অন্ধকার গলিতে উপেক্ষিত শিশু অধিকার

সমাজের অনেকে আছেন যারা পতিতা পল্লির শিশুদের নিয়ে নানা রকমের মন্তব্য করেন। এই শিশুরা সমাজ থেকে আলাদা। অবহেলায় এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এই শিশুরা মূলধারায় ফিরতে পারে না। সমাজ থেকে আলাদা করে দেওয়ায় এরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। এরা আর কোনদিন সেখান থেকে উঠে আসতে পারে না। ফলে অপরাধ জগতে পা দিয়ে এরা হারিয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় ফুটন্ত ফুলের মতো জীবন।
সমাজের কিছু ভদ্রবেশী অভদ্র মানুষের অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত কিছু সময়ের ভালোবাসার ফল পতিতা পল্লীর যৌন কর্মীদের নিস্পাপ শিশুরা। আর এই শিশুদেরকে আমাদের দেশ নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও সমাজের মানুষ তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না। সেই কারণে আমরা যখন দেখছি স্কুলে পড়ার স্বপ্ন তখন তারা দেখে অন্ধকার গলির কুকর্ম। সরকারি অনুমোদনহীন বাগেরহাট শহরের যৌনপল্লীতে রয়েছে এরকম ৪০ জন যৌনকর্মী। এর সঙ্গে আছে যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া আরও ৪৪ সন্তান, যার মধ্য ২৪ জন ছেলে এবং ২১ জন মেয়ে। যারা অন্ধকার গলির মধ্যেই বেড়ে উঠছে।
বর্তমানে খদ্দের কম হওয়ায়, আয় কমে গেছে। সে জন্য যৌনকর্মীদের পাশাপাশি, সন্তানরাও ঠিকমত খেতেপড়তে পারছে না। যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা শিশুরা বাইরে বের হতে পারে না। কারণ তার মা যৌনকর্মী এবং সে যৌনকর্মীর সন্তান। যৌন পল্লীর নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে বের হলে পরিচয় দিতে হয় অন্য কারো।
শিশু অধিকার সনদের চারটি মূলনীতির একটি হচ্ছে বৈষম্যহীন। এতে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ,ভাষা, বিকলঙ্গতা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্যান্য মতামত, জাতীয় সামাজিক বা নৃতাত্ত্বিক এবং সম্পত্তি, জন্ম বা অন্যান্য অবস্থান যাই হোক না কেন সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এর অর্থ হল সকল শিশুর, সকল পরিস্থিতিতে, সবসময়ে, সবখানে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের অধিকার রয়েছে। যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া এই শিশুরা সত্যিকার অর্থে সবখানে কতটুকু পরিপূর্ণ অধিকার কিংবা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। নাকি পরিপূর্ণ বিকাশের অভাবেই স্বপ্নসারথিদের আলোগুলো নিভে যাবে। নাকি হয়ে উঠবে আগামী দিনের ওই অন্ধকার জগতের যৌনপল্লীর যৌনকর্মী।
বাগেরহাট শহরে অবস্থিত যৌনপল্লীর সদ্দার করিমা বেগম (সত্যিকার নাম অন্য) বলেন ‘আমরা আসলে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পাই না। গর্ভবতী হলে সরকার থেকে কার্ড করে দেয়। আর আমাদের পতিতাপল্লীর শিশুরা বাইরে যেতে পারে না। গেলে তাদেরকে ছোট করে দেখা হয়। স্কুলে ভর্তি করতে হয় পরিচয় গোপন করে। অন্যকে অভিভাবক বানিয়ে আমরা স্কুলে ভর্তি করি। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে যন্ত্রণা। যার পরিচয় দেওয়া হয় তাকে নিয়ম করে মাসোহারা দিতে হয়। আমাদের পল্লীর ভিতর এনজিওর স্কুল থাকলেও তারা ঠিক মত পড়ালেখা করায় না। চিকিৎসা সহ দাফন কাফন করতে গেলে পরিচয় গোপন রেখে করতে হয়। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা সরকারের কাছে সকল অধিকার চাই’
পতিতাপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক শিশু জানায়, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। কিন্তু টাকার অভাবে লেখাপড়া এখন বন্ধ। আমরা এই অন্ধকার গলি ছেড়ে ভালো কিছু করতে চাই। আমাদের জন্ম পতিতাপল্লীতে, এই তথ্য কখন বাইরে বললে মানুষ মিশতে চায় না, গালাগাল দেয়। তাই পরিচয় গোপন করে রাখি। আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার চাই।’
পতিতাপল্লীতে জন্ম নেওয়া আরেক শিশু বলে, ‘আমি জাহানাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। টাকার অভাবে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী চাকুরীজীবি হয়, আমরা এগুলো হওয়ার স্বপ্ন কখনো দেখি না। কারণ আমাদের জন্ম যে এই পল্লীর ভিতরে। আমি আমার মায়ের পেশা গ্রহণ করতে চাই না। আমি চাই, এই অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে এমন কিছু করতে, যাতে আমার মা এবং বোনকে নিয়ে ঠিকমত দুমুঠো ভাত খেতে পারি।’
পতিতা পল্লীর একজন জানায়, এখন আর আমাদের কাস্টমার খুব কম আসে না। প্রতিদিন আমরা গড়ে ২০০-৫০০ টাকা আয় করি। আবার ঘর ভাড়া দেওয়া লাগে ১৫০ টাকা। নিজের খাওয়া দাওয়া দিয়ে কিছুই থাকে না। আমার মেয়ে দুইজন লেখা পড়া করতো, কিন্তু নিজের পেটের ভাতই ঠিক মত হয় না লেখাপড়া খরচ চালাবো কেমনে।
এই যৌনপল্লীর আরেক যৌনকর্মী এবং দুই শিশুর মা বলেন, ‘আমি নির্যাতনের শিকার হয়ে এখানে এসেছি। এখন আমি অন্ধকার গলির বাসিন্দা। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা যেন এ পেশায় না আসে। তাই আমরা আমাদের সন্তানসন্ততি নিয়ে সমাজের অন্য মানুষের মত বাঁচার জন্য সরকারের কাছে সকল সুযোগ সুবিধা চাই।
পতিতাপল্লীর যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা লাইট হাউজ নামের একটি এনজিও এর পিয়ার এডুকেটর ফাহাদ খান বলেন, ‘পতিতাপল্লীর যৌনকর্মীদের লাইট হাউজ থেকে আমরা অনেক ধরণের সহযোগিতা করে থাকি। তাদেরকে এইআইভি ও এইডস এবং সংক্রামক রোগ মুক্ত রাখার জন্য পরামর্শ ও সরঞ্জামাদি দিয়ে থাকি। পতিতাপল্লীর যৌনকর্মীরা অসুস্থ হলে লাইট হাউজের পক্ষ থেকে চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় ঔষুধগুলো অর্ধেক দামে প্রদান করা হয়। ফ্রি ডায়েবেটিস এবং এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। তারা যেনো সংক্রামক রোগ ও এইচআইভি এইডস মুক্ত থাকে এজন্য কাউন্সিলিং, সভা-সেমিনার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
পতিতাপল্লীর শিশুদের নিয়ে কথা হয় বাগেরহাট জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা আসাদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। হোক সে দরিদ্র, ধনী কিংবা পতিতাপল্লীর শিশু, সকল শিশুরই সমান অধিকার আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও এই সকল পিছিয়ে পড়া শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে, কারণ আমরা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক। আর আমার বাগেরহাট জেলা শিশু একাডমি কার্যালয়ে যে সকল সুযোগ-সুবিধা আছে তা এই সব পিছিয়ে পড়া শিশুর পাশাপাশি সকল শিশুই পাবে।’
তিনি বলেন, যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তাদের মৌলিক অধিকার। তাহলেই যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা শিশুরা হয়ে উঠবে আগামী দিনের বাংলাদেশের কর্নধার।