প্রসঙ্গ: বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

প্রসঙ্গ: বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

 

একদিন দুইদিন নয়, তিনশত পঁয়ষট্টি দিনে এক বছর। এবং আমি নিশ্চিত এটি সঠিক। এক এক ধরণের ব্যাতিক্রমী গোনা বাছার জন্য মাঝে মাঝে এক দুইদিন মনে হয় যেন একটু এদিক সেদিক। তবে মূল বিষয়টি একই, যথার্থ এবং কঠিনভাবে সঠিক। এমন একটি সহজ কথা মেনে নিলে বিষয়টি অনেক সহজ। তা না হলেই লোকনাথ কিংবা মোহাম্মদি পঞ্জিকার একটি পাতা আমাদেরকে জটিল অংকে ফেলে দিতে পারে। হয়, এমনটা হয়। হঠাৎ করেই নিশ্চিন্তে নীরব ধারাবাহিকতা থমকে দাঁড়ায়। আর ধারাবাহিকতা যখন পথ দাঁড়ায় তখন তাকে পুন: সঠিক পথ দেখানোর প্রয়োজনে, সহজ পথ অতিক্রম করে ধারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়।
এর রূপকল্প আমাদের বায়ান্ন, এর রূপকল্প আমাদের একাত্তর। নিশ্চিতভাবে সে আমরা সবাই জানি। আমরা জানি আমাদের মুখের ভাষার অর্জনের গতিপথ সহজ ছিল না মোটেই। সে অর্জিত হয়েছিল ছালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের রক্তে রঙিন রাজপথেই। আর একাত্তরের স্বাধীনতা? সেতো রক্ত সাগর পথে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রয়োজন ছিল নেতৃত্বের। বাঙালি পাশে দাঁড়িয়ে পথ দেখিয়ে সে প্রয়োজন মিটিয়েছে বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরবর্তীতে দুএকজন বেঈমান বাদে মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্ব।

আমরা জানি বুঝি মানিও এ কথা কিন্তু বোঝাতে পারছি না। যে কারণে নিজের শহরে দুই নিশ্চিত প্রাসঙ্গিকতার বিভ্রান্তিকর বিনাশ প্রায় নিশ্চিতের পথে। একটি অত্যন্ত পুরাতন নাট্য সংগঠন পঞ্চসিড়িঁর অফিস ও মহলা ঘরটি ভেঙ্গে নাই করে তাদের পথে নামিয়ে দেওয়া। যে কারণে তাদের চল্লিশ বছর পূর্তির কেকটি তারা কাটলো খোলা আকাশের নীচে। অন্তত পত্রিকায় ছাপানো উপস্থিত সমন্বয় পরিষদ নেতৃত্বের ছবি এবং খবর তাই বলেছে। আর দ্বিতীয়টি বড়ই অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর। বিষয়টি লিখতে বসেই ভাবতে বাধ্য হতে হলো, যেন কোথাও আইন বিরুদ্ধ কিছু লেখা না হয়ে যায়, যেন সাংস্কৃতির কর্ম নেতৃত্ব কোন কারণে ছোট না হয়ে পরে। যেন রাজনীতির বুঝটা এই কারণে একটু খেলো হয়ে পড়লো তেমনটা প্রকাশ না হয়।

বিষয়টি এই শহর স্ববিস্ময়ে লক্ষ করছে যে, বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর সংস্কার, সৌন্দর্য বর্ধন, সংরক্ষণ এবং একই সাথে স্থান সম্প্রসারণের সাথে সাথে অদ্ভুতভাবে প্রাঙ্গন সংকোচনের কাজ চলছে। নিশ্চয়ই বিষয়টি শহীদ মিনার সংরক্ষণ কমিটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদকে অবহিত করে এবং মতামতের ভিত্তিতেই শুরু করেছে এই কাজটি! অন্তত আমরা সেটা বিশ্বাস করি। কারণ তারা এই শহরের একটি সমাজ সচেতন দায়বদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। নি:সন্দেহে এই কাজের উৎকর্ষ সৈান্দর্য্য আমাদের বিমোহিত করবেই সন্দেহ নাই। যা কোন দিনই ছিলো না এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে তার অনেক কিছুই হয়তো হবে। সে হোক, আমরা তা চাই। তাই বলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গন সংকুচিত হবে কেন এক ইঞ্চিও? কেন শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তাটি ভিন্ন করতে হবে একটি প্রাচীর তুলে? যে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন পিতা জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান? আজ এতোদিন পরে কার নিরাপত্তার দায় কে গ্রহণ করলো, কারা কোন বুদ্ধির টানে এমনটা করিয়ে নেবার সুযোগটা গ্রহণ করতে পারলো? সাংস্কৃতিক কর্মীরা আমরা কেন বিষয়টি বুঝতে এবং বোঝাতে ব্যর্থ হলাম? সাংস্কৃতিক কর্মীরা কোথায় কবে কার নিরাপত্তা বিঘিœত করেছে? হ্যাঁ, করেছে এবং করছে এখনো এ দেশের সাম্প্রদায়িকতা বিনষ্ট কারীদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে।

বছরের তিনশত পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে মাত্র তো কটা দিন, তাওতো সন্ধ্যার পর। কেবল স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস। জাতীয় জীবনের এই কটাদিন সাধারণের উপস্থিতির সঙ্গে থাকতে না পারি তাকে পথের এবং দৃষ্টির বাইরে রাখতে হবে? তাও আমাদেরই নির্বোধ সহযোগিতায়? ছিছি ছি! এতো চুপ থাকার দায় কে নেবে? কেন বলবো না এই কটা দিনের জন্য একটা গেট থাকুক সার্কিট হাউসের সাথে যেটা অনুষ্ঠান চলাকালীন তারা ব্যবহার করবে। এই সহজ সমাধান না করে এ ভাবে ব্যক্তি প্রয়োজন মিটানোর জন্য সমষ্টি সুন্দরের আর ধরাবাহিক ঐতিহ্যের বিনাশ চাইবো?

তা হলে এই যে ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে এই শহরের স্বাধীনতা পরবর্তী সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনীতির ধারাবাহিক কর্মকা-ের যে ব্যাত্যয়, তাকে নিয়ে কিছু বলবো কিভাবে? ধরে নেই এই যে পঞ্চসিঁড়ি নাট্য সংগঠনটি, তারা ঐ যায়গায় অত্যন্ত অন্যায়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এতোদিন। এই কারণে সেখান থেকে তদেরকে একেবারেই দায়হীন নামিয়ে দিতে হবে, এবং সেটা এখনই? এটি যে ব্যক্তিগত কোন বিষয় নয় সেটিতো আমলে নিতে হবে? কিভাবে এমন একটি বিষয় একতরফা হতে পারে? এই দেশে এই মুহূর্তে যে রাজনীতি চলমান, সেই রাজনীতির এই শহর কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক পঞ্চসিঁড়িরও সম্পাদক! তার জেলা সম্পাদক বরিশাল সাংস্কৃতিক সংঘঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি! এই শহরের মাননীয় মেয়র যার আদেশ নির্দেশ অনুরোধ অনুমতি বেতিরেকে সাংস্কৃতিক কর্মীদের কোন সুর সঞ্চারিত হয় না। যখন এই শহরের প্রতিটি আইন নিয়ন্ত্রক চেয়ারগুলো সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। তখন কি করে পঞ্চসিঁড়ি থিয়েটার হয়ে পড়লো কার্যালয়হীন? এতো কিছুর পরেও যদি তাই হবে তাহলে আসুন রাস্তায় দাড়াঁই। যা আইন নয় রাস্তাই পারে তাকে আইনে রুপান্তরিত করতে। নিশ্চয়ই মনে আছে কিভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে জিলা পরিষদ পুকুর রক্ষা করা হয়েছিলো? কিভাবে থামানো হয়েছিলো বধ্য ভূমিতে নির্মিত সাইলো কার্যক্রম? সাংস্কৃতিক কর্মীরা যে প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে জানে। তেমন সত্য বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না? সবকিছু অনুমতি নিয়েই করতে হবে? প্রতিবাদের অনুমতি কে দেয়?

বর্তমান সংস্কৃতি বান্ধব প্রশাসনের সুযোগ ছিলো, আছে এখনো পঞ্চসিঁড়ির ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু সমাধান দেবার। আমাদেরও ভেবে দেখবার সুযোগ আছে। সেটা হলো, আমরা কি করছি? আমাদের কি উচিৎ নয় অতীতের অনেক অসামঞ্জস্য কাজের বিরোধিতার মতো করে একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর? তাকে সাহস করে প্রতিবাদ না বলি। মুখ কালো করে দু:খ যে পেয়েছি তাতো বলা যায়? সাঁইত্রিশটি সংগঠনের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ফোরাম সমন্বয় পরিষদ। তার শক্তির সমন্বিত প্রয়াসের  উন্মোচন প্রয়োজন। প্রয়োজনে হাত বাড়াতে হবে বাংলাদেশ ব্যাপী যে সাংস্কৃতিক ফোরাম সেই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দিকে। যার সদস্য বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। চাই না কারো নিরাপত্তার নামে শহীদ বেদীর সীমানা সংকোচন। চাই না সহযাত্রী পঞ্চসিঁড়ি নাট্য সংগঠনটি ঠিকানা বিহীন হয়ে পড়–ক। এক মুহূর্তের জন্যও চাই না সংস্কারের নামে বঙ্গবন্ধু কতৃক স্থাপিত ভিত্তি প্রস্তরটি ভেঙ্গে নূতন কিছু লাগানো হোক। জানি অর্থহীন এই অতি প্রাসঙ্গিক প্রত্যাশা। তবে কান পেতে শুনুন। মানুষ অনেক কথা বলছে, অনেক প্রশ্ন আছে তাদের। তারা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের সীমাহীন দুর্বুদ্ধির স্থবির পথ। যে পথে টাকার সাথে আমরা লুটোপুটি খেতে একেবারেই বাধ্য হচ্ছি।

লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর  সদস্য।।