করোনায় সন্তানকে রক্ষায় বাবা-মাকে দৃঢ় ও সাহসী হতে হবে
করোনা বৈশ্যিক মহামারীর নাম। করোনা আমাদের বিপর্যন্ত করে ফেলেছে। বাবার সামনে কন্যার করুণ আকুতি ‘বাবা আমি এতো তাড়াড়ি মারা যাবো’? অথবা বাবা ‘আমি কি বাঁচবো না’? আমরা আহত হয়েছি, মুগদা হাসপাতালের সামনে বাবার কোলে শিশু কন্যাকে আগলে রাখার দৃশ্য দেখে। করোনা টেস্ট করাতে গিয়ে দুর্ভোগের ওই চিত্র আমাদের অন্তরাত্মায় আঘাত করেছে। এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের হৃদযন্ত্রে নতুন করে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। বাবার সামনে সন্তানের এমন আহাজারী শুনে কোন বাবা-মা ঠিক থাকতে পারে? পারে না। পারে না যে তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। আমার সন্তান নিয়ে করোনা সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লেখা প্রতিবেদন পড়ে অনেকেই কেঁদেছেন। তাঁরা প্রত্যেকে ওই অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে নিজে এবং নিজের সন্তানের ছবি দেখেছেন।
আমি যে বাস্তবতা অতিক্রম করেছি। কঠিন ওই সময় যে বাবা কিংবা যারা অতিক্রম করেছেন তারাই জনেন কতটা যন্ত্রণার হতে পারে ওই মুহূর্তগুলো। সন্তানের অসহায় আর্তনাদের পরও যখন বাবা-মা কিছু করতে পারছেন না সেই অপরাধবোধ তাদের বারবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দেয়। বলছি করোনা সময়ের করোনা আক্রান্ত সন্তান কিংবা স্বজনদের নির্মম অসহায়ত্বের কথা। এখন এই কঠিন সময় তো আমাদের অতিক্রমও করতে হবে। করেনার সঙ্গেই আমাদের নিত্য বসবাস করতে হবে। মোকাবেলা করতে হবে যথাসাধ্য মনোবল নিয়ে। তাই করোনর এই দুঃসময় বাবা-মাকে যেকোন অবস্থায় দৃঢ় হতেই হবে। বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরা মনোবাল হারালে তা সন্তানের ওপর প্রভাব পড়বে। নিয়ে যেতে পারে কঠিন বাস্তবতার দিকে। যা কেই কল্পনাও করে না। সেই জন্যই বলি, কোনভাবেই সাহস হারালে চলবে না। ওই সময় সাহস হারালে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
আমরা দেখছি, প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে। সন্তান-স্বজন সবাইকে করোনা স্বার্থপর হতে বাধ্য করছে। আমরা এখন কেবল নিজের চিন্তা করছি। স্ত্রী, সন্তান, স্বজন কারো কথা ভাবার যেন সময় নেই। কেবল আমাকে বাঁচতে হবে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগের করোনা ছিল না। কেবল আতংক এবং মনোবল দুর্বল হওয়ার কারণেই মৃত্যু হচ্ছে। এর সঙ্গে সময়উপযোগী চিকিৎসা না দেওয়ার কারণেও অসময়ে এবং অল্প বয়সেও অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। এমনও নজীর আছে, কেবল করোনা ওয়ার্ডে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়ার কথা জানতে পেরে রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের অন্য ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীকে করোনা উপসর্গ সন্দেহে করোনা ওয়ার্ডে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী মারা গেছেন। এসব রোগীরা কেবল করোনা হয়েছে এমন আশঙ্কায় ভীত হয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাই আমাদের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞাতা থেকে বলতে পারি, করোনায় কোনভাবেই ভীত হওয়া যাবে না। এটাকে অন্য রোগের মতো স্বাভাবিক ভেবে লড়াই করতে হবে। এই মনোবল যাদের আছে তারা এই পরিস্থিতি থেকে জয়ী হয়েছেন। আতংক কিংবা ভীতিকে দূর করে সাহসী হওয়ার কোন বিকল্প নাই।
আমরা জানি এবং চিকিৎসকরা বলেছেন, করোনা আক্রান্ত হলে দ্রুত মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। এসময় অক্সিজেন অথবা আইসিইউ সেবা জরুরী হয়ে পড়ে। সময় মতো অক্সিজেন কিংবা আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব না হলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা আদৌ করোনায় আক্রান্তই হননি, তারা কেন মারা যাচ্ছেন? কারণ ওইসব রোগীরা নিজে থেকেই ধারণা করে নেন তিনি বা তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছন। আর করোনা হওয়া মানে সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে। তখন তার ভেতরে একধরণের ভয় বাসা বাঁধে। করোনা হলে তো আর রক্ষা নেই। এই ভয়ই তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তখন শরীরের ইমিউনিটি দ্রুত কমতে থাকে। যা শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলে। ভয়ে এবং আতংকে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। যাকে আমরা বলি হার্ট অ্যাটাক।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১০৪ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৩৭জন ছিলেন করোনা পজেটিভ। বাকিদের করোনা টেস্ট করানো হলেও সবাই নেগিটিভ ছিলেন। তাহলে তারা মারা গেল কেন এই প্রশ্ন ওঠা একান্তই স্বাভাবিক। এখানে দুই ধরণের সমস্যা হয়েছে। এক. উপসর্গ নিয়ে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া ওই রোগীরা যখন শুনেছেন তাকে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে তখনই তিনি বা তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। যে উপসর্গই থাকুক তিনি ওই সময় অসুস্থ্য থাকায় মনোবল হারিয়ে ফেলেন। সেকারণে মৃত্যুর মুখে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত: করোনা ওয়ার্ডে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন কিংবা আইসিইউ সাপোর্ট দিতে দিতে শ্বাসকষ্টজণিত কারণে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হচ্ছে। আমরা বলতে চাই না যে হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন কিংবা আইসিইউ সাপোর্ট নেই। অভিযোগ আছে, এসব ব্যবস্থা থাকার পরও দ্রুত ওই সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। যে কারণে রোগী মারা যাচ্ছে।
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, রোগী এবং রোগীর স্বজনদের কোনভাবেই হতাস হওয়া যাবে না। বিশেষ করে রোগীর স্বজনদের মনোবল আরও দৃঢ় রাখতে হবে। সব সময় করোনা উপসর্গ কিংবা করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীদের আশ্বস্ত করতে হবে। এটা এমন কোন রোগ নয়, তুমি/আপনি দ্রুত সুস্থ্য হয়ে যাবেন। সব সময় রোগীকে সাহস যুগিয়ে চলতে হবে। রোগী যদি আশ্বস্ত হতে পারে তাহলে বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আপনার সন্তানের করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বাড়িতে রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবা দিন। যদি শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাহলে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা করুন। বাড়িতে গরম পানি, লেবু, লবঙ্গ, কালিজিরা, গোলমরিচ চা পান করুন। আপনার সন্তান দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠবে।