চিংড়ি চাষের বিকল্প নেই

হোয়াইট গোল্ড বা সাদা সোনা নামে পরিচিত ভেনামি চিংড়ি রফতানিতে সহসাই কোনও সুসংবাদ আসছে না। বিশ্ববাজারে এক সময় রাজত্ব করা বাগদা ও গলদা চিংড়ির বাজার দখল করে নিয়েছে ‘ভেনামি শ্রিম্প’ বা প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প (প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি)। উচ্চ ফলনশীল এবং দাম কম হওয়ায় বাজার ধরতে পারছে না দেশের গলদা ও বাগদা। হাইব্রিড জাতের এ চিংড়ি চাষে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই সফলতা পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ভেনামি জাতের হাইব্রিড সাদা চিংড়ি চাষ পুরোদমে শুরুর বিকল্প নেই।
ভেনামি চিংড়ির কারণে বিশ্ববাজারে এরইমধ্যে গলদা ও বাগদার চাহিদা ও দাম দুটোই কমেছে। তাই ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে নিতে হবে পদক্ষেপ। বাড়াতে হবে প্রণোদনা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানিয়েছে, দেরিতে হলেও সরকার গতবছর পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি জাতের সাদা চিংড়ি চাষের অনুমতি দিয়েছে। তবে এর পূর্ণ সুফল পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে পাঁচ বছর। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নিতে সরকার অনেক দেরি করেছে। কেননা, বিশ্ববাজারে এরইমধ্যে অন্য রফতানিকারকরা জেঁকে বসেছে। ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন খরচ কম, দামও কম। অথচ সরকারি সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় বাংলাদেশের রফতানিকারকরা এখনও বসে আছে গলদা-বাগদা নিয়ে। দুটোর দামই ভেনামির চেয়ে বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজার ও ব্যবসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএমআরসির দেওয়া তথ্যমতে ২০১৮ সালে বিশ্বে চিংড়ির বাজার ছিল ৪ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন টনের। যার বাজারমূল্য ১৯ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে বৈশ্বির প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৪ সাল নাগাদ চিংড়ি খাতের বৈশ্বিক বাজারের আকার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন টনে।
অপরদিকে ওয়ার্ল্ডস টপ এক্সপোর্ট-এর (ডাব্লিউটিই) মতে, ২০১৮ সালে চিংড়ির বৈশ্বিক বাজারের ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ দখল করেছে ভারত। ১৭ ও ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বাজার নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ইকুয়েডর ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের দখলে রয়েছে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। অবস্থান অষ্টম।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের পৌনে তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে চিংড়ির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের দখল ৪ শতাংশ কমে ২ শতাংশে নেমেছে। আর এ সময় ধারাবাহিকভাবে চিংড়ি রফতানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। এ সময় চিংড়ির উৎপাদন কমেছে ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ।
এদিকে রফদানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চিংড়ি রফতানি হয় ৩৩ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথমার্ধে রফতানি হয় ২১ কোটি ৭২ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যের তুলনায় ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি হলেও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ কম এবং পাঁচ বছর আগের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কম।
ইপিবি ও বিএফএফইএর তথ্যমতে, পাঁচ বছর ধরে চিংড়ি রফতানি কমতির দিকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ি রফতানি করে আয় করেছে ৫১ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ২৭৬ হাজার টন চিংড়ি রফতানি করে আসে ৪৫ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৩৯ হাজার ৭০৬ টন চিংড়ি রফতানি করে আসে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ডলারের লক্ষ্যের বিপরীতে ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ কম রফতানি হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি হয় ৩৬ কোটি ১১ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যের তুলনায় ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ ও আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।
গত ২০১৩-১৪ অর্থবছর দেশে ৩৪ হাজার ৭৩৩ মেট্রিক টন বাগদা ও ৬ হাজার ৫০৩ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন কমে নেমেছে ২৪ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টনে আর গলদা চিংড়ির উৎপাদন কমে হয়েছে ৫ হাজার ১৪৬ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি হয়েছে। যা পরে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ৫১ কোটি ডলারে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, ভেনামি জাতের সাদা চিংড়ির আবির্ভাবে বিশ্ববাজা
রে বাংলাদেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমেছে। ভারত, ইকুয়েডর ও ভিয়েতনামে ভেনামি জাতের সাদা চিংড়ির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ভেনামি চিংড়ি চাষে উৎপাদন খরচও ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না বাংলাদেশের চিংড়ি। কম দামে পাওয়া যায় বলে বিশ্ববাজার এখন ভেনামি চিংড়ি দখলে। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশের চিংড়ির দাম ও চাহিদা দুটোই কমেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষী হেমায়েত উদ্দিন বললেন, বাগদা ও গলদা এখন দেশের বাজারেই বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। আগে যে বাগদা-গলদার দাম ছিল প্রতিকেজি হাজার টাকা, এখন তা ৫০০-৬০০ টাকা হয়ে গেছে। অথচ উৎপাদন খরচ কমেনি, উল্টো বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম বলেছেন, নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে করোনার মধ্যেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত সচল রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মাঠপর্যায়েও যাচ্ছি। চিংড়ি এর বাইরে নেই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন জানিয়েছেন, আমাদের চিংড়ির উৎপাদন খরচ বেশি। ক্রেতারা খরচ কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। খরচ কমানো শুরুও করেছেন তারা। এরই মধ্যে অনেকে ভেনামি চাষে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এই চিংড়ি দামে সস্তা। তিনি আরও জানান, বর্তমানে ভেনামির তুলনায় বাগদা বা গলদা চিংড়ির দাম পাউন্ডপ্রতি ২ ডলার বেশি। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমেছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০ বছর তদবির করার পর সম্প্রতি সরকার পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দিয়েছে। বিশ্বের ৬৭টি দেশ এর চাষ করছে। মোট চিংড়ি রফতানির ৭৭ শতাংশই এখন ভেনামির দখলে। বাগদা চলছে মাত্র ১১ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চিংড়ি রফতানিতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখে সমস্যা থেকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।