করোনা থেকে বাঁচতে হাসপাতাল নয়, ব্যবস্থা নিতে হবে নিজেকে

করোনা থেকে বাঁচতে হাসপাতাল নয়, ব্যবস্থা নিতে হবে নিজেকে

করোনা শব্দটি বিশ্বে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা মিলছে না। অর্থবিত্ত কোন কাজে আসছে না। করোনা উপসর্গ আছে শুনলে বেসরকারি নামি-দামী হাসপাতালে স্থান পাচ্ছেন না অঢেল টাকার মালিকরাও। টাকা নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হচ্ছে অনেককে। বিত্তবানদের চিনিৎসা না পাওয়ার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। ভয়েও তারা নিজেদের জ¦র, কাশি, সর্দির কথা বলতে ভয় পান। যাদের ভরোসা সরকরি হাসপাতাল, তারা তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরেক সমস্যা সৃষ্টি করছেন। তাই করোনায় হাসপাতালের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে চা, লবঙ্গ, গোলমরিচ, আদা, লেবু গরম জলই এখন একমাত্র ভরোসা।

করোনার আতঙ্কে কেউ এখন জোরে হাঁচি দিতে পর্যন্ত দিচ্ছেন না। হাঁচি দিলে নিজের অজান্তেই চরম অপরাধবোধ কাজ করে। কাশি চাপানোর চেষ্টা নিরন্তর। কাশি দিতে ভয় পাচ্ছে সবাই। সবার ভেতরে এখন হাঁচি-কাশি চাপিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় অনেকেই বিজয়ী হচ্ছেন। চা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, কালিজিরাসহ নানা উপাদানের জল পান করতে করতে কেউ কেউ উৎরে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা সেই বিজয়ের মালা পড়তে পারেন না, তাদের জন্য চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা। এর সঙ্গে জ¦র, সর্দি, কাশি হলে তো আর রক্ষা নেই। ভয়ে সিটকে যাবেন আপনি, পরিবার এবং সমাজ। মোটাদাগে ধরে নেওয়া হবে করোনা উপসর্গ। আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া হবে ওই করোনা রোগী। আবার করোনা উপসর্গ যদি কারো হয়েই থাকে তার জন্য পুলছিরাত পাড় হওয়ার পরীক্ষায় বসতে হবে। পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও অভিযোগ দেওয়ার জায়গা মিলবে না। 

ধরুন আপনার সর্দি, জ¦র, কাশি হয়েছে, শরীর ব্যাথা করছে এবং রুচি নাই। এবার আপনি আপনার স্বজনদের রক্ষায় নিজে থেকে যদি সতর্কতার জন্য করোনা নমুনা পরীক্ষা করাতে চান। ব্যাস এই ইচ্ছা পূরণের জন্য চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। আগে যাচাই হবে আপনি সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা? না কি উপজেলা ও জেলার বাসিন্দা? কে আপনার নমুনা সংগ্রহ করবে সিভিল সার্জন? না কি জেনারেল হাসপাতাল? না কি সিটি করপোরেশন? এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও আপনার নমুনা সংগ্রহ হবে না। যদি আপনি সিটির বাসিন্দা হন তাহলে শুনবেন জনবল অসুস্থ্য। যদি সদর উপজেলা কিংবা জেলার বাসিন্দা হন, তাহলে জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক সার্জন বলবেন, হাসপতালের বাইরে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। সিভিল সার্জনের কাছ থেকেও একই ধরণের উত্তর পাবেন। আবার হাসপাতালে গিয়েও পাবেন না নমুনা সংগ্রহের জনবল। আপনাকে ছুটতে হবে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও ভর্তি না হলে নমুনা দিতে লাগবে সুপারিশ। এটা আপনি জীবিত থাকা অবস্থার পরীক্ষা। নমুনা সংগ্রহের এই ভোগান্তি কমাবে কে?

করোনা সময় যদি আপনি কিংবা আপনার কোন স্বজনের মৃত্যু হয়, তাহলে আপনি কেন মারা গেলেন সেই পরীক্ষায় বসতে হবে। একদিকে করোনা সময় মৃত্যু, ধরেই নেওয়া হয় করোনা পজেটিভ। এবার নমুনা পরীক্ষা ছাড়া শেষ কাজ করতে পারবেন না। এবারের পরীক্ষা আরো কঠিন ও জটিল। জেলা প্রশাসন, পুলিশ, গণমাধ্যম সবার দ্বারস্থ হবেন। কাজের কাজ কিছুই হবে না। আগে কে নমুনা সংগ্রহ করবে সেই পর্যন্ত পৌঁছাতে। একজন অন্যজনের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের কাজ না করার বাহানা করবেন। এই কাজে সিভিল সার্জনের ভূমিকার জুড়ি নেই। যদিও জেলার প্রধান দায়িত্ব তাঁর। কিন্তু তিনি কাউকে সহযোগিতা দেবেন না ঠিক করে নিয়েছেন। গণমাধ্যমের ফোন ধরবেন না, জেলা প্রশাসন, পুলিশের ফোন ধরলেও সহযোগিতা পাওয়া কঠিন। এক পরীক্ষায় ৬ ঘন্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। ততক্ষণে লাশের পচনও ধরতে পারে। আমরা এই ভোগান্তির অবসান চাই।

গত কয়েকদিনে কয়েকজন নামী-দামী ব্যক্তির হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। বরিশালে করোনা চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার আনোয়ার হোসেনকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হলেও কোন হাসপাতালে তাঁর জন্য ব্যবস্থা হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে যখন হাসপাতালে সিট পেলেন ততক্ষণে তিনি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছেন। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের দিকে নজর দেওয়া জরুরী। সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা দরকার। সকল জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বেসরকারি নামী-দামী হাসপাতাল মানুষকে জিম্মি করতে না পারে। তাই এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য বিভাগকে অতি গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দিতে হবে।

সরকার সারা দেশে করোনা পরীক্ষার জন্য সিভিল সার্জনদের জনবল, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সমাগ্রি দিয়ে সহযোগিতা করছে। একই সঙ্গে জনবল বাড়ানোর জন্য ডাক্তার এবং নার্স নিয়োগ দিয়েছেন। তারপরও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। কেবল দায়িত্বশীল মানুষদের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে। যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, র‌্যাবসহ মধ্যম সারির ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই সময় স্বাস্থ্যবিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অসহযোগিতা এবং দায়িত্বহনিতা আমাদের ব্যথিত করছে। আমরা তাদের কাছ থেকে মানবিক আচরণ আশা করি। করোনা উপসর্গ কিংবা সাধারণ নাগরিকদের করোনা নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা সহজতর করার আহ্বান জানাচ্ছি।

একটি জেলা সিভিল সার্জন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলে গোটা জেলার স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রভাব পড়ে। সেখান থেকে উত্তোরণের জন্য অবশ্য অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মানুষ যেন অজানা ভীতির মধ্যে না পড়ে। করোনার জুজু দেখিয়ে যেন সেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত না হয়। সেদিকে সিভিল সার্জনসহ সবার সহযোগী মনোভাব প্রত্যাশা করছি।