আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কোনো সমন্বয় হবে না

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন জোরদার হওয়ার আলোচনা যখন চলছে, তখনই ভাঙন ধরল গণতন্ত্র মঞ্চে। মঞ্চ গঠনের মাত্র নয় মাসের মাথায় বের হয়ে গেল গণ অধিকার পরিষদ। সাত দলীয় জোটের এ মঞ্চ বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে গুঞ্জন ছিল, গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে অন্যান্য দলের বোঝাপড়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে।
যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখ গেল শনিবার। মঞ্চ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন দলটির সদস্যসচিব নুরুল হক নুর। এ দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া।
শনিবার গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় মঞ্চ থেকে বের হয়ে আসার। ওই বৈঠকে বের হয়ে আসার কারণ হিসেবে বলা হয়, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে অধিকার পরিষদ আরো ছয় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে আসছিল। তবে তারা বর্তমানে নিজস্ব উদ্যোগে সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা ৫৪ দলের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি পালন করতে চয়।
তাদের মতে, মঞ্চ বা জোটে কিছু নিয়ম বা আইন আছে যার সঙ্গে এসব কর্মসূচি সাংঘর্ষিক হবে। রবিবার গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের বিষয়টি জানানো হয়।
গত বছরের ৮ আগস্ট রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র মঞ্চ নামের নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোটের দলগুলো হলো- জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
জানা গেছে, সম্প্রতি গণতন্ত্র মঞ্চের বেশ কয়েকটি বৈঠকে গণ অধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতারা অনুপস্থিত ছিলেন। বিএনপির সঙ্গে সর্বশেষ গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে গণ অধিকার পরিষদের কোনো নেতা অংশ নেননি।
জানতে চাইলে নুরুল হক নুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, মঞ্চ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য দলের তরুণ সদস্যদের চাপ ছিল। আমরা নবীন দল হলেও কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠিনি। আমরা গণতান্ত্রিক দল। তাই দলের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। দলের বেশির ভাগ তরুণ সদস্যের অবস্থান ছিল জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার।
গণতন্ত্র মঞ্চ ভুক্ত অন্যান্য দলগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আন্দোলনের ক্ষতি হোক এ রকম কোনো কথা গণ অধিকার পরিষদ থেকে বলব না। জোটে থাকতে আমাদের মধ্যে যে আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, সেটাতে কোনো ঘাটতি বা সংকট যেন পরবর্তীতে দেখা না দেয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। আগামী শুক্রবার (১২ মে) আমাদের একটা কর্মসূচি ছিল, কিন্তু একই দিনে গণতন্ত্র মঞ্চের আলাদা প্রোগ্রাম থাকায় আমাদের কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।
এ সময় নুরুল নুর জানান, ৭ দলীয় জোটের মঞ্চ হলেও, শুরু থেকেই এর ওপর বিএনপির একটা প্রভাব ছিল। আন্দোলন ও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিএনপি সমন্বয় করত।
বিএনপি নির্ভরতার কারণে কি গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়েছেন? জানতে চাইলে নুর তা অস্বীকার করে বলেন, তেমন কিছু নয়। বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য ৫৪ দল যুগপৎ আন্দোলন করছে। গণ অধিকার পরিষদও সব যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে। ফলে মঞ্চ থেকে বের হয়ে গেলেও আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো সংকট দেখা দেবে না।
গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল কি না- জানতে চাইলে নুর জানান, এটা ঠিক পথ চলতে গিয়ে আমাদের মধ্যে ও কিছু বিষয় নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। দেখুন, একটা পরিবারের মধ্যে যেমন কিছুটা মনোমালিন্য থাকে মঞ্চের বিষয়টাও এমন। তবে এ সংকট মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। এটা খুব ছোটখাটো বিষয় ছিল। তাই বলতে পারেন আমাদের বের হয়ে আসা একটা পিসফুল ডিভোর্স বা শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদ।
কর্মসূচি পালনে আর্থিক সমন্বয়, বক্তব্য দেওয়া, জনবলের জোগান নিয়ে মঞ্চের অপর ছয় দলের সঙ্গে টানাপোড়েন বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব বলেন, জোটের কর্মসূচিতে একটা গা-ছাড়া ভাব ছিল। এমন অনেক বার হয়েছে যে, একটা কর্মসূচি দেওয়ার পর দেখা যায়, একদল মনে করছে আরো দল আছে তারা হয়তো জনবল নিয়ে আসবে। ফলে তারা কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বসে থাকত। আবার মঞ্চের অনেক বিষয়ের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছিলাম না।
তবে কোন কোন বিষয়ে মতের অমিল ছিল তা বিস্তারিত বলতে রাজি হননি নুর।
তিনি বলেন, এ বিষয়গুলো বাইরে প্রকাশ হলে সরকার বা তাদের বিরোধী মঞ্চ সুবিধা নেবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গণ অধিকার পরিষদ নির্বাচনে যাচ্ছে, এম গুঞ্জন বিষয়ে নুর বলেন, সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের পর এখন যে একটা পাতানো নির্বাচনের উদ্যোগ নিচ্ছে সেটাতে গণ অধিকার পরিষদ কোনোভাবেই যুক্ত হচ্ছে না। আমরা দল গঠনের দিন একটা ঘোষণা দিয়েছিলাম, আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা যেকোনো দলের সঙ্গে জোট গড়তে পারি, সমন্বয় করতে পারি। কিন্তু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো সমন্বয় হবে না। এ সিদ্ধান্ত থেকে আমরা কখনো সরে আসব না বা আসার সুযোগও নেই।
শনিবার গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও রবিবার গণতন্ত্র মঞ্চের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে অংশ নেন গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর। মঞ্চের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত জানাতে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন নুরুল হক নুর। তিনি তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বলেছেন, মঞ্চের সঙ্গে না থাকলেও আন্দোলন-সংগ্রামে স্বতন্ত্রভাবে কর্মসূচি পালন করবেন তারা।’
গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকটি কর্মসূচিতে আমাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চে বাম ঘরানার আধিপত্য। আমরা ডানে-বামে বিশ্বাস করি না। আমরা চেয়েছিলাম এ জোটে সবার সমন্বয় থাকবে, যেটা হয়নি। তাই গণ অধিকার পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’