কোভিড-১৯ এ হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান
ভয়ানক একটা মহামারী সময়কালে বাস করছি আমরা। শারীরিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থিনীতি ও মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষায়পুরো বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে দের বছরেরও বেশী সময় ধরে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে উন্নতমানের চিকিৎসা ও খেয়ে-পড়ে জীবন-যাপনের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক দেশেই এই মুহূর্তে মানুষ না খেয়ে মরছে। উন্নত চিকিৎসা ও অক্সিজেনের অভাবে মরছে।
অনুকূল এই সময়কালে অনেককেই বলতে শুনি, মানুষের মধ্যে মানবতা বোধ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে! না! মানুষের মাঝে মানবতা বোধ নেই, এই ভাবনা ভুল। আমাদের চারপাশে এখনো মানবিক মানুষের সংখ্যা বেশি আছে বলেই পৃথিবী এখনো ধ্বংস হয়নি। এই করোনা পরিস্থিতিতে অনেক নতুন-পুরোনো মানবিক মুখ উঠে আসতে দেখেছি আমরা। এই মানুষগুলোর সংখ্যা আগেও বিদ্যমান ছিল। আজকের এই করোনা পরিস্থিতিতে এমন অনেক মানুষদের আমরা দেখছি, যারা নিজের সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ কেটে অসহায়, দুস্থ্যদের খাদ্য-চিকিৎসায় মানবিক ভূমিকা রাখছেন। অনেক অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এই সময়ে করোনা মহামারী মোকাবেলায় মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছেন।
গত পহেলা আগস্ট রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যত ‘সিআরবি’ ধংসের পায়তারা রোধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে ব্রুকলিনের এভিনিউ-সি প্লাজাতে গিয়েছিলাম। সমাবেশটির পরিচালনায় ছিলেন ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ স্বেচ্ছাসেবী একটা সংস্থা এবং চট্টগ্রামবাসী।
দেখা ও কথা হয় স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে। তাই, ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ নিয়ে দুটো কথা লিখা দরকার মনে হল।
‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ (ঐবষঢ়রহম ঐধহফ ঋড়ৎ ঈযরঃঃধমড়হরধহ ওঘঈ (ঐঐঈ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি অলাভজনক, মানব উন্নয়ন, দাতব্য বা সেবা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (আর্থিক অনুদান সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত), যারা করোনাকালীন সময়ে অসহায়দের প্রয়োজনে মাঠে নেমেছেন।
গত বছরের মার্চের শুরু থেকেই করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করে। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নিউইয়র্কে চলছে তখন লাশের মিছিল। সংক্রমণ শুরুর পর মে মাসের দিকে এই ভয়ানক করোনাভাইরাস প্রভাব পরে বাংলাদেশেও। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি তখন নাজুক হতে শুরু করে। জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে পর্যাপ্ত চিকিৎসা-যতœ না পেয়ে মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে প্রতিদিনই। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘শ্বাস নিতে চায় চট্টগ্রাম’- একটি স্লোগান শুনতে পাওয়া যায়। সেই স্লোগান হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দেশ ছেড়ে প্রবাসের মাটিতে থাকা বাংলাদেশের মাটির সন্তানদের। আর তখনই নিজ জন্মভূমির মানুষদের রক্ষায় ওই সংকটকালীন সময়ে নিউইয়র্কের কিছু সচেতন নিবেদিত প্রাণ, প্রবাসী চট্টগ্রামবাসী সচেতন হয়ে উঠেন। ৪ঠা মে, ২০২০ সালে গড়ে তুলেন ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ নামের এই অলাভজনক সংগঠনটি। এর আগে ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটের প্রবাসী চট্টগ্রামবাসীদের পরামর্শক্রমে জুম্ মিটিংয়ের মাধ্যমে এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে ওজঝ কর্তৃক ৫০১ (প) অর্থাৎ এর আর্থিক অনুদান আয়কর মুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
এই সংগঠনটি কোনো গতানুগতিক আঞ্চলিক বা সামাজিক সংগঠন নয়। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা, কোভিড-১৯ রোগীদের সহযোগিতা করা, কমিউনিটির উন্নয়নে শিক্ষামূলক কার্যক্রম, স্বাস্থসেবা, জরুরী ত্রাণকার্য ইত্যাদি।
সক্রিয়ভাবে ১২ জন স্বেচ্ছাসেবক এই দায়িত্বে রয়েছেন। যথাক্রমে আবুল কাশেম (চট্ট্রল), নুরুল আনোয়ার, মাকসুদুলহক, আহসান হাবিব, ইব্রাহিম দিপু, কামাল হোসেন মিটু, আরিফুল ইসলাম, মীর কাদের রাসেল, মোহাম্মদ নাজের উদ্দিন, আলী আকবার বাপ্পি, বদিউল আলম ও আরিফ চৌধুরী।
সঠিক পরিকল্পনার আলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে চট্টগ্রামে সম্মানিত ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি সমন্বয়কারী টীম রয়েছে। এরা হলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইউনুস গনি চৌধুরী, কলামিস্ট ও কমিউনিটি একটিভিস্ট মুসা খান, সমাজসেবক ও মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা কামাল হায়দার, সি প্লাস টিভির সিইও -সাংবাদিক অপু আলমগীর, সমাজ সেবক হারুন অর রাশিদ, আবু জাহেদ সাদেক, মেজবাহউদ্দিন আহমেদ ও মোস্তফা মনোয়ার।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সংগঠনে দায়িত্বরত নুরুল আনোয়ার জানান, যদিও বা সংগঠনটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামকেন্দ্রিক, সেজন্য নামও রাখা হয় ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’, কিন্তু তারা আঞ্চলিকতার উর্ধে উঠে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে কার্যক্রমকে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছেন। সেজন্য প্রয়োজনে সংগঠনের ডাক নাম পরিবর্তন করা যেতে পারে। তাদের কাজের পরিধি উত্তর আমেরিকা ও বাংলাদেশ জুড়ে থাকবে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই প্রবাসী সংগঠনটি বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই পর্যন্ত যথেষ্ট কাজ করেছে বলে জানান নুরুল আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘সংগঠনটি শুরু করার তিন সপ্তাহের ভেতর আমাদের সম্মুখ যোদ্ধাদের জন্য প্রথম ধাপে বেশ কিছু মেডিকেল সুরক্ষা সামগ্রী উপহার হিসেবে পাঠিয়েছি আমরা, যা চট্টগ্রামের বড় তিনটি হাসপাতাল, যেমন জেনারেল হাসপাতল, মা ও শিশু হাসপাতাল, ফৌজদারহাট ফিল্ড হাসপাতাল ও বক্ষব্যাধি হাপাতাল, ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, লাশ দাফনকারী প্রতিষ্ঠান আল মানহিল ফাউন্ডেশন ও গাউসিয়া কমিটি, পুলিশ ও সাংবাদিকদের ভাইরাসের প্রকোপ থেকে কিছুটা হলেও ব্যক্তিগত সুরক্ষা দিয়েছে। মেডিকেল সুরক্ষা সামগ্রীগুলোর মধ্যে রয়েছে কঘ ৯৫ মাস্ক, এক্সামিন গ্লাভস, থের্মোস্ক্যান থার্মোমিটার, ক্লিয়ারচশমা (গগলস) এবং পিপিই গাউন।’
জানা যায়, দ্বিতীয় পর্যায়ে এই সংগঠনটি সম্মুখ যোদ্ধাদের সহযোগিতার পর, কিভাবে সরাসরি করোনা সিম্পটম রোগীকে সাহায্য সহযোগিতা করা যায় এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিজ্ঞ ডাক্তার যাঁরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং বিএমএ (ইউএসএ) সদস্য, যথাক্রমে ডা. বি এম আতিকুজ্জামান, ডা. পারভেজ করিম, ডা. মিশকাত, ডা. ফেরদৌস খন্দকার, ডা. আতাউল ওসমানী ও ডা. মাকসুদ এর সঙ্গে পরামর্শক্রমে তীব্র অক্সিজেন সংকটের কথা বিবেচনা করে উত্তর চট্টগ্রাম মিরসরাই সন্দীপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম চকরিয়া, কক্সবাজার পর্যন্ত ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে উন্নতমানের প্রফেশনাল অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর পাঠিয়েছেন। সেগুলো সক্রিয়ভাবে রোগীদের সিলিন্ডার বিহীন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। মিরসরাই শেষ বিদায়ের বন্ধু নামক একটি সংগঠনকেও অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। সর্বমোট ৪৫ হাজার ইউএস ডলারের ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।
ফোবানা এবং ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’সহ কয়েকটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা নিউইয়র্কের বিভিন্ন বরোতে কোভিড-১৯ এন্টিবডি টেস্টের ভ্রাম্যমান ক্যাম্পেও অংশ নিয়েছেন। মার্কস হোমকেয়ারের সহযোগিতায় এটি ছিল নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যে প্রথম করোনা টেস্টের ক্যাম্প।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি রক্ষায় ও হেল্পিং হ্যান্ড ফরচিটাগোনিয়ান ও সচেতন নাগরিক সমাজ নিউইয়র্ক জ্যকসন হাইটস্ ডাইভারসিটি প্লাজা ও ব্রুকলিন এভিনিউ প্লাজায় ‘সিআরবি’ ধংসের পায়তারা রোধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন।
খুব স্বল্প সময়ে এই সংগঠনটি করোনা মহামারীতে দারুণ অবদান রেখেছে। চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর সরবরাহ করা, সদর হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল ও প্রেসক্লাবে চচঊ, গঅঝক, এখঙঠঊঝ, ঞঐঊজগঙঝঈঅঘ বিতরণ করা, লাশ দাফনে সহযোগিতাসহ নিউ ইয়র্কে এন্টিবডি টেস্টিংএ ভ্রাগ্যমান ক্লিনিকে ভলোন্টিয়ার সহযোগিতা করেছেন।
‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ এর ভবিষ্যত পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য থাকছে, মানবিক পুলিশ ইউনিটকে ত্রাণ কাজে সহায়তা, গরিব দুঃখীদের জন্য আউটডোর চিকিৎসা সহায়তা, অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল টেলি-মেডিসিন ও কন্সালটেশন সাহায্য ও খাদ্য ও বাসস্থানে সহায়তা করা। নিউইয়র্কের জন্য থাকছে, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, কমিউনিটির নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য ও চাকুরী সহায়তা, জব ট্রেনিং, ফিউনারেল সহযোগিতা, ইমিগ্রেশন ও আইনিসহায়তা।
অন্যের সুখে, দুখে, আনন্দে, বেদনায় কারো মধ্যে একই অনুভূতি কাজ করা, অন্যের প্রতি দয়া, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকেই মানবতা বলে। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণে সত্য ও ন্যায়ের পথে যে কোনো কাজ করারকেই মানবতা বলা হয়। মানুষের মাঝে মানবতা এখনো বিদ্যমান। আমরা এখনো একে অন্যের দুঃখে কাঁদতে জানি। ‘হেল্পিং হ্যান্ড ফর চিটাগোনিয়ান’ এর সর্বোত্তম সাফল্য কামনা করছি।