কলেজের নামকরণ নিয়ে আস্তিক-নাস্তিকের দ্বন্দ্ব ঘোচাতে হবে

কলেজের নামকরণ নিয়ে আস্তিক-নাস্তিকের দ্বন্দ্ব ঘোচাতে হবে

শনিবার (১৮ জুলাই) দেখলাম গণস্বাক্ষর করে ফিরে পেতে চায় সরকারি বরিশাল কলেজ। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, সরকরি বরিশাল কলেজের নাম কি পরিবর্তন হয়েছে? যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে ফিরে পেতে চাওয়ার ওই আহ্বান কেন? আমরা যতদূর জানি, সরকারি বরিশাল কলেজের নামের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাবনা নিয়েছে সরকার। যে প্রস্তাবনাটি গত ফেব্রুয়ারি মাসের। সেই প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। হঠাৎ ওই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে নেমেছেন সরকারি বরিশাল কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। মজার ব্যাপার হলো সরকারি ওই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে সামনের সারিতে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের নেকেই বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা। যদিও বর্তমানে আর আন্দোলনটি সেখানে নেই। এটি এখন ধর্মীয় চিন্তা থেকেই বেশি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকরি বরিশাল কলেজের নাম অপরিবর্তিত রাখার আন্দোলনে সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ ইসলামী দলগুলোও যুক্ত হয়েছে।

ইসলামী দল যুক্ত হওয়ায় দোষের কিছু নেই। একটি কলেজের নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান থাকতেই পারে। ভিন্ন মত পথের মানুষ থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে অন্য মতের মানুষদের ধর্ম দিয়ে আঘাত করতে হবে? আবার যারা ইসলাম ধর্মের আছেন তাদের বার বার প্রমাণ দিতে হবে আস্তিক না নাস্তিক? এটা কেমন কথা? আপনি একটি সমাবেশে দাঁড়িয়েই বলে দেবেন অশি^নী কুমারের নাম যুক্ত করতে যারা চায় তারা নাস্তিক। ইসলাম কি আপনাকে সেই অধিকার দিয়েছে? আপনি কার কাছে পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে আস্তিক ঘোষণা করছেন? আমি কিংবা আমরা যে আস্তিক নয়, তার প্রমাণ আপনাকে দিতে হবে কেন? এখন যে কোন আন্দোলনে নামার আগে আপনাদের কাছে গিয়ে আস্তিক নাস্তিকের পরীক্ষা দিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে? ইসলাম ধর্মের নামে এসব ভাতাবাজী ছাড়–ন। আপনি যেমন নামাজ রোজা করেন, তেমনি আমি এবং আমরাও ইসলামের হুকুমত মেনেই তাই করি। তাহলে আপনার কাছে আমার পরীক্ষা দিতে হবে কেন? সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকারের চিন্তা বাদ দিন। ধর্মীয় চিন্তার বাইরে গিয়ে বিশ্বমানবতার কথা ভাবুন। ইসলাম তো বিশ্বমানবতার জয়গাণের কথা বলে। আপনারা কেন সংকির্ণতার পরিচয় দিচ্ছেন?

সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন হওয়া না হওয়া সরকারের এখতিয়ার। তবে যারা বলছেন বরিশালের নাম মুছে দিয়ে সেটা করা হবে। তারা মূলত বিভ্রান্তি ছড়াতেই এমন কথা বলছেন। তেমনটা হলে আমরাও আপত্তি দেবো। যতদূর জানি, যারা অশি^নী কুমারের বাসভবনে থাকা সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তনের কথা বলছেন, তারা কিন্তু কেউই বরিশালকে বাদ দিয়ে অশ্বিনী কুমার কলেজ হোক এমন কথা বলেননি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বরিশাল সরকারি অশ্বিনী কুমার কলেজ বিংবা যে কোনভাবে অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করা হোক। কিন্তু আন্দোলনের নামে বারবার অশ্বিনী কুমারকে যদি ধর্ম দিয়ে বিচার করা হয় সেটা অত্যন্ত দুঃখের। তিনি মুসলিম হলে সমস্যা ছিল না। এমনকি যারা যারা অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করার পক্ষে তারা নাস্তিক এমন মন্তব্য করতেও ছাড়ছেন না। আমাদের কষ্টের বিষয় হচ্ছে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল চিন্তার রাজনৈতিক দলকে সামনে রেখে ওই চেষ্টা চলছে। কলেজের নাম রাখা না রাখা নিয়ে বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার অশুভ চেষ্টা করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত হতাসাব্যঞ্জক।

বর্তমানে সরকরি বরিশাল কলেজের নাম নিয়ে যে বক্তব্যগুলো দেওয়া হচ্ছে তা শুনে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল। ওই সময় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বসাভবনটি ব্রজমোহন কলেজের কসমোপলিটন (সব ধর্মের শিক্ষার্থীর আবাসস্থল) হল ছিল। যেখানে আওয়ামী লীগের বর্তমান জাতীয় নেতা সাবেক ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র তোফায়েল আহম্মেদ থাকতেন। ছিলেন সেই সময়ের অন্যান্য ধর্মের শিক্ষার্থীরাও। তখন তাদের মধ্যে অশ্বিনী কুমার নিয়ে কোন ধর্মীয় বিরোধ ছিল না। তাহলে আজকে কেন করা হচ্ছে? কার স্বার্থে করা হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। ৪৭-এর দেশ ভাগের পরও স্বদেশী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক চিন্তারই ফসল ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরই মাত্র আড়াই বছরের মাথায় আমাদের দেখতে হলো ১৯৭৫। এরপর প্রগতির পথে না হেঁটে আমরা সাপ্রদায়িকতার দিকেই পা বাড়াতে থাকি। তাহলে বলবো ব্রিটিশ, পাকিস্তান শাসন আমলই ভালো ছিল? সরকারি বরিশাল কলেজে নিয়ে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে তা দেখে সেটাই মনে হচ্ছে।

ঐতিহ্যবাহি সরকারি বরিশাল কলেজের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। বরিশালের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। করোনার সময় বরিশালের ঐতিহ্য নিয়ে টানাটানি মানা হবে না। সরকারি বরিশাল কলেজের ছাত্রদের সার্টিফিকেট কি হবে? যারা বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করতে চান তারা নাস্তিক। এসব অবান্তর কথা যারা বলছেন তারা সব বিষয় খোঁজ নিয়ে তারপর কথা বলুন। একই সঙ্গে যুক্তিদিয়ে বিষয়টি উপস্থাপন করুন। দেশে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়টি সবার ভাবতে হবে। আজকে আমরা সংখ্যাগুরু হওয়ায় আমাদের দায়িত্ব কিন্তু বেশি। যেমন মিয়ানমারে অবশ্যই সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। তারা যেভাবে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে মুসলমানেদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, নির্যাতন করেছে সেটা কোনভাবেই সভ্য মানুষের কাজ নয়। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে না দেই। সেদিকে সরকারসহ প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব নিতে হবে।

পুনরায় বলতে চাই, অশ্বিনী কুমারের নাম বরিশালের সঙ্গে যুক্ত হলে কোনভাবেই এর মর্যাদা কিংবা সম্মান হানি হবে না বরং বাড়বে। তাই বরিশাল সরকারি অশ্বিনী কুমার কলেজ হলে কি বরিশালের নাম মুছে যাওয়ার সুযোগ আছে? অবশ্যই বলবো নাই। কারণ বরিশালের সঙ্গে অশ্বিনীর নাম যুক্ত হলে আমরা সমৃদ্ধই হবো। তাই কেবল বিরোধিতার জন্য কথা না বলে যুক্তি দিয়ে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের দেওয়া প্রস্তাবনার সঙ্গে থাকার আহ্বান জানাই। সেই সঙ্গে ধর্মীয় বিবেচনায় নয়, আত্ম পরিচয় ও কাজের স্বীকৃতি দিয়ে যেন আমরা অশ্বিনী কুমারকে সম্মান করি। কোনভাবেই যেন আমাদের সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা না হয়।

সরকারি বরিশাল কলেজের নামকরণ নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটার যৌক্তিক সমাধন করুন। এই নগরে আমরা যারা বাস করছি তারা সবাই কোন না কোনভাবে একজন অন্যজনের সহযোগী। এই সুন্দর পরিবেশ কোনভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক হবে না। আসুন, আস্তিক-নাস্তিকের তকমা দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করে সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসি।