‘জাগো, জাগো বরিশাল, তোমার সমুখে আজি পরীক্ষা বিশাল’
‘জাগো, জাগো বরিশাল, তোমার সমুখে আজি পরীক্ষা বিশাল’। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস অশ্বিনী কুমার দত্তকে খুবই স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। দেশবন্ধু অশ্বিনী দত্তকে বলেছিলেন ‘যদি নাম করতে চাও তাহলে কোলকাতায় থাকো, আর যদি কাজ করতে চাও তাহলে তুমি তোমার বরিশালে ফিরে যাও’। নাম নয়, কাজ করবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশাল ফিরে এসেছিলেন। বরিশাল চলে আসার পর পিতা ব্রজমোহন দত্ত তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘এতো এতো পড়াশুনা করে তুমি কোলকাতা ছেড়ে বরিশাল চলে এলে কেন’?
অশ্বিনী কুমার দত্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন ‘বাবা আমি যেটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছি সেটা আমি আমার দেশের জন্য, আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়ন এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য কাজে লাগাতে চাই’।
পুত্রের এমন অবাক করা দৃঢ় সংকল্পতায় গর্বিত পিতা ব্রজমোহন দত্তের পিতৃত্ব সেদিন সার্থক হয়ছিলো নিশ্চয়ই, চোখের কোনে জমে ওঠা চিকচিক করা আবেগের জলে। পুত্র অশ্বিনী কুমার দত্তের সংকল্পে সেদিন গর্বিত কণ্ঠে পিতা পুত্রকে বলেছিলেন ‘অশ্বিনী তোমার সংকল্পে তুমি সফল হলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো, গর্বিত হবো’।
পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা ছেড়ে অশ্বিনী কুমার যখন বরিশালে এসে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করলেন, বরিশালের আর্থ সামাজিক অবস্থা তখন চরম অনাচার আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন।
শোনা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিলো মদ, গাজা আর আফিমের দোকান। ওই সকল সামাজিক অনিয়ম আর অনাচারে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত অশ্বিনী বাবু একাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছিলেন। সেসব থেকে শুরু করে বরিশালের সামাজিক সংস্কার, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সকল ধরণের সংস্কার আর উন্নয়নমূলক কাজে অশ্বিনী বাবু ও তাঁর পরিবারের অনস্বীকার্য অবদানের গীত নতুন করে গাইবার কিছু নেই।
এ ছাড়াও সমগ্র পৃথিবীতে আলোচিত এবং একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু যাত্রাভিনয়, গান রচনা ও গান গেয়ে ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, নির্যাতন এবং মানুষকে জাগ্রত করবার অপরাধে গণমানুষের শিল্পী বরিশালের আরেক সুসন্তান চারণসম্রাট মুকুন্দ দাশ। তাঁকে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ছয় মাস জেল দিয়ে তিনশত টাকা জরিমানা করে। একই সঙ্গে গান গেয়ে পাওয়া মুকুন্দ দাশের সোনার মেডেলগুলো জব্দ করে নিলামে তুলে বিক্রি করে জরিমানার টাকা আদায় করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। সেই মুকুন্দ দাশকেও স্বদেশী বিপ্লবী হয়ে ওঠার দীক্ষাগুরু অশ্বনী কুমার দত্ত। সেই মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের পুণ্যভূমি বরিশালে তাঁর পৈত্রিক ভিটেতে তাঁরই নামে একটি কলেজের নামে নামকরণ করে বরিশালবাসী ঋণ শোধ নয়, শুধু মাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা নূন্যতম সুযোগ পাবে। সেই সুযোগের বিরোধিতায় নামার মত স্বজাত শত্রু বরিশাল ভূমিতে একজনও থাকা উচিৎ নয়। কিন্তু জাতিগত দুর্ভাগ্য বলে একটা বিষয় তো ছিলো, আছে, থাকবেও হয়ত।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও যেমন এদেশে এবং বরিশালেও রাজাকার, আল-বদরের অভাব হয়নি, তেমনি ক্ষমতার মধুর হাঁড়ির মাচার নিচে দুর্নীতিবাজ, ক্যাসিনোবাজ, সাহেদ-সাবরিনাদের বেশে ঘাপটি মেরে থাকা সরকারি দলের কতিপয় অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যে ‘বরিশাল কলেজ’ এর নাম ‘সরকারি বরিশাল অশ্বিনী কুমার দত্ত কলেজ’ নামকরণের বিরোধিতার অশুভ খেলায় মেতেছে সে কথা সচেতন বরিশালবাসী ইতোমধ্যে জেনেছে।
এবং এও জেনেছে যে এদের আলোচিত বিষয়টিকে বরিশালের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সুশীল সমাজের একটি অংশ কেউ কেউ সরকারি দলের মধুলোভী হয়ে আবার কেউ কেউ ক্ষমতাধরদের দাপটের ভয়ে ভীত থাকায় তাদের কাছে প্রত্যাশিত ভূমিকাটি নেবার পরিবর্তে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এই সার্বিক পরিস্থিতিতে নেপথ্যে থেকে বগল বাজাচ্ছে বরিশালের বিএনপি-জামাত সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা। তাই সচেতন বরিশালবাসী এবং বরিশালের মানুষ ঢাকাসহ সারাদেশে এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে থাকা সবাই এ বার্তাটি ইতোমধ্যে পেয়েছেন যে, মেয়র সাহেব নাকি চাইলেই এই সমস্যার সমাধান এক নিমিষেই করতে পারেন। কারণ এই নামকরণের বিরোধিতায় যারা সক্রিয় তারা মেয়র সাহেবের আশীর্বাদপুষ্ট।
কমরেড নলিনী দাশ, মুকুল সেন, মনোরমা বসু মাসিমার বরিশালে কবি কামিনী রায়, কবি জীবনানন্দ দাশ, একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবুল হাসান, গোলাম মুস্তাফা, কবি আসাদ চৌধুরীর বরিশালে, বীরশ্রেষ্ঠ শত শহীদ আর আলতাফ মাহমুদের বরিশালে যুগে যুগে শত সহস্র সৃজনশীল ও বীর সন্তান প্রসবিনী কীর্তনখোলা বিধৌত বরিশালের পূণ্য ভূমিতে পিশাচিনীর সঙ্গে মধুলোভীরা নাচতেই পারে কিন্তু ‘ভয় কী মরণে’ গেয়ে যারা আলোচিত দাবিতে অটল থাকবে, জয় তাদের সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখক: অনন্ত হিরা, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা