করোনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিয়ে বিকল্প পথ ভাবতে হবে

করোনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিয়ে বিকল্প পথ ভাবতে হবে

আজ ১১ জুলাই। বিশ্ব জনকংখ্যা দিবস। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও পালিত হবে দিবসটি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারলেও করোনা পরিস্থিতিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একদিকে করোনায় কর্মহীন হওয়া, অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছানোয় চ্যালেঞ্জ। দুই চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাড়ছে বাল্যা বিবাহ ও অতিরিক্ত শিশু জন্ম। তাই জনসংখ্যা দিবসে করোনার সঙ্গে সঙ্গে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছাতে বিকল্প পথ ভাবতেই হবে।

শিক্ষা, সচেতনতাই গড়তে পারে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর এই রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান হলো জনসংখ্যা। জনসংখ্যা না থাকলে দেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন। আবার অধিক জনসংখ্যা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে হুমকীর মুখে ফেলতে পারে। বলা হয়, একটি দেশের জনসংখ্যাকে ওই দেশের সম্পদ বলা হলেও অতিরিক্ত জনসংখ্যা সম্পদ নয়, বরং বোঝা বলা যায়। কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি আর সচেতনতা জনসংখ্যাকে হুমকীর পরিবর্তে জনসম্পদে রূপ দিতে পারে। যখন জনসংখ্যা কোন দেশের জনসম্পদের রূপ নেয়, সেই দেশ সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছায়। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ চলমান রাখতেই হবে। সেজন্য বাল্য বিবাহ বন্ধ এবং করোনাকালে প্রজনন স্থাস্থ্য এবং পরিবারপরিকল্পনা সেবা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে কাজ করা দরকার।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি। ১৯৪১ সালে যা বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ২০ কোটি। অর্থাৎ ৮০ বছরে বাংলাদেশে মাত্র দুই কোটি জনসংখ্যা বাড়ে। আবার ১৯৬১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৫২ কোটি যা ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১৫ কোটি। ত্রিশ বছরে দ্বিগুণ জনসংখ্যা বেড়েছে। ২০১২ সালে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৭ লাখ। ২০১৬ সালের ১ জুলাইতে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৮ লাখে। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫৩ লাখ। এটি বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১১৬ জন, যা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ (কিছু দ্বীপ ও নগর রাষ্ট্র বাদে)। গত তিন যুগে দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যা বেড়েছে।

এমন বাস্তবতায় আজ ১১ জুলাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হবে। ১৯৯০ সালে প্রথম ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে। আর বাল্যবিবাহের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারীর কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চরম ব্যহত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ,  নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা কোভিডের কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে গেছে। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর অনিশ্চত ভবিষ্যৎ এর আশঙ্কায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ। যার ফলে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়াতে বিষয়টি এখানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও সেটাকে উদ্বেগজনক বলা হতো। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর এই সেই উদ্বেগ আরও বেড়েছে। পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় ঘনবসতিপূর্ণ নগর হলো ঢাকা। দেশের ১০ ভাগ জনসংখ্যা ঢাকা শহরে বাস করে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনসংখ্যাবহুল শহর। এই আধিক্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেনস ফান্ড (ইউনিসেফ) এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালের প্রথম দিনে জন্ম নিয়েছে ৯ হাজার ২৩৬ শিশু। আর বিশ্বজুড়ে প্রথম দিনে ভুমিষ্ঠ হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৫০৪ শিশু। ইউনিসেফ আরো জানায়, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে ১৪ কোটি নবজাতক জন্ম নিতে পারে। ইউনিসেফ’র তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নেয়। সেই হিসাবে পহেলা জানুয়ারি প্রায় এক হাজার অতিরিক্ত বেশি জন্মগ্রহণ করেছে।

মহামারীর সময় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এর প্রভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো জটিলতার মুখে পড়বে। পরিবার পরিকল্পনায় এখনই যথাযথ উদ্যেগ গৃহীত না হলে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাধাগ্রস্ত হবে সকল উন্নয়ন। আর এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করোনাকালীন সংকটে রেপিড সিচুয়েশনাল আ্যসেসমেন্টের মাধ্যমে সঠিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তার সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য জোর দিতে হবে প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিতের ওপর।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া। পরিবেশ দূষণ, মাদকাসক্তি, শিক্ষার অভাব এবং সচেতনতার অভাবও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে করোনা। করোনায় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো একটা নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে। তাই বাড়ছে জন্মহার। পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা আমাদের দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা ভূমিকা পালন করছে। তবে সেটা নি¤œ আয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে কাজ করছে না। যেখানে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেখানে সেই ব্যবস্থা এখনো শূন্যের কোঠায়। তাই জনসংখ্যা নিয়নান্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জনগোষ্ঠীকে সুশিকক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করতে হবে। করোনায় কিভাবে গ্রাহক পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দ্রুত পৌঁচানো যায় তার উপায় ভাবতে হবে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, ‘দারিদ্র্য অবশ্যই শিশু বিবাহের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। তবে, কোভিড-১৯ এর কারণে আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা এখনো বিশদ তথ্য জানতে পারিনি’। কোভিড-১৯ বিবেচনায় করোনা বাস্তবতায় বদলে যাওয়া পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়েছে, আর পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাত আরো অবহেলিত।
মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি ও কমিউনেশন হেড মনজুন নাহার বলেন, করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। গর্ভধারণ, বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা এবং অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এখান থেকে বের হতে নতুন পথ খুঁজতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলাম বলেন, করোনাকালে সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। করোনার চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে আ্যপভিত্তিক সেবার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে।

আমরা মনে করি জনসংখ্যা বড় সমস্যা নয়, বড় সমস্যা হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলোর সঠিক নিশ্চয়তা প্রদান করা। মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌছাতে বিকল্প খুঁজতে হবে।