কেবল অবাক হয়ে শুনি

কেবল অবাক হয়ে শুনি

সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় বর্তমান সময়টা মোটেই ভালো যাচ্ছে না। এমন বিপরীত সময়ের যাতাকলে কেবল যে আমি একা বিষয়টা তেমন নয়। মূলত এখন ভালো নেই কেউ। বিশ্বব্যাপি এতো মানুষের মুত্যু, এতো অনিশ্চয়তা, এতো প্রতিকারহীনতা না, মোটেই ভালো লাগছে না আর মানুষ যে কিছুই করতে পারছে না এই নির্মম পরিহাসটা আর মানা যায় না। অথচ উপায়হীন। শুধু সকাল দুপুর রাত তিন বেলা একই ডোজ, একই ওষুধ ‘ঘরে থাকো’। ঘরে উৎপাত ‘সোজা হয়ে বসো, চেয়ারটা একটু সোজা করা যায় না? আরে বালিসটা কেউ ওভাবে মাথার নিচে দেয়? স্যান্ডেলটাও যায়গা মতো রাখতে পারো না? এখন তো বোঝ, দেখছো তো সংসারটা ক্যামনে চালাই’? আরো কতো শত, তার কয়টা বলা যায়। সবগুলো বলা যায়ও না। তবে কি প্রতিবাদ? না, মোটেই সেটার সময় এখন নয়। করোনা এবং ঘরোনা দুটোকে এক সঙ্গে সামাল দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। বর্তমান সময়টি মূলত সার্বিক বিবেচনায় নীরবে সময় পাড় করার। 

চেষ্টা চলছে সব রকম। বই, পত্রিকা, গান, নাটক। না, তার পরেও সময়ের পরিধি যেন শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে কোন কিছুর সঙ্গেই দিনমান থাকা সম্ভব নয়। মানুষ মূলত পরিবর্তনের সঙ্গে চলে চলেই সময় অতিক্রম করে। একঘেয়েমি বা নির্দিষ্ট বাধ্য বাধকতা তার পছন্দ নয় একেবারেই, সে যতই ভালো হোক। যতই সে প্রাজ্ঞ হোক অর্থ বিত্ত জ্ঞানে গানে কবিতায় নাটকে। নৃত্যের কথাটি করোনার এমন নৃত্যরত অবস্থায় না বললেই বোধ করি ভালো হয়। তবে অনুমান করি এই লকডাউনের সময় নৃত্যরতরা শরীর ও মনে সম্ভবত ভালোই আছে। নাটকের মঞ্চ একেবারেই শব্দ এবং আলোহীন। মহড়া বলে কোন শব্দের যেন কোন মানেই হচ্ছে না আপাতত। কবিতা পাঠ? সেও একা একা কতক্ষণ, কতক্ষণ ফেসবুক আর সেলফির মত্ততা? কতক্ষণ ভালো লাগে শধুমাত্র নিজের প্রচার? পত্রিকায় চোখ পড়লেই অজস্র মৃত্যু আর গুমরানো কান্নার শব্দ। মানুষের মানবিক মূল্যবোধহীনতার প্রলম্বিত কাহিনী। 

আর ভালো লাগছে না। কারণ ভালো নেই আমরা বেশ কিছুদিন থেকেই। হাতেগোনা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং নাটক পাড়ার অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চলে গেছেন সীমাহীন দূরে, দৃষ্টির ওপারে। যারা ছিলেন এই শহর সংস্কৃতি কার্যক্রমের এক একটি মঙ্গল প্রদীপ। যাঁদের আলোয় আলোকিত ছিলো এই শহর, আলোতিক ছিলাম আমরা। যখন করোনা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত হয়ে ওঠেনি পৃথিবী তখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সকলের প্রিয় একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণিজন উদীচী বরিশাল নাটক এবং বরিশাল সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের প্রায় সকল ধারার পুরোধা ব্যক্তিত্ব শ্রী নিখিল সেন। তার মাত্র কিছু দিন পূর্বেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বরিশাল পঞ্চসিঁড়ি গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি খলিলুর রহমান ফারুক। তারপরেই চলে গেলেন বরিশাল উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন পদার্থ বিদ্যার অত্যন্ত গুণি শিক্ষক সাবের আহাম্মেদ। তার পরে একেবারেই সময় না দিয়ে চলে গেলেন ওই স্কুলেরই আরেকজন প্রাক্তন কারীগরির শিক্ষক। বরিশাল উদীচীর, বরিশাল নাটকের সাবেক সভাপতি শ্রী নারায়ন সাহা। 

সেই চরম হতাশা ও দুঃখের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই পৃথিবী জুড়ে নেমে এলো ভয়াল করোনার থাবা। অপ্রস্তুত মানুষ দিশেহারা হয়ে প্রাণ রক্ষার প্রয়োজনে আশ্রয় নিলো ঘরে। সারা পৃথিবী জুড়ে নেমে এলো শ্মশানের নিরবতা। চারিদিকে একই খবর মৃত্যু, মৃত্যু আর মৃত্যু। একেবারেই প্রতিকারহীন এই করোনা। লক্ষ লক্ষ মৃত্যুতেও যার ক্ষুধা মিটছে না। যেন করোনার ‘শ্মশান কিংকর দল দীর্ঘ নিশায় ভুখারি’। এমনি ভয়াল করোনা বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র দুই দিনের ব্যাবধানে আমাদের ছেড়ে অনন্তের পথে সবাইকে বিস্মিত করে চলে গেলেন দুই মুক্তিযোদ্ধা। মোখলেসুর রহমান ও কাওসার হোসেন। চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা গণসঙ্গীত শিল্পী আক্কাস হোসেন। চলে গেলেন বরিশাল নাটকের অত্যন্ত সফল মঞ্চ অভিনেতা খুরসিদ আলম রফিক। প্রায় একই সময়ে চলে গেলেন শিক্ষক নেতা ও শিশু সংগঠক মজিবুর রহমান। সব শেষে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন রাজনৈতিক সাংষ্কৃতিক সংগঠক শ্রী শান্তি দাস। 

এখন সর্বত্র করোনার বিস্তার, মৃত্যুভয় আমাদের অসংগঠিত হতে বাধ্য করেছে। এখন বেঁচে থাকার একটিই পথ দুরত্ব বজায় রাখা। যার পরিণামে আমাদের নিকটজনের এতো মৃত্যুর পরেও আমাদের শোক প্রকাশের কোন অবকাশ মেলেনি। কোনভাবেই সম্ভব হয়নি এই করোনা পরিস্থিতি অতিক্রম করে কোন শোক সভার আয়োজন করা। তবে নিকট অতীতে এদের মধ্য থেকে অন্তত তিনজনকে নিয়ে পত্রিকার পাতায় স্মৃতি তর্পন করেছেন আমাদরে আরেক প্রাজ্ঞজন অগ্রজ মুকুল দাস। 

তিনি তার স্মৃতি তর্পন শুরু করেছেন সব শেষে যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বাম রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার সাংস্কৃতিক সংগঠক শান্তি দাসকে নিয়ে। আর শেষে করেছেন সর্বপ্রথমে যিনি চলে গিয়েছিলোন আবৃত্তিকার, নাট্যনির্দেশক নজরুল অনুীলক খলিলুর রহমান ফারুককে নিয়ে। মাঝখানে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গণসঙ্গীত শিল্পী আক্কাস হোসন। এই তিনজনকে নিয়েই অসাধারণ স্মৃতি তর্পন করেছেন লেখক মুকুল দাস। অত্যন্ত প্রখড় স্মৃতির মানুষ এই লেখক। তার এই ব্যতিক্রম গুণের কথা খুব ভালো ভাবেই জানতেন শন্তি দা, ফারুক ভাই এবং আক্কাস ভাই। লেখকের তিনটি লেখাই মন দিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছি। কারণ আমরা জানি বিদায়ী এই তিনজন মানুষ-ই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দারুন যোগ্যতর মানুষ ছিলেন।

লেখক বয়সে কারো বড় কারো ক্ষেত্রে হয়তো ছেটো। সুতরাং সময় বিবেচনায় এই তিন হৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে তিনি লিখবেন সেটাই স্বাভাবিক। আমরা পড়বো এবং সমৃদ্ধ হবো। আক্কাস ভাইকে নিয়ে লেখাটা যখন পড়ছিলাম শুরুতেই হোঁচট খেলাম। বুঝতেই পারছিলাম না লেখাটার বিষয়বস্তু কি। আমার পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি যেন ঘুরে ঘুরে কোন খাবার খাওয়ার গল্প শুনছি। মনে হয়েছে অক্কাস ভাই কেবল ঘুরে ঘুরে গান প্রতিযোগিতার বিচারকার্যই করতেন আর শুধু খেতেন। আর সেই কাজের সর্ববিষয়ক সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতেন লেখক। এতো স্মৃতিপ্রখড় লেখক কেন এমন একটি অসংগতিপূর্ণ জায়গায় তার স্মৃতিটাকে আটকে দিলেন? ভালো বোঝা গেল না। কেন তার খুরধা কলম লিখে চললো না তার মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততার কথা।

লেখক তো জানতেন ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আক্কাস ভাইয়ের রাজপথের বীরগাথা। আবু আল সাইদ নান্টুর নেতৃত্বে ৬৯ এ যে প্রতিবাদী গণসঙ্গীত স্কোয়াড তৈরি হয়েছিলো। আপনি নাকি তার একজন সদস্যও ছিলেন? তাহলে সেই গর্বের বিষয়কে ছাপিয়ে কার বাড়ি কি খেয়ে রসনা তৃপ্ত করেছেন, এমন কথাগুলোর স্মরণমূল্য কি খুব বেশি? কেন আপনার লেখনিতে পেলাম না আক্কাস ভাইয়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ শহর সংস্কৃতির একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন? একটা সময় বয়স এবং পায়ের সমস্যার কারণে আক্কাস ভাই একটু নরম হয়ে এলেও কখনো সে কখনো পিছপা হননি, কোন সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উপস্থিত হতে। চেষ্টা করেছেন কথায়, কাজে প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাঁথা তুলে ধরতে। 

আমরা তো জানি, বার বার শুনেছি। সর্বশেষ সংস্কৃতিজন কাজল ঘোষ নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে আক্কাস ভাইয়ের অবস্থান এবং বীরত্বপূর্ণ কর্ম গুরুত্বের কথা। তিনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় কতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে এই কণ্ঠযোদ্ধা সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগোনার বনগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট কেন্দ্রের কর্মাধ্যক্ষ। যেখানে বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করে তিনি পাঠিয়ে দিতেন টাকি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধে তার এসব কর্মগাঁথা হারিয়ে যাবে?

৬৯ এ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা সড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে তিনি রাজপথে সোচ্চার হয়েছেন তার গান নিয়ে ‘আগরতলা সড়যন্ত্র মামলা রুজু হইয়াছে’। ৭০ এর ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে, রাস্তায় রাস্তায় নিরন্ন মানুষের সাহায্যের জন্য গেয়েছেন গান ‘ভিক্ষা দাও মা ভিক্ষা দাও’। এতোটাই মানবিক, এতোটাই দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ একজন মানুষ আক্কাস হোসেন। দারুনভাবে আশা করেছিলাম লেখকের প্রখর স্মৃতিশক্তি একজন মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধের এমন গর্বিত অধ্যায় যথার্থই উপস্থাপন করবেন। আমি লজ্জিত। তেমটা হলো না। 

খলিলুর রহমান ফারুক ভাইকে নিয়েও আপনি লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। পুনরায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। অত্যন্ত সাদাসিদা পরিশুদ্ধ স্বজ্জন মানুষ ছিলেন খলিলুর রহমান ফারুক ভাই। ভলো মানুষের যে যে গুণাবলী, আমরা আশা করি তার প্রায় সকল গুণাগুণ-ই ছিলো ফারুক ভাইয়ের মধ্যে। ছিলো নাটক ও আবৃত্তি বিষয়ে তীব্র বোধ ও সংবেদনশীলতা। অত্যন্ত মার্জিত রুচির সংস্কৃতিবান একজন মানুষ ফারুক ভাই, সদা হাস্যোজ্জল। বিশ্ব ফুটবলের একজন দারুন পাগল। ততোধিক পাগল ছিলেন তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাটক, গল্প, গান, কবিতার। তার এই অকৃত্রিম নজরুল প্রীতিকে কেউ কেউ একটু বাঁকা চোখে দেখতেন। এবং সুযোগ পেলেই বলতে চেষ্টা করতেন ‘উনি বোধ করি একটু প্রতিক্রিয়াশীল’। অর্থাৎ তেমন রবীন্দ্রঘেঁষা নন। অথচ একজন ফারুক ভাই কখনো কোনদিন বলেন নি, বলতে শুনিওনি ‘তোমরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটু বেশি করো’। না, এমন নেগেটিভ কোন কথার প্রয়োগ তার কাছ থেকে কখনো পাইনি। খুবই পরিশুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন ফারুক ভাই।

তার প্রকাশ তার পারিবারিক বলয়ের জীবনজাপনে আছে। তা না হলে নজরুলকে অমন করে বাঁধলেন কেমন করে মনের গভীরে? যার সৃষ্টির সকল ধারায় মানুষ, মানুষ এবং মানুষ। যিনি সাম্যের গান বাঁধেন তাকে সংকীর্ণ করে দেখার অর্থ, নিজেকে সংকীর্ণ শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা। জ্ঞানত আমরা তেমনটা হতে কেউই চাই না। এমন প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে দূরে রেখে আপনার লেখায় কেবল কতোগুলো নাম সংযুক্ত হয়েছে। এমনটা না করে সদা হাস্যোজ্জল সহজ সরল ফারুক ভাইকে, সংগঠক ফারুক ভাইকে, আবৃত্তিকার ফারুক ভাইকে, নজরুল অনুশীলক ফারুক ভাইকে আরো বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার সুযোগ নিতে পারতেন। আপনার জ্ঞানের গভীরতা জানি না কেন আপনাকে সে পথ দেখালো না।

লেখকের মুখেই শুনেছি তার বেশ কিছু বিখ্যাত লেখা আছে যা এখনো আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। সামনে পেলে পড়ে নেব নিশ্চয়ই। আপনাদের মতো দক্ষ লেখকরা আছেন বলেই আমরা মাঝে মধ্যে একটু আধটু কলম ধরতে সাহস করি। ভুল হয়। ভুল হয় অর্থে, শব্দে, গাঁথুনিতে, বানানে! অতঃপর আপনাদের স্মরণাপন্ন হলে সেগুলো আবার পূর্ণতা পায়। সুতরাং আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার এ দুঃসাহসকে যারা সচল রাখেন বা রেখেছেন তাদের অন্যতম তিন ‘ম’। মুরাদ আহম্মেদ, মিরণ, মুকুল দাস। এর বাইরে আরেকটি নাম শ্যামল সেন। আছেন আরো দুই একজন শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ যারা কষ্ট করে পড়ে ভুল ধরিয়ে দেন। সামনে যাবার পথ দেখান। কিন্তু কখনোই তারা কেউ আমায় বলেননি ‘শোন যখন লিখবে তখন খেয়াল রেখো কলমের থেকে তুমি যেন বড় হয়ে না যাও। বিষয়বস্তু যেন হারিয়ে না যায়। পাঠক যেন রাস্তায় ধরে জিজ্ঞেস না করে, ভাই আপনি আমের রচনাটি কি কাঁঠাল নিয়ে লিখেছেন’?

শন্তি দা আমাদের আপনজন। লেখকের স্বীয় ধ্যান ধারনায় সে ছিলো তার কমরেড, এমনটাই লেখা শেষে সম্মোধন করেছেন লেখক। প্রগতিবাদী রাজনীতিক, সম্পৃক্ত থেকেছেন শহরের সাংস্কৃতিক সকল কর্মে, সকল আন্দোলন সংগ্রামে। অন্যের নেতৃত্ব মেনেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভালো বক্তা, স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করতেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে শারীরিকভাবে একটু আধটু গতি হারালেও তার মনের জোর কমেনি কখনো। শেষ পর্যন্ত সম্পৃক্ত থেকেছেন আমাদের সকল কর্মে। তার চিকিৎসায় সার্বক্ষণিক পাশে ছিলো বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। বরিশাল সিটির মাননীয় মেয়র।

তাঁর মৃত্যু হঠাৎ ছিলো না। তার মৃত্যুর খবর বিনা মেঘে বজ্রপাত নয় মোটেই। যিনি এমনটা ভেবে লিখেছেন তার এই উপমা ব্যবহারের যথার্থতা মেলেনি। শান্তিদা মহা শান্তির পথে যেদিন পা বাড়ালেন সেই দিনগুলো বড় দুর্বিসহ ছিলো। করোনার করাল গ্রাস তখন বিধ্বংসী রূপ লাভ করেছিলো। দারুন টান অনুভব করেও অনেকেই কাছাকাছি আসতে পারেননি। তাঁর শেষ যাত্রায় শেষ কৃত্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমি যাদের চিনতে পেরেছিলাম তারা হলেন সংস্কৃতিজন সৈয়দ দুলাল, সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজল ঘোষ, সম্পাদক মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের বরিশাল বিভাগীয় সম্পাদক মারিফ বাপ্পি এবং খেরাঘর বরিশালের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ।

লেখক মুকুল দাসও শ্মশানমুখো হতে পারেননি। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, তাকে যারা লাল সালাম কমরেড বলে ঘরে বসে ছিলেন, তারা একবারো ভেবেছিলেন কি কমরেড শান্তি দাসও আপনাদের শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিলো শ্মশানে। শান্তি দাসের বিশ্বাস ছিলো সমাজতন্ত্রে। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও তার প্রয়োগ সে দেখে যেতে পারেননি। না শান্তি দা, আপনার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিশ্বসের কোন বাস্তব প্রয়োগ আজো পৃথিবীর কোথাও কার্যকর হয়নি। না, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সার্বজনীন রূপ লাভ করেনি, খাদ্য এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি, আজো অজস্র মানুষ দেশে দেশে গৃহহীন আছে। তবে একটা বিষয় আজ পৃথিবীব্যাপী সার্বজনীনত্ব লাভ করেছে, আর তা হলো মহামারী করোনায় মৃত্যুর ভীতি। যে ভীতি গ্রাস করেছে আমেরিকার হোয়াইট হাউজ পর্যন্ত। এতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় কোন স্বস্তি না এলেও, করোনা একটা বিষয় স্পষ্ট করেছে অক্ষরে অক্ষরে। আর সেটা হলো মানুষ মূলত একা। একদম একা। আজ আপনি, ফারুক ভাই, আক্কাস ভাই কাল অন্য কেউ অন্য কোথাও। হয় সে শ্মশান নয়তো গোরস্থান। এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ বাস্তব রূপ আমাদের দেবু দা। দেব দুলাল গুহ। বরিশাল রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেব দুলাল গুহ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা তারও আত্মার শান্তি কামনা করি।     

আখেরে লেখককে সশ্রদ্ধ সালাম এই তিন গুণিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য। শুধু সবিনয়ে এইটুকু বলবো, আপনি লিখুন, আপনার সব বিখ্যাত লেখা আমরা পড়বো। শুধু খেয়াল রাখবেন ঘরের কথা, নিজের কথা সর্বপরি অযথা অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলো আপনার বিখ্যাত লেখাগুলিকে যেন অখ্যাত করে না তোলে। মনে রাখা দরকার একদিন আপনার জন্যেও কলম ধরবে কেউ। তারা লিখবে আপনার খ্যাতির কথা, আপনার প্রখড় স্মৃতির কথা, আপনার অসামান্য যোগ্যতাগুলির কথা। তারা লিখবে আজো আপনি গাইতে বসলে কতো সুন্দর মনোমুগ্ধ সুরের মুর্ছনায় ভরিয়ে তোলেন আসর। আজো কানে ভেসে আসে আপনার কণ্ঠের গান। ‘দূরের আর্তোনাদে নদী ক্রন্দন কোন ঘাটে’। তখনই সবিস্ময়ে বলতে ইচ্ছে করে আমি অবাক হয়ে শুনি, তুমি কেমন করে গান করো হে গুনি?