কীর্তনখোলার পাড়ে বশিরের সিঙাড়ার হাট

কীর্তনখোলার পাড়ে বশিরের সিঙাড়ার হাট

বরিশাল ত্রিশগোডাউন সংলগ্ন বধ্যভূমির কোল ঘেঁসে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য টানে ভ্রমন পিপসুদের। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের ভীড় লেগে থাকে। দুপুর-সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত কীর্তনখোলার সঙ্গে যুক্ত থাকে সিঙাড়ার হাট। বশিরের সিঙাড়ার হাটের ভীড় অন্য মাত্রা যোগ করেছে।

দুপুর থেকে রাত অব্দি বশিরের সিঙাড়ার হাটে ক্রেতাদের ভীড় লেগেই থাকে। চলে আসা-যাওয়ার খেলা। তার সঙ্গে সিঙাড়ার স্বাদ গ্রহণ। দুপুর থেকে বিকেল গড়াতেই নদীর পাড়ে শ’খানেক চেয়ার পাতা হয়ে যায়। তাতেই বসে ভ্রমণ পিপাষুদের চলে রিন্তর আড্ডা। শুধু কি আড্ড? প্রত্যেকের তাতে বশিরের সিঙাড়া না থাকলে সেই আড্ডা জমে ওঠে না।

বশিরের সুস্বাদু এই সিঙাড়ার স্বাদ গ্রহণ করতে হলে একটু ঝক্কি পোহাতে হয়। তাতেও ক্রেতাদের কোন কষ্ট নেই। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে সিঙাড়া কেনার জন্য। ১০, ২০ কিংবা ৩০টি সিঙাড়া নিয়ে বসে পড়েন চেয়ারে। কেউ কেউ আবার কীর্তনখোলার তীরে পল্টুনে বসে পানিতে পা দুলিয়ে দুলিয়ে সিঙাড়া খেয়ে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠে।

বশিরের জনপ্রিয় সিঙাড়া খেতে ক্রেতাদের অপেক্ষা, লাইনে দাঁড়িয়ে সিঙাড়া প্রাপ্তির আনন্দ দেখে যে অভিভূত না হয়ে উপায় নাই। তখনই মনের অজান্তে লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। দুই-চারবার এএমন দৃশ্য দেখে পাঠকদের জন্য এই সুস্বাদু সিঙাড়া হাটের গল্প জানাতেই আমাদের উদ্যোগ। বশিরের নতুন উদ্যোগকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা। 

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

বশিরকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে কয়েকবার কীর্তনখোলার তীরে বশিরের সিঙাড়ার হাটে যাই। কিন্তু ভীড়ের কারণে সেভাবে কথা বলা হয়ে ওঠে না। একটু বুঝে শুনেই এক দুপুরে হাজির হলাম কীর্তনখোলা সংলগ্ন বশিরের সিঙাড়া হাটে। ছোট পিভিসি ব্যানারে লেখা বশির সিঙাড়া পয়েন্ট। দোকানে ঢুকেই দেখি বড়পরিসরে সিঙাড়া তৈরির উপকরণ। কিন্তু তখন সেখানে বশির নেই। বশিরের বাবা জানান, বশির বাসায়। বশিরের সঙ্গে কথা বলবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তার বাবা বললেন, ডেকে দিচ্ছি। আমরা অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণের মধ্যে বশির হাজির। কুশল বিনিময়ের পার সিঙাড়ার গল্প শুনতে চাই।

মিষ্টি একটি হসি দিয়ে বশির বলে চলল তাঁর সিঙাড়ার আদ্যপান্ত। তার সঙ্গে উঠে আসলো তার জীবনের ছোট্ট ছোট্ট গল্প। বরিশালের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্ট্রিট বাইকার’ গ্রুপের সঙ্গে পটুয়াখালী ভ্রমণে যায় বশির। পটুয়াখালী পৌর শহরে সিঙাড়া পয়েন্টে তারা সিঙাড়া খায়। ওই সিঙাড়া বশিরকে আকৃষ্ট করে। মনে মনে জাল বোনা শুরু করে বশির। ভালো সিঙাড়া তৈরি এবং তা ক্রেতাপ্রিয় করার তাড়ণা শুরু হয় তখন থেকেই।

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

বশিরের ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিতে কাজ করে স্ট্রিট বাইকের সদ্যসরা। তাদের আবেদন ছিল ‘বশির ভাই সিঙাড়া বানিয়ে দাও আমাদের’। কোথায় বসে বানাবে, কেমন করে বানাবে, কারা কিনবে এমন চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে থাকে। তখন তারা কীর্তনখোলার তীরে যেখানে বশিরের সিঙাড়ার হাট বসেছে সেখনের ঘরটি আগেই ছিল। এই ঘরটিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে যায় সিঙাড়া তৈরির পরিকল্পনা। খুব বেশি অপেক্ষা না করেই সিঙাড়া তৈরির টুকটাক প্রণালী জেনে উপাদান নিয়ে শুরু করে দেয় সিঙাড়া বানানো। প্রথম দিকে সিঙাড়ার ভাজও করতে জানতো না বশির। দৃঢ়তা থাকায় সিঙাড়ার ভাজ আয়ত্বে আনতে বেশি দিন সময় লাগেনি। এখন সে দক্ষ সিঙাড়া তৈরির কারিগর। কেবল তাই নয়, সারা দেশেই তো সিঙাড়া আছে। অনেকেই তৈরি করে। বশির তাঁর সিঙাড়ায় বিশেষত্ব আনার চেষ্টা করতে থাকে। সেই চিন্তা থেকেই সিঙাড়ার স্বাদও পরির্বতন হয়। এই স্বাদ গ্রহণের জন্য এখন ক্রেতার ভীড় সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয় বশিরকে। এটা এখন তার অন্যতম তৃপ্তি বলে জানান বশির। বশির তার সিঙিড়ার গল্প বলতে যতটুক আগ্রহী তার চেয়ে আমি আর সহকর্মী সুকান্ত একটু বেশি আগ্রহী ছিলাম।

 


সিঙাড়ার গল্পের ফঁকে জানতে চাইলাম সিঙাড়া হাটের আগের যাত্রা। বলে চললেন বশির। ২০০৭ সালে ইলেক্ট্রিক্যাল বিভাগে ভকেশনালে মাধ্যমিক দিয়েছিলেন বশির। এরপর আর এগোয়নি ওই পথে। মাঝে অটো ব্যবসা ও বিভিন্ন কর্ম করেছেন তিনি। পরিবারে পাচঁ সদস্যের এখন একই কর্ম সিঙাড়া তৈরি। এর সঙ্গে যুক্ত আছে আরো চার সদস্য। এখন নান্দনিক সিঙাড়া হাটের সঙ্গে নয়জন সদস্য কর্মযজ্ঞ করে চলেছেন প্রতিদিন। মজার ব্যাপার হলো সিঙাড়া তৈরির সঙ্গে যুক্তদের বেশিরভাগ পড়শোনা করছেন। কর্মীদের পড়াশুনায় উৎসাহও যোগাচ্ছেন বশির। তাই সিঙাড়া হাটের কর্মীরা আনন্দের সঙ্গেই কাজ করে চলেছেন। বশিরের চাওয়া একদিন এই কর্মীরা যেন স্বাবলম্বী হয়। 

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-
সিঙাড়া তৈরি ও বিক্রি করে পরিচিতি পাওয়া বশির কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেনি। তাঁর এই অবস্থানে আসার পিছনে অনেক মানুষের সহযোগিতাও আছে। এখনো অনেকে উৎসহ দিয়ে চলেছেন। বশির তাদের কাছে কৃতজ্ঞ বলে জানান। বশিরের সঙ্গে যখন গল্প চলছে নদীর তীরে তখন সিঙাড়ার হাট পুরো জমে উঠেছে। অনেকে লাইন ধরে সিঙাড়া ক্রয় করে নিচ্ছেন। সিঙাড়া ক্রেতারে মধ্যে বেশিরভাগ তরুণ-তরুনী। তারা চেয়ার টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছেন আর সিঙাড়ার স্বাদ গ্রহণ করছেন। কেউ কেউ আবার নদীর পনিতে পা ভিজিয়ে মনের আনন্দে গল্প করছেন আর সিঙাড়া খাচ্ছেন।

 

কীর্তনখোলা তীরের এমন দৃশ্য দেখে আমি এবং আমার সহকর্মী অভিভূত হয়ে গেছি। সঙ্গে আমরাও সিঙাড়ার স্বাদ নিতে ভুল করিনি। কথায় গল্পে অনেক সময় চলে যায়। জানতে পারি বশিরের দিন কেটে যায় সিঙাড়া নিয়ে। প্রতি শুক্রবার ক্রেতাদের ভীড়, আসাযাওয়া দেখে বশিরের নাকি ঈদ আনন্দ বলে মনে হয়। পরিবার নিয়েও অনেকে সিঙাড়া খেতে আসেন বশিরের সিঙাড়া হাটে। আমি সিঙাড়ার হাট বললেও এটার নাম সিঙাড়ার হাট ছিল না। আমি বশির ভাইর কাছে অনুরোধ জানাই, আজ থেকে এটাকে ‘সিঙাড়ার হাট’ নাম দেই! জবাবটা পাই বশিরের প্রাণ খোলা হসিতে। আজ থেকে কীর্তনখোলার তীরে বশিরের সিঙাড়ার হাট নামে পরিচিতি পাক।

বিদায় নিয়ে আসার পথে ভাবছি বশিরকে উদ্যোক্তা বললে ভালো হয়। নতুন উদ্যোক্তা বশির তাতে সম্মানিত হবে। বশিরের মধ্যে যুগ উপযোগী ব্যবসায়িক ভাবনা আছে, আছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রবল চেষ্টা।  পাঠক, বশিরের সিঙাড়া হাটে না গিয়ে থাকলে আজই চলে আসুন, কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে বশিরের সিঙাড়ার হাটে।

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-




তন্ময় নাথ / ভোরের আলো/ এস এইচ ও