কুয়াকাটা সৈকতে বেরীবাঁধ: প্রায় ১১০০ কোটি টাকার প্রকল্পে চরম ফাঁকি

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বেরীবাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ধসে গেছে অধিকাংশ এলাকা। প্রায় ১১০০ কোটি টাকার প্রকল্পে চরম অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে ভয়বহ অবস্থা হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমূদ্র সৈকত এবং লতাচাপলী ইউনিয়ন রক্ষায় উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ কাজ।
‘মাটির পরিবর্তে বালু ও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার এবং মাটির বাঁধে লেয়ার বাই লেয়ার কমপ্যাকশন’ না করায় এই নির্মাণাধীন বাঁধ ধ্বসে পড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বাঁধ ধ্বসে পড়ায় এর দীর্ঘ মেয়াদী সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। তবে বাঁধ নির্মাণকাজে কাজে কোন অনিয়ম হয়নি এবং কেবল ভারী বর্ষার কারণেই নির্মাণাধীন বাঁধ ধ্বসে পড়েছে বলে দাবি প্রকল্পের তদারককারী প্রকৌশলী মজিবর রহমানের।
ঝড়-জলোচ্ছাস এবং জোয়ারের পানির চাপ থেকে উপকূলীয় ৩ জেলার মানুষের জানমাল রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প-১ এর আওতায় (আইডিএ ক্রেডিট নং-৬২৮০ বিডি) ১ হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সমূদ্র সৈকত কুয়াকাটা, কলাপাড়ার ডালবুগঞ্জ, গলাচিপা, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা ও ভান্ডারিয়ায় ৫৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ, ১৪৯ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, ৯ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার বাঁধ স্লোপ প্রটেকশন, ১৫৪ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার খাল খনন, ৫১টি নতুন স্লুইচ নির্মাণ, ৬টি স্লুইচ মেরামত, ৫১টি ইনলেট (ছোট স্লুইচ) নির্মাণ এবং ৩০টি ইনলেট মেরামতের কাজ পায় চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চংকিং ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন কোম্পানী (CICO)।
এই প্রকল্পের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কুয়াকাটা সমূদ্র সৈকত রক্ষা (পোল্ডার নম্বর ৪৮)। এই পোল্ডারের আওতায় রয়েছে কুয়াকাটা পৌরসভা ও লতাচাপলী সৈকতে বহমান ৬ মিটার উঁচু ১৭ কিলোমিটার বেরী বাঁধ দেড় মিটার উঁচুকরণ, ৯টি স্লুইচ নির্মাণ ও ২টি স্লুাইচ মেরামত এবং সিসি ব্লক দিয়ে সৈকতের ৪ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার বাঁধের প্রকেটটিভ ওয়ার্ক। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু করে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত ৪৮ নম্বর পোল্ডারের মাত্র ৬০ ভাগ কাজ যেনতেনভাবে সম্পন্ন করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে ঝড়-জলোচ্ছাস এবং জোয়ারের পানির চাপ থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমূদ্র সৈকত এবং লতাচাপলী ইউনিয়ন রক্ষায় বিশ^ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করছে সরকার। বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই কুয়াকাটা সৈকতের কম্পিউটার সেন্টার থেকে লেবুর বন পর্যন্ত বেরী বাঁধের বিভিন্ন স্থান ধ্বসে পড়েছে। বৃষ্টিার পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে বেরীবাঁধ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বেরী বাঁধ নির্মাণ কাজে শুভঙ্করের ফাঁকি দিচ্ছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। নিয়মানুযায়ী এটেল মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও বালু দিয়ে তার উপর মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে তারা। প্রতি সোয়া ৩ফিট উঁচু এটেল মাটি ফেলে রোলার দিয়ে কমপ্যাকশন করে ৭ দিন পর আবার নতুন মাটি দিয়ে কমপ্যাকশন করে বাঁধ নির্মাণের কথা। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সৈকতের বালু দিয়ে তার উপর মাটির আস্তর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। ফলে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে বাঁধ।
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব শরীফ বলেন, নকশা অনুযায়ী যে ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করার কথা ঠিকাদার সেগুলো না দিয়ে সৈকতের বালু এবং সংলগ্ন খালে জমে থাকা পলি মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করছে। তারা মাটি কমপ্যাকশন না করেই বাঁধ উচু করছে। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতে বালু ধুয়ে যাচ্ছে। ধ্বসে পড়েছে বাঁধ। বেরীবাঁধ ধ্বসে পড়লে উপকূলের মানুষের জানমাল হুমকীতে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন শিল্প। বিফলে যাবে প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত কাজ শেষ করেনি। এর আগেই সৈকত লাগোয়া নির্মিত বেরীবাঁধের বিভিন্ন স্থান ধ্বসে পড়েছে। এই বাঁধ দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন দাবি করেছেন।
এ বিষয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেজ-১ এর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন প্রকৌশলী মজিবর রহমান বলেন, বাঁধ নির্মাণে ৩০ ভাগ বালু ব্যবহার করা যাবে। এতে কোন অনিয়ম হয়নি। অতি বর্ষণে বাঁধের বিভিন্ন স্থান ধ্বসে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার বলেন, বেরীবাঁধ নির্মাণে ঠিকাদার কিছু বালু ব্যবহার করেছে এটা সত্য। নির্মিত বেরীবাঁধের যেসব অংশ ধ্বসে গেছে বা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে সেসব অংশ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রেকটিফিকেশন করে দেবে। প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন তিনি।