করোনায় জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ দিয়ে বিশেষ তহবিল গঠন করুন: টিআইবি

করোনায় জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ দিয়ে বিশেষ তহবিল গঠন করুন: টিআইবি

করোনা ভাইরাস-উদ্ভূত মহাসংকট মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন, জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশের সমপরিমাণ বিশেষ তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে এই কৌশল বাস্তবায়ন ও তহবিল ব্যবহারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহ্বানও জানিয়েছে টিআইবি।

শুক্রবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবি উল্লেখ করেছে, করোনা বা কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি ও এর বহুমুখী প্রভাব কোনো তাৎক্ষণিক সমাধানযোগ্য সমস্যা নয়, বরং এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় এখনই স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাসহ একটি সমন্বিত জাতীয় কৌশল প্রণয়ন অপরিহার্য। একই সঙ্গে অভূতপূর্ব এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সকল প্রকার আর্থিক লেনদেনসহ প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জাতির উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ ২০২০ প্রদত্ত ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্মিলিতভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যে ডাক দিয়েছেন’। তার ওই বক্তব্যের প্রতি একাত্মতা জানায় টিআইবি মনে করে,  ‘হোম-কোয়ারেন্টিনে দেশবাসীকে পাঠিয়ে নিতান্তই অপ্রতুল ও বিক্ষিপ্ত কিছু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে হাতগুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। এখনই সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা সম্বলিত জাতীয় কৌশল চূড়ান্ত করতে হবে এবং একই সঙ্গে তার বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থের যোগানের পাশাপাশি বহুমুখী উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত করা ও চিকিৎসার সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ও তাঁদের অমূল্য অবদানের উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে।’

রপ্তানি সংশ্লিষ্টখাতের শ্রমিক ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে উদ্যোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তাকে সাধুবাদ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, ‘কীভাবে এর বাস্তবায়ন হবে, বরাদ্দকৃত অর্থ কোন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের হাতে যাবে এবং এক্ষেত্রে কীভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া এখনই নির্ধারণ করতে হবে। এই সহায়তার আওতা দেশের হতদরিদ্রদের জন্য সমভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে। একইভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন, স্বল্প বেতনের কর্মজীবী মানুষ, দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালক, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যাদের অনেকেই ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন বা হবেন তাদেরকেও এর আওতায় আনতে হবে।’

নির্বাহী পরিচালক বলেন, সংকট চলাকালীন সময়ে খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ-লাইন প্রাধান্যের সাথে সচল রাখতে হবে, তা না হলে কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি কোয়ারেন্টিনই মানুষের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কারণ হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে নিয়োজিত পুলিশের একাংশের বিভ্রান্ত ও অশোভন বলপ্রয়োগ সংকট ঘনীভূত করছে, যা বন্ধ করতে হবে।

এ ধরণের দুর্যোগে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের পাশাপাশি ক্ষমতা বাড়বেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্ষমতার উৎসও জনগণ। সীমা লঙ্ঘন করে ক্ষমতার অপব্যবহার করা আত্মঘাতি হয়, সরকারকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে বলে মনে করে টিআইবি। নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘নাগরিকের মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে জীবন-জীবিকার অধিকারের পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা এবং তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের সকল সম্ভাবনা প্রতিহত করা সরকারের দায়িত্ব।’ অর্থনীতির চাকা পুনরায় দ্রুত সচল করার জন্য জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ সমপরিমাণের বিশেষ তহবিল গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছে টিআইবি। প্রয়োজনে মেগা-প্রজেক্টগুলোর অর্থায়ন আনুপাতিক হারে কমিয়ে এনে এই খাতে অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের বরাদ্দের পাশাপাশি দেশের ধনিকশ্রেণিকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। জনগণের করের টাকায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একাংশ বিভিন্ন সময়ে বহুমুখী সুবিধা আদায় করে সম্পদের বিকাশ করেছেন। আজ এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা বিশ^াস করতে চাই তাঁরা জনস্বার্থে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। ‘পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে তহবিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তার পুরোটাই যোগানোর দায়িত্ব কী এদেশের মহা-ধনীজন অনায়াসে নিতে পারেন না?’ বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে লিপ্ত বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতায় আগ্রহী, অংশীদার এবং অনেকে লাভবান, তাদেরকেও নিজেদের স্বার্থে এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে অবদান রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে টিআইবি।  

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এ বিশাল সংকট মোকাবেলায় সফল হতে হলে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার কোনো বিকল্প নেই। তথ্যের স্বচ্ছ ও অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান সচেষ্ট হবেন বলে আমরা আশা করি। বিশেষ করে কোন খাতে কত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, অর্থায়নের উৎস এবং কীভাবে ও কতটা কার্যকরভাবে তা ব্যয় করা হচ্ছে, সে তথ্য নিয়মিত প্রকাশ ও হালনাগাদ করতে হবে। এই সংকটকে পুঁজি করে যেন কোনো ধরণের দুর্নীতি না হয় এবং কেউ যেন অন্যায্য মুনাফা করতে না পারেন, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত তথ্যের ব্যাপারে আস্থাহীনতার সুযোগে গুজব ছড়াচ্ছে, যা জনমনে আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংক্রমণ, প্রাণহানি, চিকিৎসা প্রদান ও সুস্থ হওয়ার সংখ্যাসহ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক সকল কার্যক্রমের তথ্য কোনো প্রকার রাখঢাক না করে প্রকাশ করাটা জরুরি। তাতে জনগণ অধিকতর সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে।’