খুব জানতে ইচ্ছে করে

অলৌকিক এ প্রাণ কে করেছে দান, ধর্ম না কি বিজ্ঞান? খুব জানতে ইচ্ছে করে। না কেউ দোষী নয়। তা ছাড়া কথাটা আদৌ দোষের কি না, সেটা কেউ ভেবে দেখছে এমন কোন কিছুর বর্হিঃপ্রকাশ মেলেনি কোথাও। হতে পারে আমাদের মোটা মনে ভেবে দেখবার মতো বিষয়ই নয় এটা। তবে শুনেছি একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। নিশ্চয়ই বিষয়টা মন্দের ভলোতো বটেই। তা হলে হোক। সকল তদন্তের পরম্পরা অনুসারে এরও একটা তদন্ত হোক। কমিটির প্রধানসহ অন্যান্যরা সবাই জানুক এই ঘটনার বিবরণ। সিদ্ধান্ত নিক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির কিংবা প্রতিরোধের। আর জানাক তাদের যাদের কর্ণকুহরে এখনো প্রবেশ করেনি এমন একটি মহাবিস্ময়কর লজ্জাজনক ঘটনার কথা।
তারপরেও বলি বিষয়টি হয়তো দোষের নয় কারো। ঘটনাটি এখন জানেন সবাই। জানে দেশ, জানে পৃথিবী। কেবল ভালো জেনে উঠতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ আর প্রতিষ্ঠানটি। গত ৭ মে ২০২২ তারিখে বিকেল ৩টার দিকে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সন্তানসম্ভবা শিল্পী বেগম (২৭), বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলের তৃতীয় তলায় লেবার ওয়ার্ডে লেবার পেইন নিয়ে ভর্তি হন। সেই প্রসূতি মা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে একা একা বাথরুমে গেলে সেখানেই ডেলিভারী হয়ে বাচ্চা বাথরুমের প্যানে পড়ে যায়! তারপর বাথরুম প্যানের সেই সরুপথ অতিক্রম করে, ময়লা নির্গমণের পাইপের পথে সেই বাচ্চা চলে যায় দ্বিতীয় তলায়। তৃতীয়তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় ময়লা পানি ভর্তি পাইপ অতিক্রম করে বাচ্চাটির আসতে যে সময়টা লেগেছিল, সেই সময়টা ঠিক কতো ছিলো? না আমি তা স্পষ্ট করে বলতে পারবো না। তবে অনুধাবন করতে যেয়ে আমারই দম বন্ধ হয়ে আসছে। কারো করোর মতে স্বামী নেয়ামতউল্লাহ এবং অন্য রোগীর স্বজনেরা মিলে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে পাইপ ভেঙে প্রায় পৌনে ২ঘন্টা চেষ্টার পর পাইপের ভিতর থেকে নবজাতকটিকে জীবিত উদ্ধার করেন!
তবু আজ কোন দোষের কথা নয়, এক দারুন অবিশ্বাস্য করিৎকর্ম গুণের কথা নিয়ে বরং কথা বলি। বলি সেই মানুষদের কথা। যারা ঘটনার আকশ্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে না পরে, অতি দ্রুত নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় পাইপের পথে পথে খুঁজে ঐ বাচ্চাটিকে পাইপ ফাটিয়ে জীবিত বের করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই মানুষদের ঠিক কোন ভাষায় বললে কৃতজ্ঞতা জানানো হবে, অভিবাধন জানানো হবে, আমি জানি না। যেমন জানি না শ্রষ্টা কেমন, সে কোথায়? শুধু থেকে থেকেই এ মনে কেবলই প্রশ্ন। যে হাত ঐ পাইপের পথে ছুটে পাইপ ফাটিয়ে শিশুটিকে জীবিত পৃথিবীর আলোয় নিয়ে এলো, সে হাত কার? তার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কি? কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর?
এই বিস্ময় শিশু পৃথিবীর আলোতে বাতাসে স¦মহিমায় পরিপূর্ণ সুস্থ্যতা নিয়ে বেঁচে থাকুক মায়ের কোল জুড়ে। আমরা সেই দোয়া করি। আর দোয়া করি সেই মাকে, যার নাড়ির টান এতোটাই দীর্ঘ। এতোটা দূরত্বেও যে নিজ সন্তানকে গর্ভের ভিতরের মতোই প্রাণময় আবিষ্ট রাখতে পেরেছিলেন। আর অভিবাধন জানাই সেই পিতাকে এমন স্ত্রীর গর্ভে যার সন্তান জন্ম নিয়েছে।
আরও প্রাণ ঢালা অভিবাধন জানাই তাদের, যাদের ব্যাপক দায়িত্ববোধহীনতা. কান্ডজ্ঞানহীনতা, জবাবহীনতা এবং অযোগ্যতার সকল পরিমাপের সীমা অতিক্রম করে শূন্যের কোটাকেও সর্ব শূন্য করে। সমগ্র জাতিকে এমন এক বিস্ময়কর লজ্জাজনক খবরের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পেরেছে। অতএব এইটুকু তিরষ্কারের অভিবাধন তাদেরও প্রাপ্য। আমাদের এমন অনেক অব্যাবস্থাপনা আছে যা আমরা শখ করে পুষে রাখি। সে অর্থে আমাদের সাস্থ্যখাত তেমনই এক শ্বেত হস্তি। যার বিশ ভাগ চলে যোগ্যতায় বাকি আশি ভাগ নির্দিধায় চলে বক্তৃতায়। সবাই ক্ষুধার্থ তাই ভোগের ভাগাভাগির মতো দুষ্ককর্মেরও এখানে কোনই দুর্নাম নাই।
আমার দেশের মানুষ অর্থাৎ যারা আকাশে মাটিতে পানিতেও প্রথম শ্রেণি, তাদের প্রয়োজনে যে চিকিৎসা ব্যাবস্থা আছে তাকে ছোট করে দেখবার কোন উপায় নাই। আর যারা সাধারণ, রাজনীতির প্রয়োজন কিংবা পরিভাষায় যারা জনগণ। তাদের চিকিৎসা দ্বারে দ্বারে ঘোরা ভিখারীর ভিক্ষার মতো। যারা দিনের পর দিন হাসপাতাল নামক এক শক্ত মেঝেতে কিংবা অতি ভাগ্যে মিলেযাওয়া বেডে শুয়ে হাত পেতে থাকে, যদি তাতে চিকিৎসা মেলে। এভাবে যৎসামান্য যা মেলে তাই দিয়েই এই দেশটা চলে, সুস্থ্য থাকতে চেষ্টা করে। কে আছে বলার, কে আছে দেখার? হয়তো আছে, জনস্বার্থে এবং জনঅর্থে অপ্রতুল কিছু মানুষ, যাদেরকে স্বসম্মানে বলা হয় আয়া, বুয়া, সেবক, সেবিকা এবং চিকিৎসক। আর এই যৎসামান্য যারাই আছেন তারাও বোধকরি জানতে রাজি নন কোনটা তদের দায় আর কোনটা দায়িত্ব। এদেরকে কে জানাবে আর কে বোঝাবে? হয়তো আছে এক উত্তর, যার নাম রাষ্ট্র।
যদিও দেশের সিংহভাগ মানুষ জানেই না সে কে, কোথায় থাকে, কি কাজ তার, কেমন দেখতে, সে কি সুস্থ্য? না কি প্রতিবন্দী? তাই যদি না হবে তা হলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলের এমন ঘটনার পর একটি পাতাওতো নড়লোনা সাস্থ্য অধিদপ্তরের! মোটা কিংবা পাতলা কোন মন্ত্রী নামের কেউতো হাত জোড় করে এসে বললো না ঐ মায়ের সামনে, দেশের সামনে, পৃথিবীর সামনে- ‘এ আমাদের ব্যর্থতা, এ আমাদের লজ্জা। ক্ষমা চাই ক্ষমা করো।’
শুনেছি লেবার ওয়ার্ডের এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিশু বিভাগের প্রধানকে। সঙ্গে আছেন পরিচালক মর্যাদার দুজন। ঠিক জানি না এই তদন্তে গুরুত্ব পাবে কোনটা? বাচ্চাটিকে কে বাঁচালো, বিজ্ঞান না কি ধর্ম? না কি প্রসূতি মা? কেমন করে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় এ জাতীয় বাথরুম প্রসূতি মায়েদের জন্য ব্যবহার্য হয়? কে কাটলো শিশুর নাড়ি, না কি ছিঁড়ে গেলো? না, আমি কোন দোষের কথা বলছি না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্প্রসারিত জ্ঞানের প্রয়োজনেই এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। যেনে নেওয়া প্রয়োজন এই শিশু ভুমিষ্ঠ হলো কোথায়, কখন? এই অদ্ভুত পৃথিবীর আলো বাতাসে কার হাতের স্পর্শে প্রথম সে কেঁদে উঠলো? মায়ের পেটকেটে নয়, বাথরুমের ময়লা নির্গমণ পথের পাইপ কেটে কে ভুমিষ্ঠ করালো এই বিস্ময় শিশু? একেও কি সিজার বলবো? কে করালো এই সিজার, পৃথিবীর কোন সে ডাক্তার কিংবা ধাত্রি, যে বা যারা এতোটাই যোগ্য যে প্রসূতির পেট নয়, বাথরুমের পাইপ কেটে বাচ্চা ভুমিষ্ঠ করাতে পারে! এই ঘটনায় শিশু উদ্ধারের পরে যতো ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। সেখানে যারা দন্ত বিকষিত হেসেছেন, তারা ঐ উদ্ধার কার্যে সম্পৃক্ত কেউ নন! বরং বলা যায় এই ঘটনার দায়ে ওদের অনেকের মুখেই কালি মেখে দেওয়া যেতো।
আমরা এখন দারুন উন্নত, নিশ্চয়ই আরো উন্নত হবো সামনে। তখন হয়তো শিশু ভুমিষ্ঠের প্রয়োজনে হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার নয়, বাথরুমের প্যান নয়, পাইপেও নয়, পাইপ অতিক্রম করে বাচ্চা তখন সরাসরি চলে যাবে ডাষ্টবিনে। সেখানেই কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর হাতে প্রাণ পাবে ভুমিষ্ঠ শিশু। এবার যেভাবে পাইপ কেটে বাচ্চটি ভুমিষ্ঠ করালো প্লামবার মিস্ত্রী কিংবা তদ্রুপ অন্য কেউ অথবা শুধুই ভুক্তভোগী স্বজন।
না কারো দোষ নয়। নিজেই নিজের সাথে কথাগুলো বলে লজ্জিত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। ভাবতে চেষ্টা করছি ঐ শিশুটি আমি, অথবা ঐ বাচ্চাটি আমার। ভাবছি এ বাচ্চাটি সংশ্লিষ্ট শিশু বিভাগের ডাক্তার। আয়া, নার্স, ব্রাদার। ভাবছি বাথরুমের প্যানে জন্ম নেওয়া সদ্য ভুমিষ্ঠ শিশুটি এই হাসপাতাল পরিচালক। বাথরুমের পাইপের নোংড়া পানিতে দমবন্ধ হাবুডুবু খাওয়া ঐ শিশুটি স¦াস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, কিংবা মাননীয় মন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় স¦াস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এর পরেও যা বলতে চাচ্ছি সে সম্ভব নয় বলা। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এই শিখর আরোহন অসহ্য অস্বাভাবিক। এই এক বিস্ময় শিশুর জন্ম যদি এতো মানুষ এতোগুলো চেয়ারকে সামান্যও লজ্জিত করতে না পারে, তবে বলতে বাধ্যই হবো। আমাদেরই অগচরে লজ্জাও যেন কবে থেকে পরিপূর্ণ নির্লজ্জই হয়ে গেছে!
না, তবু না। বলবোই না কারোর দোষ। না আমার, না তোমার, না রোগী, না ডাক্তার, না ঐ শিশু, না তার মা, না তার বাবা। যদি কোন বিবেচনায় কারো মনে হয়েই পরে এ দোষ। তবে তারা যেন শুধু এইটুকু বলে দেয়-এ দোষ সার্বিক রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার। এখানে, ওখানে, সবখানে। তাকে শতঃস্ফূর্ততা দিয়েছে রাজনীতি আর মুক্ত অর্থনীতি। আমাদের সকল ক্ষেত্রের সার্বিক জবাবদিহীতাও গলধঃকরণ করে নিয়েছে ঐ রাজনীতিই। যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবার প্রয়াসে চুড়মার করে চলেছে আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন। এভাবেই স্বপ্নহীন, জনগুরুত্বহীন, রাষ্ট্র সজ্ঞাহীন একটি দেশ কেমন করে চলে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় কি একেই বলে জাতীয় বজ্জাতী? যার কোন প্রতিবাদ থাকে না, হয় না, করা যায় না। যেমন চরম অনিয়মতান্ত্রিক সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক নিয়মে তৈরি, সকল পথের দুর্ঘটনার দিশারী, ব্যাটারীচালিত সকল যান রাস্তায় চলাচল করতে পারবে। এই মত প্রদান করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদলত! অথচ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই যে চরম বিচ্যুতি সেটা চোখে পড়ে না কারো? তা হলে কেনো চিৎকার করে আওয়াজ তুলি ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত?’ তার মধ্যে কি এই শিশুটিও পরে? যদি পরে তবে এই দেশের রুপ, সেই আগামীতে কেমন হবে? কেউ কি জানি আমরা এই প্রাণ, কে করেছে দান? এই অসম্ভব জটিল প্রশ্নের উত্তরটি স্ব-ভয়ে খুব জানতে ইচ্ছে করে। কেউ কি জানেন?
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য।