কর্মবীর অশ্বিনীকুমার দত্ত

কর্মবীর অশ্বিনীকুমার দত্ত

আজকের যে বরিশাল আমরা দেখিছি, সেই বরিশালের রূপকারের নাম হচ্ছে মহাত্ম অশ্বিনী কুমার দত্ত। মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ অশ্বিনী কুমার। আজন্ম মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছেন সাংবাদিক ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।

পর্ব-এক


►১.
‘হোয়াট বরিশাল থিঙ্কস্ টু-ডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস্ টু-মরো’, এই অহঙ্কারি আপ্তবাক্য নির্মানে সবার আগে যার নাম উচ্চারিত হয়, তিনি অশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩); ‘মহাত্মা’ অশি^নীকুমার, ‘দেশবন্ধু’ অশ্বিনীকুমার ‘জননায়ক’ অশ্বিনীকুমার। জন্ম তাঁর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি বরিশালের বাবার কর্মস্থল পটুয়াখালীতে। প্রায় পাঁচ বছর থাকেন এখানেই। বাবা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন সাব-জজ। পৈত্রিক বাড়ি বরিশালের বাটাজোর গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে দুবছরের জন্য থাকেন নিজ গ্রাম বাটাজোরে। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু পাঠশালার গুরু মহাসয়ের কাছে। এর পর তিনি পড়েন বাবার কর্মস্থল বিষ্ণপুর, ঢাকা, দৌলত খাঁ, রংপুর প্রভৃতি স্থানে।

অশি^নীকুমার দত্ত ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পাশ করেন রংপুর থেকে। তখন তাঁর বয়স ১৪ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রক্ষার্থে বয়স নথিভুক্ত করা হয় ১৭ বছর। প্রবেশিকা পাশ করে এফ এ ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। 

অশ্বিনীকুমার দত্ত বি. এ. পাশ করেন কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৭৯ সালে এম এ এবং ১৮৮০ সালে এল এল বি পাশ করেন। পড়া শেষ করে প্রধান শিক্ষকের চাকরি নেন শ্রীরামপুর চাতরা ইংরেজি বিদ্যালয়ে। মাত্র সাত মাস চাকরি করে চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে ওকালতি শুরু করেন কলকাতায়। অল্প ক’দিন বাদে ফিরে আসেন নিজ জেলা বরিশালে। এবার ওকালতি শুরু করেন বরিশালে। ওকালতি বা আইন ব্যবসায়ে সত্যের প্রতিনিয়ত অপলাপে ক্ষুব্ধ অশ্বিনীকুমার দত্ত ছেড়ে দেন আইন ব্যবসা। এবার সমাজ সেবা আর রাজনীতি। 

১৮৮৪ সালে বরিশালে প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় বিদ্যালয়; পিতার নামে যার নামকরণ- ব্রজমোহন বিদ্যালয়। ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’ এই বিদ্যালয়ের মূলমন্ত্র। এর পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮৯ সালে একই মূলমন্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন কলেজ। অশ্বিনীকুমার দত্ত এই কলেজে দীর্ঘ পঁচিশ বছর অধ্যাপনা করেন বিনা বেতনে।

►২. 
বলা যায় স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে বরিশালে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনের অনেক আগেই বরিশালে বিদেশী বর্জন, স্বদেশী গ্রহণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর মূলে ছিল নিখাঁদ দেশপ্রেম। বরিশালের কর্র্মযোগী দেশপ্রেমিক কালীপ্রসন্ন ঘোষের হাতে এই স্বদেশী গ্রহণের যাত্রা শুরু। এ প্রসঙ্গে কালীপ্রসন্ন ঘোষের জীবনীকার লিখেন, 

‘যখন বাংলাদেশে স্বদেশিকতার নাম পর্যন্ত কাহারও মনে উঠে নাই, তিনি সেই সময়েই স্বদেশ-প্রাণতার অপূর্ব পরিচয় দিয়াছেন। বাঙ্গলাদেশে ১৯০৫ অব্দে বঙ্গব্যবচ্ছেদ লইয়া এক ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত হয়। উহা স্বদেশী আন্দোলন নামে খ্যাত। ঐ আন্দোলনের বহু পূর্বে অর্থাৎ ১৯০২ সনে কালীপ্রসন্ন বাবু বরিশালস্থ চক্বাজারে ন্যাশনাল এজেন্সি (National Agency)  নাম দিয়া একটি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গদেশের যুবকগুলী সামান্য একটু ইংরেজী লেখাপড়া শিখিয়াই প্রত্যেক কার্য্য ছোট বলিয়া উপেক্ষা করে ও দোকানদারিকে নিতান্ত ছোটলোকের কার্য্য মনে করিয়া ঘৃণা করে; এই ভাব দেখিয়া তিনি সর্ম্মাহত হন। একবার কতিপয় ইংরেজি শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে কথোপকথনকালে তিনি এই কথা শুনিয়া যাহা বলিয়াছিলেন তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিলেন, দেখ, তোমরা সামান্য একটু লেখাপড়া শিখিয়া দেশটাকে একেবারে উচ্ছন্ন করিয়া দিবে। দোকানদারি কাজকে তোমরা ছোটলোকের কাজ বলিয়া উপেক্ষা কর। জানিও পৃথিবীতে কোন কার্য্য উপেক্ষণীয় নহে, যদি সততা রক্ষিত হয়। আমি নিজে দোকানদারি করিয়া তোমাদিগকে দেখাইব যে দোকানদারি ছোটলোকের কাজ নহে, বিশিষ্ট ভদ্রলোকেও করিতে পারে। তোমরা যে, সামান্য গোলামীর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াও, আমি তাহা অপেক্ষা দোকানদারিকে শতগুণ উপরে স্থান দেই।’

এইভাবে প্রণোদিত হইয়াই তিনি ১৯০২ সালে ন্যাশনাল এজেন্সি খোলেন। ভদ্রলোকের শিক্ষিত ছেলে দোকান দিতে পারিয়াছেন শুনিয়া স্বর্গীয় রায়  বাহাদুর দ্বারিকানাথ দত্ত, বিট্সন বেল ও জমিদার বিহারীবাবু প্রমুখ খ্যাতনামা ভদ্রমহোদয়গণ তাহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও উৎসাহ প্রদান করেন। ঐ দোকান তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের শিল্পজাত সামগ্রী দ্বারা পূর্ণ রাখিতেন। ‘কখনও বিদেশী জিনিষ দোকানে আনিব না’- এই ছিল তার পণ। দেশী জিনিস যেখানে যাহা পাইতেন, তাহাই আনিতেন ও প্রস্তুতকারকগণকে বিশেষভাবে উৎসাহ দিতেন। এই জন্য তাঁহাকে কত যে লোক্সান দিতে হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই।’(কালীপ্রসন্ন সেন: কর্ম্মযোগী কালীপ্রসন্ন: বরিশাল ১৯২৮ পৃ: ৭৪-৭৬)

এই ন্যাশনাল এজেন্সি খ্যাত কালীপ্রসন্ন ঘোষ বি এ পাশ করেন ১৮৮৪ খিস্টাব্দে। সে বছরই অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়। অশ্বিনী কুমার দত্ত কালীপ্রসন্ন ঘোষকে তাঁর বিদ্যালয়ে যোগদান করতে বললে তিনি তা সানন্দে প্রহণ করেন। পরে তিনি এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই শেষ নয়, কালীপ্রসন্ন ঘোষের ওপর অশ্বিনীকুমার দত্তের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। তাই কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নে কালীপ্রসন্ন ঘোষকে গুরুত্ব ও দায়িত্বপূর্ণ ভার দেয়া হয়। তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন পরম নিষ্ঠার সাথে। বি এ পাশ কালীপ্রসন্ন ঘোষ ব্রজমোহন কলেজের উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন বেশ কিছু দিন। কলেজই ছিল তাঁর কাছে পবিত্রভূমি। আজও তাঁর এই সেবার স্বীকৃতি বহন করছে ব্রজমোহন কলেজের প্রথম দ্বারে অবস্থিত কালীপ্রসন্ন হল, সংক্ষেপে কে. পি. হল।   

আগেই বলা হয়েছে বরিশাল সম্বন্ধে একটি প্রতিষ্ঠিত আপ্তবাক্য ‘আজ বরিশাল যাহা ভাবে ভারতবর্ষ তাহা ভাবে এক দিন পর’। এই মন্তব্য থেকে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবনায় বরিশালের অগ্রগামিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৫৮ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের বরিশালকে অনেকে ঐতিহাসিক নব-জাগরণের কাল বলে অভিহিত করেছেন। এই সময়কে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সবদিক দিয়ে বরিশালের বিকশিত হবার সময় বলে বিবেচনা করেন ইতিহাসবিদরা। শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্থা-সংগঠন, রাজনীতি-সমাজনীতি এই সব দিক দিয়েই বরিশাল গড়ে উঠেছে বা বরিশালকে গড়ে তোলা হয়েছে এই সময়। তখনকার বরিশালে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যা ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। এ সময়ে বরিশালে অনেকগুলো সংগঠন-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে বরিশালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে মূলত অশ্বিনীকুমার দত্তর আগ্রহ ও উৎসাহে নতুন করে গঠিত হয় ‘বরিশাল জনসাধারণ সভা’। প্রথমে এর সভাপতি ও সম্পাদক হন যথাক্রমে প্যারীলাল রায় এবং রাখালচন্দ্র রায় চৌধুরী। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন এর সদস্য। রাখালচন্দ্রের পর এই সংগঠনের দায়িত্ব নেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। এই সংগঠন বরিশালে ব্যাপক জনমত সংগঠনে সার্থক হয়। বরিশাল শহরের বাইরেও গঠিত হয় এই সংগঠনের কয়েকটি শাখা। এই সভার পক্ষ থেকে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী কাজ করা হতো; তথ্যাদি সংগ্রহ করা হতো।

অশ্বিনীকুমার দত্ত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হন ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে। তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। তিনি ছাত্রদের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য ব্রাহ্মসমাজে নানা বিষয়ে বক্তৃতা করতেন। তাঁর বক্তৃতা শুনতে প্রচুর লোক সমাগম হতো। এরপরই অশ্বিনীকুমার দত্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়।
 
এর আগে বরিশাল শহরে একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয় বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে (২৩ ডিসেম্বর)। তবে বিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৩০ থেকে। 

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বরিশাল জিলা স্কুলের ছাত্রসংখ্যা এত বেশি হয় যে আর স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। বিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধির দাবি উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যদি কোনো উৎসাহী ব্যক্তি পৃথক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন তা হলে সবরকম সরকারি ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা হবে। সে সময়ে অশ্বিনীকুমার দত্ত এগিয়ে এসে ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে সমাজ, দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ জাগাতে ব্রজমোহন বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে অশ্বিনীকুমার দত্ত ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’র আদর্শ গ্রহণ ও প্রচারে উদ্যোগী হন। 

অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশাল এসে আইন ব্যবসা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর কর্মকা- বরিশালে ব্যাপক জাগরণের সৃষ্টি হয়। বলা যায়, ১৮৮০ থেকে ১৯০৫ সময়টা বরিশালের নতুন করে গড়ে ওঠার সময়। আর অশ্বিনীকুমার দত্ত এর একচ্ছত্র নেতা। তাই অশ্বিনীকুমার দত্তকে বলা হয় আধুনিক বরিশালের রূপকার। কেবল শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, অর্থনৈতিক সব দিক দিয়েই বরিশাল তখন অগ্রসরমান। বলা যায় সবক্ষেত্রে ভারতবর্ষে কলকাতার পরই ছিল বরিশালের স্থান। 

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগেই বরিশালে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। সেই সময়ে বরিশালের আইন ব্যবসার সুনাম ছিল ভারতজোড়া। আইনজীবীরাই সামাজিক অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। সরকারি কর্মচারীদের কাজের সমালোচনা করতেন; রাজনৈতিক দাবি নিয়েও এগিয়ে আসতেন। এরই সূত্র ধরে বরিশালের আইনজীবী এবং জমিদাররা একত্রিত হয়ে গঠন করেন ‘বরিশাল পিপলস্ এসোসিয়েশন’ নামে সংগঠন। অন্যদিকে কোনোকোনো জমিদার তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠন করেন ‘ল্যান্ড হোল্ডার্স এসোসিয়েশন’। 

এই সময় বরিশালে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালে মিউনিসিপ্যাল বোর্ড গঠিত হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত, দ্বীনবন্ধু সেন, দ্বারকানাথ দত্ত প্রমুখ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বদেশ তথা মানব সেবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বরিশালের তখনকার জনহিতকর কাজে অশ্বিনীকুমার দত্তর অবদান প্রসঙ্গে হীরালাল দাশগুপ্ত’র মন্তব্য: 

‘স্বদেশের হিতসাধন ছিল তাঁর লক্ষ্য। এজন্য দেশের সর্বপ্রকার মঙ্গলজনক অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি ও শিক্ষা প্রভৃতি সব দিক দিয়ে যাতে বরিশাল উন্নত হয়, তার জন্য তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করতেন। কোনো ব্যাপারেই যেন বরিশাল অন্য জেলার পশ্চাতে থাকে তিনি তা সহ্য করতে পারতেন না। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে নিরক্ষর কৃষকদের দুয়ারে দুয়ারে কংগ্রেসের বার্তা প্রচার করতেন। ঢাকঢোল বাজিয়ে যেমন মেলা বসানো হয়, সেই প্রণালীতেই তিনি সভায় লোক সমবেত করতেন। প্রথমে তাঁরই রচিত ‘ভারতগীতি’ থেকে জাতীয় ভাবোদ্দীপক একটি গান গাওয়া হতো। তারপরে তিনি বক্তৃতা করতেন।’(হীরালাল দাশগুপ্ত: স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল: সাহিত্য সংসদ, কলকাতা: দ্বিতীয় সংস্কারণ ১৯৯৭: পৃ: ৩৩)।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘বরিশাল জনসাধারণ সভা’ কংগ্রেসের আদর্শে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেয়। বরিশাল থেকে প্রতিবছর জাতীয় মহাসভায় প্রতিনিধি পাঠানো হতো। নগরবাসীর কাছ থেকে এক টাকা করে চাঁদা তুলে এই প্রতিনিধি দলের যাতায়াতের খরচ নির্বাহ করা হতো। 

বরিশাল শহর কিংবা শহরের বাইরে অশ্বিনীকুমার দত্তের বক্তৃতার আগে একটি জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হতো। তখন এমন জাতীয় সংগীতের বড়ই অভাব ছিল। এই অভাব দূর করতে অশ্বিনীকুমার দত্ত সংগীত রচনায় হাত দেন। প্রকাশ করলেন ‘ভারতগীতি’ নামের গানের বই। বইয়ে লেখক হিসেবে নিজের নাম না দিয়ে লিখেছিলেন ‘জনৈক ভারতভৃত্য কর্তৃক রচিত’। জাতীয় সংগীতের এমন সংকলন বোধকরি বাঙলা সাহিত্যে এই-ই প্রথম। 

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে অশ্বিনীকুমার দত্ত ব্যবস্থাপক সভা গঠনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। ব্যবস্থাপক সভা গঠনের পক্ষে বরিশাল জেলা থেকে চল্লিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র নিয়ে অশ্বিনীকুমার দত্ত নিজে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজে জাতীয় মহাসভার অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এই বছরই তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। এর দশ বছর পর ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বেরারের রাজধানী অমরাবতীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশকে অশ্বিনীকুমার দত্ত ‘তিন দিনের তামাশা’ বলে সারা ভারতে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। তিনি যা বলতেন তা-ই করতেন। বিলাতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনে ভারতবর্ষব্যাপী বরিশালের যে খ্যাতি তাঁর মূলেও ছিল অশ্বিনীকুমার দত্তর কর্মপ্রয়াস। 

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বরিশাল সারা ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

‘১৯০৫ সাল ৭ আগস্ট বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক পুণ্য দিন। ওই দিন কলকাতা টাউন হলে আয়োজিত এক মহতী সভায় বাংলার সর্বশ্রেণীর বরেণ্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়ে বিপুল ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনির মধ্যে বিদেশি শাসকের নিকটে আবেদন-নিবেদনের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। ভিক্ষার ঝুলি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাঙালি সেদিন আত্মনির্ভর সংগ্রামের পথে প্রথম পদক্ষেপ রাখল। এই সভাক্ষেত্রে এবং দেশের শত শত পলী ও শহরের নেতৃবৃন্দের আবেগময়ী বক্তৃতায় দেশপ্রেমের দিব্য অনুভূতি ও আত্মত্যাগের প্রেরণা লাভ করল দেশবাসী। সেদিন থেকে বাঙালির মন্ত্র হলো ‘বন্দেমাতরম’-যে মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন বাংলার কবি ও সাধক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি মানসনেত্রে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশমাতৃকা ও দশভুজা জননীর অভিনব মূর্তি। 

টাউন হলের এই স্মরণীয় সভার উদ্যোক্তা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ দেশনায়ক ও চিন্তানায়কগণ।.... বন্দেমাতরম মন্ত্র¿সংগীতে অনুপ্রাণিত এই সভায় বিলাতি দ্রব্য বর্জন. স্বদেশি গ্রহণ এবং জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন টাউন হলে বক্তাদের কণ্ঠে যে বিক্ষোভ প্রকাশিত হলো, সে বিক্ষোভের আগুন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। শহরে বন্দরে পল্লীর পথে ঘাটে হাটে মাঠে একই ধ্বনি ‘বন্দেমাতরম।’(হীরালাল দাশগুপ্ত: স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল: সাহিত্য সংসদ কলকাতা: ২য় সং ১৯৯৭:  পৃ: ৩৯)

আগে থেকেই বরিশালে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্বে ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। অশ্বিনীকুমার দত্তর আহ্বানে সেদিন বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বিদেশী বর্জনের এক বিস্ময়কর সাড়া পড়ে গেল বরিশালে। এ বিষয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস প্রণেতা হিরালাল দাসগুপ্ত লিখেছেন:

‘বিলাতি কাপড় বস্তাবন্দি হলো ব্যবসায়ীদের গুদামে। বিলাতি কাপড় ও নুন বিক্রয় বন্ধ হলো শুধু বরিশালে নয়, জিলার দূরতম প্রান্তের বাজার, হাট ও বন্দর থেকেও জিনিসগুলি অদৃশ্য হলো ভোজবাজির মতো। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে দোকানে দোকানে ঘুরে একখ- বিলাতি কাপড় কিনতে পারলেন না। ‘অশ্বিনীবাবুর হুকুম ছাড়া বেচতে পারব না’-এই ছিল ব্যবসায়ীদের জবাব। নূতন বাজার খোলা হল সরকারি অর্থব্যয়ে। সেখানে সংস্কারের অনুগৃহীত কিছু কিছু লোক বিক্রেতা হিসাবে পসরাও সাজাল। কিন্তু ক্রেতার অভাবে বাজার বন্ধ হয়ে গেল। নদীপথে মাঝিদের মুখে, শহরে গাড়োয়ানদের মুখে, পল্লীতে পল্লীতে জনগণের মুখে ধ্বনিত হতে লাগল একটি মন-মাতানো শক্তিসঞ্চারী মোহমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’। বরিশালে বয়কটের সাফল্যে পলিগ্রাম বহু দিনের স্তব্ধ তাঁতিদের ঘরে নূতন করে তাঁতের ঠক্ঠকানির শব্দ আতঙ্কিত করেছিল সরকারকে। পূর্ববঙ্গ ও আসামের নূতন ছোটলাট ব্যামফাইলড্ ফুলার শাসনদ- আস্ফালন করলেন। বিলাতে পার্লিয়ামেন্ট সভায় ‘বরিশাল’ একটা সমস্যা নামে অভিহিত হল।’(প্রাগুক্ত পৃ: ৪১)

কেবল আন্দোলনেই অশ্বিনীকুমার দত্ত সন্তুষ্ট হলেন না। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গড়ে তুললেন নতুন সংগঠন ‘বরিশাল স্বদেশবান্ধব সমিতি’। বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিলেন স্বদেশী আন্দোলন; গড়ে তুললেন স্বদেশ বান্ধব সমিতির শাখা। ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠল দেড়শতাধিক শাখা। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে চলল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কুটির শিল্পের পুনরুদ্ধার; সালিশির মাধ্যমে বিবাদ নিষ্পত্তির মতো নানা কার্যক্রম। এই কাজে অশ্বিনীকুমার দত্তকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কালীশচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ, রজনীকান্ত গুহ, কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। 

স্বদেশবান্ধব সমিতির উদ্যোগে সারা বরিশাল জেলাব্যাপী চলল স্বদেশী আন্দোলনের প্রচার। এইসব প্রচার সভা-সমাবেশের অংশ হয়ে উঠল স্বদেশী গান। এর উদ্যোক্তা অশ্বিনীকুমার দত্ত। অশ্বিনীকুমার দত্তর বক্তৃতার পূর্বে ও পরে পরিবেশিত হতো স্বদেশী গান। এইসব গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রজনীকান্ত সেনের: 

        মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
            মাথায় তুলে নেরে ভাই;
        দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
            তার বেশি আর সাধ্য নাই। 
এবং 
        তাই ভালো, মোদের 
            মায়ের ঘরের শুধু ভাত,
        মায়ের ঘরের ঘি-সৈন্ধব,
            মার বাগানের কলার পাত।
ইত্যাদি গান।

আগামী কাল পড়ুন পরবর্তী অংশ-