করোনায় আরও মানবিক হওয়া দরকার

করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গোটা দুনিয়ায় নানা রকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। করোনা মানুষের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ ও আভিজাত্য দূরে সরিয়ে মানবিক হওয়ার বার্তা নিয়ে এসেছে। হিংসাও উন্মত্ত পৃতিবীকে নির্মল শান্তির আহ্বানের পথে নেবে করোনা। এই দুঃসময় এমন আশার বার্তা নিয়ে দূরে থেকেও অনেকে আত্মার আত্মীয় হচ্ছেন। করোনা রোগীর সেবা, মৃত ব্যক্তির জানাজা, করব দেওয়া এবং দাহ করেও অনেকে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। আমাদের পুলিশ যে কোন সময়ের চেয়ে মানবিক হয়ে করোনা মোকাবেলায় সহযোগী হয়ে ২৪ ঘন্টা কাজ করছেন। আছেন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ অনেকে। করোনা সময় আমাদের সবার এমন মানবিক হওয়াই দরকার।ৎ
নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ নিজস্ব উদ্যোগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লাশ দাফন করে পৃথিবীতে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কেবল কি দাফন করা। না। সনাতন ধর্মের অনেকের লাশ দাহ করেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। চরম দুঃসময়ে যখন স্বজনরা লাশ ফেলে পালাচ্ছিল তখন একের পর এক লাশ দাফন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন খোরশেদ। নিজের স্ত্রী সন্তানদের দূরে সরিয়ে দিয়ে মানব সেবায় ব্রতি হয়েছেন তিনি। মানুষের পাশে থেকে তিনি সবকিছু ছাড়িয়ে উর্ধ্বে উঠে গেছেন।
কাউন্সিলর খোরশেদ এই মুহূর্তে করোনা পজেটিভ হয়ে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছেন। তিনি আক্রান্ত হয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘আলহামদুলিল্লাহ, করোনা পজেটিভ হয়েছে’। নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েও তার কাজ বন্ধ থাকবে না বলে ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি করোনাকে আলিঙ্গন করে এই যুদ্ধ চালিয়েও যাচ্ছেন। আমরা জানি খোরশেদ অবশ্যই করোনাকে জয় করে আবার মানুষের সহযোগী হবেনই। এরকম অনেক উদাহরণ দেশে আছে। যেমন বরিশালে গণমাধ্যমকর্মীদের ‘উদ্যোগ’, অসহায় ও ছিন্নমূল শিশুদের দুই মাসের বেশি সময় ধরে রাতে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং এসএসসি ৯৩ ব্যাচও একই উদ্যোগ গ্রহণ করে দুপুরে খাবার সরবরাহ করে চলে। লাল সবুজ সোসাইটির বন্ধুরা মেডিকেল কলেজসহ অসহায় মানুষের পাশে থেকে কাজ করে চলেছে। বাসদের ডা. মণিষা চক্রবর্তীর ‘মানবতার বাজার’ সারা দেশে সাড়া ফেলেছে। জেলা স্কুলের সকল ব্যাচের শিক্ষার্থীদের গোপনে কর্মহীন মানুষের বাড়ি বাড়ি সামগ্রি পৌঁছে দিয়ে সহযোগী হওয়াসহ অনেক উদাহরণ আছে। এমনসব ইতিবাচক উদাহরণ আমাদের করোনা থেকে মুক্তির পথ দেখায়। শোনায় মানুষের জয়গানের কথা।
এতো এতো ইতিবাচক ঘটনার মধ্যেও কিছু কিছু ঘটনা আমাদের চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। যখন শুনি কেবল করোনা উপসর্গ কিংবা আক্রান্ত হওয়ার কারণে বাবাকে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে মালিক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। করোনা আক্রান্ত বাড়ি লকডাউন করায় সেই বাড়িতে হামলা কিংবা জন্তু জানোয়ারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো দেখিয়ে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে। তখন আমাদের অনন্য উদাহরণগুলোকে ব্যঙ্গ করা হয়। ইতিবাচক উদ্যোগগুলো গুমরে কেঁদে ওঠে। বলে এই কি মানব জাতি? এই কি মানব ধর্ম? এই কি স্বজন, আত্মীয়? এই কি আমাদের মানবতা। কোথায় যেন আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
সবশেষ বরিশাল নগরের মহাশ্মশানে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। নিজেদের প্রতি নিজেদের ঘৃণাবোধ হচ্ছে। গত শনিবার বিকেলে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এক স্বজনকে নিয়ে মহাশ্মশানে গেলে তাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কুকুর বেড়ালের মোত শ্মশানের বাইরে ভিজতে হয়েছে তাদের। করোনা আক্রান্ত মরদেহ হওয়ার অভিযোগ তুলে শ্মশানে শেষকৃত্য করা যাবে না এমন কথা ছাপ জানিয়ে দেন শ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার। যেখানে নারায়নগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদ স্বজনদের ফেলে যাওয়া মরদেহ শ্মশানে নিয়ে দাহ করছেন সেই সময় বরিশালে শ্মশান রক্ষার নামে ওই মালাকার স্বজনদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। স্বজনরা মরদেহ নিয়ে শ্মশানের বাইরে পুরো ৪ ঘন্টার বেশি বৃষ্টিতে ভেজেন। তারপরও মন গলেনি তমাল মালাকারের। পরে অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় বরিশাল শ্মশানেই মরদেহর শেষ কৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
চিকিৎসক বাবার সন্তান নিয়তি বণিক জানিয়েছেন, নারায়নগঞ্জের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদ তাঁর দল নিয়ে কোভিড-১৯ বা করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশের দাফন ও দাহ করছেন। তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওনের পর কেউ কাছে আসে নাই। আমার আত্মীয়রাও আসে নাই, সবাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিছিল। তবে এই দুর্দিনে কাউন্সিলর খোরশেদ ভাই দৌড়াইয়্যা আসছেন। আমি বাবার মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দিছি, ভাই (খোরশেদ) আমার হাত ধইরা পাশে ছিলেন। এইটাই তো অনেক বড় পাওয়া। বাবার সৎকারে যতটুকু নিয়ম পালন করা সম্ভব, তার সবই করছেন কাউন্সিলর ও তাঁর দলের সদস্যরা।’ কাউন্সিলর খোরশেদ একের পর এক করোনা আক্রান্ত কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশ দাফন এবং সৎকার করে চলেন। ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেই তিনি এই কাজ করে চলেছেন।
নারায়নগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদের মানবিক উদ্যোগ দেখে আমাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে। তেমনি কেবল করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া সনাতন ধর্মের মানুষ নিতাই চন্দ্র শীলের দাহ করতে না দেওয়ার ঘটনা আমাদের ব্যথিত করছে। করোনার মধ্যে যখন মানুষে মানুষে বিভেদ ভোলার কথা। যখন একজন অন্যজনের সহযোগী হওয়ার কথা, তখান একজন তমাল মালাকারের কা- আমাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। কাউন্সিলর খোরশেদ যখন কোন জাত-পাতের বিচার না করে জানাজা, কবর দেওয়া এবং সৎকারের ব্যবস্থা করে চলেছেন, সেই সময় একজন শ্মশান রক্ষা কমিটির নেতার আচরণে গোটা দেশবাসীকে হতাশার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে। বরিশালসহ দেশের মানুষ শ্মশান রক্ষা কমিটির এই মানবতা বিবর্জিত নেতাকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন।
নিয়ম অনুযায়ী মানুষ মারা যাওয়ার পর ধর্মীয় রীতি ও প্রথা অনুযায়ী গোরস্থান কিংবা শ্মশানই হয় শেষ ঠিকানা। করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ায় চরম সংকটে পড়েন এই সময়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা। করোনা আক্রান্ত রোগী কবর দেওয়া কিংবা সৎকার করলে অন্যরা আক্রান্ত হবেন এমন জুজু ছাড়ানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে মৃত ব্যক্তির জানাজা, করব দেওয়া এবং দাহ করলে কোনভাবেই করোনা ছড়ানোর কথা নয়। এই বিষয়গুলো কবরস্থান, শশ্মান এবং সব মহলে প্রচার করার পরও কিছু ধর্মান্ধ মানুষের খামখেয়ালীর শিকার হচ্ছেন মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরী। স্বজনের লাশ ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজিয়ে যে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন তমাল মালাকার, সে দায় কোনভাবে আমরাও এড়াতে পারি না। আমাদের মানবিকতা দিয়ে করোনাকে জয় করতে এই অমানবিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
আমরা বলতে চাই, করোনা আমাদের একটি দুঃসময়ের মধ্যে ফেলেছে এটা সত্য। তাই বলে আমরা সেই দুঃসময়ের পাকে পড়ে থাকবো এটা হয় না। সেখান থেকে আমাদেরই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নাই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও তাঁর শবযাত্রা, জানাজা, ও শেষ কৃত্য করতে হবে। সেখানে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নারাযনগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদ যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সেই উদাহরণ সৃষ্টি হোক।
আমরা চাই, করোনার সময় আরো বেশি মানবিক হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াই। সামাজিক দূরত্বের নামে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সুযোগ নাই। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমাদের মানুষের পাশে সহযোগী হতে হবে। সেইজন্যই আমাদের করোনা সময়ে আরও একটু মানবিক দওয়া দরকার।