ছে যে কোন ভাবে নিজেকে ঘরে আটকে রাখা এবং অন্য কারো সাথে স্বশরীরে যোগাযোগ বন্ধ করা। যে কোনভাবে আমি যদি নূন্যতম ২০ জন মানুষের মাঝে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেই, সেই ২০ জন প্রত্যেকে পরবর্তীতে আরও ২০ জন করে মানুষের মাঝে ছড়াবে ভাইরাসটি। যার ফলাফল স্বরূপ সর্বমোট ৪২০ জন সংক্রমিত হবে। এই ৪২০ জন প্রত্যেকে আরও ২০ জন করে মানুষকে সংক্রমণের শিকার করবে। যার ফলে সর্বমোট ৮৪২০ জন সংক্রমিত হবে। এভাবে চলতেই থাকবে। সুতরাং, আমি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্যকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে পারি, তাহলে আমি সামগ্রিক ভাবে হাজার হাজার মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব পালন করলাম।
সূরা বাক্বারা-এর ১৯৫ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে, বাহনে, প্রচন্ড বৃষ্টি ও তীব্র ঠান্ডার সময় ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন। প্রবল বৃষ্টির দিনে রঈসুল মুফাসসিরীন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা: তার মুআযযিনকে নির্দেশ দিয়েছেন- আযানে বলতে ‘তোমরা মসজিদে না এসে ঘরে নামায আদায় করে নাও’। একালের ন্যায় সেকালেও কিছু মানুষ ইবনে আব্বাস রা: এর এই আদেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাদের বলেছিলেন, আমার চেয়ে যিনি সেরা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর অনুমতি দিয়েছেন। প্রবল বৃষ্টি বা প্রচ- ঠা-ার তুলনায় করোনা ভাইরাস অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। অনেক বেশি প্রাণঘাতী। সুতরাং জামায়াতে নামায এই বৈশ্বিক মহামারীতে অত্যাবশ্যকীয় নয়, ধর্মীয় আলেমগণ হয়তো এ বিষয়ে ভালোভাবে জানাতে ভূমিকা রাখবেন।
সব দিক বিবেচনায় সরকারি ঘোষণা, বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দিকেই তাকিয়ে না থেকে নিজেদেরই সামাজিক দূরত্ববলয় তৈরী করা উচিত। এই ভয়াবহতার কবল থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে নিজেদের অন্তরীণ অবস্থান সুনিশ্চিত করে মুক্তির আলোক শিখার সন্ধান করতে হবে। অনুগ্রহ করুন, বিশ্বাস করুন- ব্যক্তির অন্তরীণেই রয়েছে মুক্তির আলোকশিখা। আল্লাহ আমাদের সকলের উপর সহায় হোন।