এখনো হিরণ

এখনো হিরণ

যখন পঞ্চমবারের মত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে তখন আবারও আলোচনায় সাবেক সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। নগরীর প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ‘হিরণের মত নগরপিতা চাই’। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতকে নাগরিক সংর্বধনাকালে নগরবাসীকে তিনি কথা দিয়েছেন হিরণের মত নগরী গড়ার। সাবেক এই মেয়রের মৃত্যু’র একদশক পেরিয়ে গেলেও শুধু বরিশাল নয়, দেশ জুড়ে আলোচনায় রয়ে গেছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিরণের কর্মফল তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুৎসহ সুপেয় পানির তীব্র সংকটাপন্ন কাদামাটি জরাজীর্ণ ঘেরা বরিশাল মহানগরীর মানুষ একসময় সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত ছিলো। কিন্তু সেই অভাব এবং মানুষের ইচ্ছা মূল্যায়ন করে নগরীকে আধুনিকায়ন করার অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভাব হয় মেয়র হিরণের। নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে গোটা নগরীর রূপ পালটে দিলেন তিনি। আর নগরবাসীও পেলেন এক মহানগর গড়ার কারিগর। বরিশালকে সাজালেন আধুনিক রূপে। 

কেমন ছিলেন সাবেক মেয়র হিরণ? এমন প্রশ্ন নিয়ে আলাপ হয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আব্দুর রহমন বলেন, ‘হিরণ ছিলো এক আদর্শ নেতা। তিনি সকল প্রকার মানুষকে বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন দক্ষ ও বিচক্ষণতার এক নৈতিক সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। নগর উন্নয়ন নিয়ে যেমন ভেবেছেন, ঠিক তেমনই মানুষের কল্যাণের জন্যও কাজ করেছেন। তাইতো মানুষ ভুলতে পারে না তাঁকে। কারো চাহিদায় তিন অপূনাতা রাখেনি।’

বিসিক শিল্পনগরী সংলগ্ন চায়ের দোকানদার মো. হালিম বলেন, ‘শওকত হোসেন হিরন সব সময় মানুষের মন জয় করে চলতেন। সাধারণ পোষকে চলাফেরা করেছেন। দলমত নির্বিশেষ নগরীর মানুষকে এক করেছেন এবং সবাইকে প্রচন্ড ভালবাসতেন।’

নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সমির বলেন, ‘মেয়র হিরণ আমাদের জন্য রাস্তাঘাট, সড়কে লাইটসহ অনেক কিছুই করে গেছেন। কিন্তু নতুন মেয়র এলাকাই চেনেন না। হিরণের কাজগুলোই জোড়াতালি দিয়ে গেছে সবাই। যে কাজ করবে, আমরাতো তাকেই মনে রাখবো, তাই হিরণকে মনে রাখছি।’

রিক্সাচালক  মো. হারুন বলেন, ‘এই নগরীর রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য ছিলো। রাত হলেই নগরী অন্ধকারে ডুবে যেতো। বিভিন্ন স্থানে চুরি-ডাকাতি ছিলো নিত্য দিনের খবর। কিন্তু তিনি মেয়র হওয়ার পরেই রাতারাতি নগর বদলে দিয়েছেন। অনেক মানুষকে সিটি করপোরেশনে চাকরি দিয়ে দিয়েছেন। নগরীর হাজার হাজার গরিব মানুষকে এক টাকা করে হলেও সাহায্য করেছেন। কেউ খালি হাতে ফিরেনি। তিনি সবার মন জয় করেছেন। আজ তার মতো একজন মানুষ নগরীতে থাকলে আমরা শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেশ রুপান্তরকে বলেন, ‘যাকে হারিয়েছি তাঁকে তো আর ফিরে পাবো না। কিন্তু তার কর্ম মানুষের প্রতি তাঁর সম্মান এবং ভালোবাসা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাঁর মধ্যে আমরা কখনো কোনো অহংকার দেখি নি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ আমাদের সকলকে সম্মান করতেন তিনি। তিনি বিদ্যালয়ে আসলে কখনো রাজনৈতিক আলাপ করতে না। অনেক প্রোগ্রামে বিদ্যালয়ে এসেছেন। সব সময় শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য বলতেন, গল্প শোনাতেন।’

নগরীর ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘হিরণ সাহেব থাকাকালীন ব্যবসা করতে গিয়ে কখনো কোনো হেনেস্থার শিকার হই নি। বরং তিনি আমাদরে কর্মচারীদের প্রতি যেন কোনো অবহেলা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বলতেন। তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের ব্যবসায়ীদের কষ্ট তিনি বুঝতেন। কিন্তু যখন বরিশালটাকে গুছিয়ে এনেছিলেন, ঠিক সেই সময় নগরীর একদল মানুষ মিলে তার সথে বিশ্বাসঘাতকাতা করেছেন। তাঁকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছেন। তারপর থেকেই হিরণ সাহেব দুর্বল হয়ে পরেছিলেন।’

বিএম কলেজের সাবেক ভিপি এবং শওকত হোসেন হিরণে ঘনিষ্ট মঈন তুষার বলেন, ‘হিরণ সাহেব প্রত্যেক নেতাকর্মীর নাম জানতেন; যা ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি ছাড়া কখনোই সম্ভব না। এছাড়াও তিনি যে কোনো মানুষের সাথে কথা বললে সেই মানুষটিকে ভুলতেন না। যার জন্য মানুষ তাঁর প্রতি এত দূর্বলতা এবং আকর্ষণ। এছাড়াও নগরীর জন্য তিনি গোছানো একটি মাস্টার প্লান করে কাজ করেছেন। সকাল ৮ টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে বেলা ১১ টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কথা শুনতেন। নগরী ঘুরে দেখতেন। আবার অফিস করতেন। এগুলো তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর সাথে সকল মানুষ সরাসরি কথা বলতেন এবং দেখা করতেন। সর্বোপরি তিনি যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তেমনই এখনও মানুষ তাকে ভালোবাসে এবং মনে রেখেছে।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন প্রথম ধাপে বরিশালকে অনুনীক নগরীতে রূপান্তর করে গেছেন। প্রয়োজনীয় বাজেট, জনপ্রতিনিধির উন্নয়ন-আন্তরিকতা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়ে সারা দেশেই একজন আইকনিক সিটি মেয়র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। আর আন্তরিকতাই একজন প্রশাসকের মূল সূচক। তাই তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন  বলে মনে করেন তিনি।’

রাজনীতিবিদ এবং বরিশাল মহানগরীর সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন এ প্রশ্নের উত্তরে মেয়র হিরণের সহর্ধমিনী ও সাবেক সাংসদ জেবুন্নেসা আফরোজ হিরন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি একজন মানুষ হিসেবে যদি বলি- ২৬ বছর আমি তাকে যেটুকু দেখেছি, কারো ভাই, একজন স্বামী আর সন্তানদের বাবা ছিলেন। প্রচন্ড পরিবারভক্ত মানুষ ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে যেটুকু মানবিক গুণাবলী থাকা দরকার তার মধ্যে সবটুকুই ছিলো। তার মা ভক্তের খুব নাম আছে বরিশাল শহরে। প্রতিটা পদে পদে বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে ভীষণ মনে করি। স্বজন-সন্তান এবং পরিবারের প্রতি যত্ন নেওয়ায় কোনো দিক থেকেই তাঁর কমতি ছিলেন না। আমি স্ত্রী হিসেবে তাকে অসাধারণ কর্তব্যপরায়ণ একজন মানুষ হিসেবে দেখেছি।

তিনি আরো বলেন, ‘উনি রাজনৈতিক মহলের অত্যন্ত বিচক্ষণ এক ব্যক্তি। মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত আমি রাজনীতিতে ছিলাম না, সংসারেই সময় দিয়েছি বেশি। যতটুকু দেখেছি তার বিচক্ষণতা, কর্মী ও সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা; বিশেষ করে নেতাদের প্রতি সম্মানে কোনো ঘাটতি ছিলো না তার। ২০০১ সালের জামায়াত-বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন যে রাজনৈতিক মাঠে কর্মীদের কিভাবে বুকে আগলে রাখতে হয়; আমি তা পাশে থেকে দেখেছি। রাজনীতি এবং নগর উন্নয়ন দুটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল।’

জেবুন্নেসা আফরোজ হিরণ ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি সময় পেয়েছিলেন চার বছর সাত মাস। আমি নিজে দেখেছি; একটি প্রজেক্টের কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছিলেন, ওই সময়ে আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একটি এলাকার ছবি তুলছিলেন, তখন আমি প্রশ্ন করেছিলাম ‘এগুলো কি তুমি বরিশালে এপ্লাই করতে পারবে?’ তখন তিনি বলেছিলেন ‘কেন পারব না?’। এছাড়াও একদিন রাতে হঠাৎ করে একটি ফোন আসে। যেহেতু সিটি মেয়র; সেজন্য যেকোনো সময় ফোন আসতেই পারে। তিনি ফোন ধরলেন এবং ওপাশ থেকে একজন বললেন, ‘আমার চালায় কে যেন ঢিল মারে!’  তখন আমি প্রশ্ন করেছিলাম এগুলোতো স্থানীয় কাউন্সিলরদের দেখার কথা তোমার কাছে কেন? তিনি (হিরণ) প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘তিনি মনে করেছেন এই অভিযোগটি আমার কাছে দেওয়া দরকার তাই আমার কাছে দিয়েছে।’ 

প্রসঙ্গত, শওকত হোসেন হিরন এলএলবি পাশ করার পরে জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন । ১৯৮৬ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং ১৯৮৮ সালে ২২ বছর বয়সে বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পরেই আলোচনায় আসেন হিরন। পরে ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পদের নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তার রাজনীতি জীবনে আরো পরিবর্তন আসে ১৯৯৬ সালের পরে। তৎকালীন সময়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ভালো সক্ষতা থাকায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন হিরণ। তার রাজনীতির সক্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা বিবেচনা করে ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মনোনীত করে। এর পরে মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড নিজের মতো করে ঘুছিয়ে নেন। পরে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময়ে বরিশাল মহানগরীকে আনুনিক ভাবে সাজিয়ে তোলেন এবং স্থানীয় মানুষ ও তার অনুসারীদের কাছে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন । ২০১২ সালে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামালের কাছে হিরন পারাজিত হন। তখন গুঞ্জন উঠেছে তার দলীয় লোকেরাই এই পরজিত হওয়ার পিছনে কারন ছিলেন। হিরনের মন ভাঙলেও তিনি থেমে যায়নি ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি বরিশাল সদর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল নগরীর প্রজাদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।