হাজী মোহাম্মদ মহসিন ও মার্কেটের নাম পরিবর্তন

হাজী মোহাম্মদ মহসিন ও মার্কেটের নাম পরিবর্তন

বদলে যাচ্ছে দিন, বদলাচ্ছে মানুষের চাওয়া পাওয়া। বদলে যাচ্ছে হারানো ঐতিহ্য। এই বদলের খেলায় সবাই নিজেকে বদলাতে মরিয়া। তবে সেই বদল কেবল আত্মতুষ্টি আর নিজেকের জাহির করার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির খেলায় চন্দ্রিমা উদ্যান হয়ে যায় জিয়া উদ্যান। আবার তাঁর নামের বদলে অন্যের নাম। একটি স্থাপনার নাম উল্লেখ করলেও এরকম অসংখ্য নামাকরণের ইতিহাস রয়েছে। সেসব বলতে গেলে আজকে বিষয় হারিয়ে যাবে। মূলত নামকরণের এই খেলায় খেলোয়াড় তারাই। যারা রাজনীতির ময়দান কাঁপিয়ে দায়িত্বের পরিবর্তে ক্ষমতায় বসেন। একটা নাটকের সংলাপ আছে এরকম ‘খেলে যাও খেলারাম’। এতো এতো খেলা যখন চলে, তখন কে না খেলতে চায়। ফাঁকা মাঠে গোল কে না দিতে চায়। রাজনীতি যখন নাম বদলের খেলা করতে পারে, তাহলে প্রশাসন কেন পারবে না। তারা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির চালিকা শক্তি। তাই তারাও শুরু করেছেন নাম বদলের খেলা। নিজেরা সভা-সমাবেশে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বাস্তবে তারা প্রজা শোষণকারী জমিদারে রূপ নিচ্ছেন। সরকারের সম্পত্তি যেন তাদের সম্পত্তি বনে যায়। ক্ষমতার দাপটে তারা ভুলে যান, সম্পত্তি তার নয়। তিনি বা তারা কেবল এর রক্ষক মাত্র। নাম বদলের খেলার অংশ হিসেবে এবার বরিশালের ঐতিহ্যবাহী হাজী মুহম্মদ মহসিন মার্কেটের নাম পরিবর্তন করে ডিসি মার্কেট নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো এই নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বরিশালে কেউ কথা বলছেন না। বলবেন কেন? যারা কথা বলবেন তারা তো... । অমুকের আতিথেয়তা নিয়ে কি বিরোধিতা করা সম্ভব। তাই তারা সব দেখেও চুপটি মেরে আছেন। তবে যদি একবার বুঝতে পারেন পালে নতুন হাওয়া লাগার সম্ভাবনা আছে, তাহলে কনুইয়ের গুতায় অন্যদের পিছে ফেলে সামনে গিয়ে হাজী মোহাম্মদ মুহসীনের চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস শুনিয়ে দেবেন। মনে হবে হাজী মোহাম্মদ মহসীন তাদের বাড়ির পাশেই ছিলেন। এমন ইতিহাস শুনে কারো ভুলও হয়ে যেতে পারে। থাক সেসব কথা।

হাজী মোহাম্মদ মহসীন কে সেটার সন্ধান করি। একই সঙ্গে বরিশালে হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেট কিভাবে হলো সেই ইতিহাসের পাতা উল্টানোর চেষ্টা করি। দুই ইতিহাসই অনেকের জানা। আমি এর অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

দানবীর, সমাজসেবক হাজী মোহাম্মদ মোহসীন ১৭৩২ সালে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বাংলার হুগলীতে এক ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী ফাইজুল্লাহ এবং মাতার নাম জয়নাব খানম। এটি ছিলো জয়নব খানমের দ্বিতীয় বিবাহ। তার প্রথম স্বামী আগা মোতাহার বিশাল ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন। যার মালিক হন তার একমাত্র কন্যা মন্নুজান খানম। মন্নুজান ও মোহসীন পারিবারিকভাবে কোরআন, হাদিস সম্পর্কে বিষদ জ্ঞান লাভ করেন। এক পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য মহসীন মুর্শিদাবাদ গমন করেন। মোহসীনের পিতার মৃত্যু হলে তিনি তার সৎবোন মন্নুজান-এর আশ্রয়ে ও ¯েœহে বড় হন। ১৭৬৭ সালে মন্নুজানের বিয়ে হলে মোহসীন একা হয়ে যান। এই সময় তিনি দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ইউরোপ আমেরিকাসহ আরব দেশের বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। আরব দেশের মক্কা-মদিনা ভ্রমণের পর তিনি হজ¦ব্রত পালন করেন। হজ¦ পালনের পর তিনি হাজী মোহাম্মদ মোহসীন নামে পরিচিতি লাভ করেন। হাজী মোহাম্মদ মোহসীনের মাতা জয়নব খানমের প্রথম স্বামী আগা মোতাহার হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়াতে বিশাল স্থাবর ও অস্থাবর ধনসম্পত্তি রেখে যান। যার মালিক হন মুন্নুজান ও মহসীন। সৎ বোন মন্নুজান বিধবা হন। ১৮০৩ সালে সৎ বোন মন্নুজান মারা যান। বোন মারা যাওয়ার পর বোনের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও হন মহসীন। এতো এতো সম্পত্তির মালিকানা হয়েও তিনি খুব সহজ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন। তিনি তার অর্থ দিয়ে যথাযথ শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা এবং দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য অকাতরে ব্যয় করেছেন। তার আর্থিক সহয়তায় ইমামবারা, মহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। এখনও হুগলিতে মহসীন ফান্ড আছে। সেখান থেকে ছাত্রছাত্রীরা সাহায্য পেয়ে থাকনে। হাজি মুহাম্মদ মহসীন বাংলার একজন দানবীর হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মানুষের কল্যাণে বহু কাজ করেছেন। তাঁর নামে দেশে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। খুলনার হাজী মহসীন কলেজও ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজি মুহাম্মাদ মহসীনের নামে ছাত্রাবাস আছে।

এবার আসা যাক বরিশালের হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেট প্রসঙ্গে। বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দারা তো জানেন-ই। যারা ৮০-এর দশকে বরিশালে এসেছেন তারাও জানেন, বরিশালের বিবির পুকুরের পূর্ব পাড়ে টেলিফোন অফিসের পেছনে এবং ঐতিহ্যবাহী ঘরবরণ মিষ্টির দোকান, জেলা আইনজীবী সমিতির মাঝখানের জায়গাটিতে হাজী মোহাম্মদ মহসী হকার্স মার্কেট নামে বড় সাইনবোর্ড ছিল। যতোদূর জানা যায়, টেলিফোন অফিসের জায়গাটি প্রয়োজন হওয়ায় সেখান থেকে হকার্স মার্কেটটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথম দিকে জেলা পরিষদ পুকুর পাড়ে বর্তমান সিটি করপোরেশনের পূর্বদিকে এবং পেছনের দিকে টংঘর করে ব্যবসায়ীরা হাজী মোহাম্মদ মহসী হকার্স মার্কেট পরিচালিত হতে থাকে। জায়গা সংকট থাকায় এক পর্যায় বড় পরিসরে মার্কেটটিকে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। বরিশালের প্রধান ডাক ঘর এবং নৌবন্দর এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। মার্কেটের নানা সুবিধাসহ ১৯৮৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তখনকার জেলা প্রশাসক এম এ বারী আনুষ্ঠানিকভাবে হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেট উদ্বোধন করেন। সেই থেকে এখানেই হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। টি এ- টি এলাকা থেকে শুরু করলে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস। আর বর্তমান স্থানেও ৪০ বছর। এটা এখন বরিশালের অনন্য ঐতিহ্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটও একটা ইতিহাস। সেই ইতিহাস হঠাৎ করে বদলানো যায়? নাম পরিবর্তন করে কি ইতিহাস মুছে ফেলা যায়? 

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় গত বুধবার দুপুরে হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটের ৫টি সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলে সেখানে ডিসি মার্কেট নামে নতুন সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানতে চাইলে এবং নাম পরিবর্তন না করার অনুরোধ জানালে তাদের হুমকী দেওয়া হয়েছে এমনও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তাদের কোন কিছু জানানো হয়নি। হঠাৎ করেই সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইনবোর্ডগুলো নামিয়ে নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন। এমন কাজে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। জীবনের শেষ পর্যায় এসে মার্কেটের নাম পরিবর্তন দেখে হতাশ হয়েছেন অনেকে। সরকারি সম্পত্তিতে মার্কেট হলেও তারা যথাযথ নিয়মে ভাড়া সহ অন্যান্য খরচ বহন করছেন। তাদের দাবি যদি নতুন নামে কিছু করতে হয় তাহলে অন্য কোন স্থানে করা হোক। এটা যেন হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেট নামেই থাকে।

প্রশাসন বলছে, হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটের সম্পত্তি এক নম্বর খাস খতিয়ানে। সেই কারণেই এই সম্পত্তি জেলা প্রশাসনের। প্রশাসনের এমন যুক্তি কেউ অস্বীকার করছে না। বরিশাল শহর ছাড়াও সারা দেশে হাজার হাজার একর সরকারি খাস সম্পত্তি রয়েছে। সরকারের সম্পত্তিতেই তো নজসাধারণের জন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে আসছে। এই হকার্স মার্কেট ছাড়াও বরিশালে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যার সম্পত্তি সরকারের। এখন প্রশ্ন উঠছে তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ডিসি নামে করা হবে? যদি হয় আপত্তি নাই। একটি উদাহারণ দেয়া যেতে পারে, আমাদের জেলা শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ হয়েছে সরকারি জায়গায়। এখন কি শিল্পকলা একাডেমির পরিবর্তে ডিসি একাডেমি হবে? খুলনার মহসিন কলেজের জায়গা সরকারের তাই সেটাও পরিবর্তন করে ডিসি কলেজ হবে? আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল পরিবর্তন করে কি ভিসি হল হবে? যেহেতু ওই জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, প্রকারন্তরে সরকারি।

আমরা বলতে চাই, যুক্তি তর্কে গেলে অনেক যুক্তি দেয়া যাবে। সেসব যুক্তি দেখানো কতটা যৌক্তিক হবে জানি না। হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটের নাম পরিবর্তন না করে নতুন কোন একটি আধুনিক মার্কেট নির্মাণ করার উদ্যোগ নিন। বরিশালে সরকারি অনেক জমি পড়ে আছে, সেখানে নতুন করে একটি মার্কেট নির্মাণ হলে নাগরিক সুবিধাও বাড়বে আবার নতুন নামে নামকরণ করা সম্ভব হবে।