জয় বরিশালবাসী

জয় বরিশালবাসী

শ্রাবণের সন্ধ্যায় ধবল মেঘেরা এখনো আকাশে ধাবমান। বৃষ্টির আপাতত বিরতি চলছে। তাই ইচ্ছে হল সান্ধ্যকালীন হাঁটাহাঁটি করার। তিন দিনের অঝোরধারা শেষে প্রকৃতির যেন শান্ত স্নিগ্ধ ও ক্লান্ত লাগছে। বাসা থেকে বের হয়ে ধীরলয়ে হাঁটছি। রাস্তায় লোক সমাগম খুবই কম। এই করনাকালে মানুষের জীবনাচারে বেশ পরিবর্তন লক্ষণীয়। প্রয়োজন ব্যাতিত খুব একটা মানুষ বের হয় না, স্টে-হোম ধারায় অভ্যস্ত হচ্ছে। দুচারজন কিশোর-যুবকদের এদিক সেদিক ইতস্তত চলাফেরা লক্ষ্য করলাম। তাছাড়া রাস্তা বেশ ফাঁকাই।

বগুরা রোড থেকে কালিবাড়ি রোড ধরে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে বারিশাল কলেজের প্রধান ফটকের কাছে আসতেই মনে হলো মৃদু গম্ভীর স্বরে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকছে। স্বল্প রাস্তার আলোয় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কোন দিক থেকে ডাক টা আসছে। পুনরায় সামনে পা বাড়াতেই কিছু বুঝে উঠার আগে আমার বাম হাত ধরে একটা শক্ত দৃঢ় হাতের টান অনুভব করলাম। হটাৎ কে আমাকে স্পর্শ করলো? তাঁর দিকে তাকাতেই অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম গোলাকার মুখাকৃতি, সাদাপক্ক কেশ, চোখে বৃত্তাকার চশমা ও গোঁফ সমৃদ্ধ এক কীর্তিমান পুরুষকে। সে মৃদু হেসে বলল, আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি এমন একজনের জন্য, যার সাথে কিছুটা সময় আলোচনা করা যাবে।

আমার হাঁটায় বাধা পরায় একটু বিরক্ত হয়ে বললাম- তা আমাকে কেন? আমার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘এসো তমাল তলায় বসি’। এই তমাল তলাই এক সময় আমারও আড্ডার জায়গা ছিল। বহুদিন হয় বসি না। বলতে বলতে লোকটি আমার হাত ধরে তমাল তলায় নিয়ে বসলো। আর আমিও আকস্মিক ঘটনায় কিছু না বুঝে অনেকটা সম্মোহিত হয়ে তার সাথে তমাল তলায় গিয়ে বসলাম। একে তো আমি বিরক্ত তার উপর, এই করোনাকালে অন্য কোন লোকের স্পর্শ। তাই রাজ্যের বিরক্তি নিয়েই প্রশ্ন করলাম আমি কি আপনার পরিচিত কেউ? আপনাকে তো আমি...। আমার কথা আটকে গেলো তার মুখম-লের দিকে তাকাতেই। হা করে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমার মুখ থেকে কোন কথা আর বের হচ্ছে না। আর তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন আমার অবস্থা দেখে। মনে হয় আমার মাথা ঘুরছে। কতক্ষণ এরকম ছিলাম জানি না। একটু গা ঝাড়া দিলাম ঘোর কাটানোর জন্য। অনুভব করলাম উনি তার কথা বলেই চলেছেন। যদিও তার অনেক কথাই আমি শুনতে পেলাম না। এবার তিনি আমার কাধে তার আলতো হাত রেখে বললেন, তুমি তো বরিশাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, তাই না? তার এই প্রশ্নটায় সম্ভিত ফিরে পেয়ে অবাক হয়ে বললাম, আ-প-নি, আপনি। বললেন, ঠিকই ধরেছ। আমি তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সব তো ঠিকই আছে। তা হলে আমি কি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের সাথে তমাল তলায় বসে কথা বলছি?

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি, এবার ভালো করে লক্ষ্য করলাম, শুভ্র চাদরে আবৃত সুঠম মহাত্মাজিকে। আপনি কিভাবে জানলেন আমি এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র? উনি মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, ‘আমি জানি, আমাকে জানতে হয়। একদিন এই বরিশালের নাড়ি নক্ষত্র আমার নখদর্পণে ছিল। আমি বরিশালবাসীর মনের সুখ দুঃখের ও সমস্যার কথা পরতে পারতাম। আর সেইভাবে কাজ করতাম বলেই তো আমাকে বরিশালবাসী মহাত্মা বলে শ্রদ্ধাভরে আজও স্মরণ করে। দেখছো না এখনো বরিশালবাসী আমার নাম নিয়ে কেমন বরিশাল তোলপাড় করছে? আমার নামে অনেক কিছু করার ঘোষণা দিচ্ছে। যুক্তি- তর্কে, সময়, অসময়ে, মেধা, মননে, ভাবে, দন্দে, ইচ্ছা, অনিচ্ছায় বেশ জমজমাট অবস্থা এখন বরিশালে। বুঝেলে না তো? আরে এই বরিশাল কলেজের নামকরণ নিয়ে। তাইতো আমারও একটু ইচ্ছে হল আমার প্রিয় বরিশালে একটু ঢুঁ মারতে।’

বললাম, কেন ঢুঁ মারতে কেন? বললেন- ‘কেন না? প্রায় শতবর্ষ হল আমি এই দেহ ত্যাগ করেছি। তারপরও আমার প্রিয় বরিশালবাসী এই করোনাকালে সব ভুলে কলেজের নামকরণ নিয়ে ইতিহাস খুঁজে মতামত প্রদান করছে। কতো কতো কর্মসূচি, তাই ভাবলাম যাই শেষবারের মতো তমাল তলায় বসে আসি। বাড়িটা তো আর নেই। তমাল গাছটাও হয়তো একদিন আর থাকবে না। তবে যাই বলো আমার বাড়িটা ভাঙ্গায় বেশ প্রশস্ত জায়গা হয়েছে কলেজের জন্য। খুব ভাল লাগলো। যদি না আসতাম তাহলে তো এই দারুন কষ্টের ভালোলাগাটা এমন করে পেতাম না। তারপর এই যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বরিশালবাসী বরিশালের নাম যাতে মুছে না যায় সেজন্য অহরাত্রি পরিশ্রম করে চলছে। বরিশালের জন্য আমিও কিছু করার চেষ্টা করেছি ঠিক তেমনি আমার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বরিশালকে ভালবেসে যারা আমার উত্তরসূরি হয়েছে, সেই মানুষেরাই আজ অমার বড় প্রাপ্তি।

আজ আমার বড় বলতে ইচ্ছে হয়, এখন আর অমি নই, আজ মহাত্মা তোমরা সবাই। তাই এইসব দেখতে আহ্লাদে- আনন্দে আসলাম তোমাদের সাথে একাত্মাতা ঘোষণা করতে। আর বলতে, শুনে রাখো আজ তোমরাই মহাত্মার প্রতিরূপ। মহাত্মা মানে আর কিছু না, মহাত্মা মানে সত্য প্রেম পবিত্রতা। তোমরা থামবে না, চালিয়ে যাও। যতক্ষণ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন না হয়। আর ঐ যে গুটিকয়েক অর্বাচীন এই বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এটাকে ঠিক বলো তোমরা?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপনার নামটি যুক্ত হলে এই প্রতিষ্ঠানটি আরও সমৃদ্ধ হবে। যেহেতু কলেজের জায়গাটি আপানরই বাসস্থান ছিল। এই বরিশালের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক সংস্কার আরও কতো কর্মকা- আপনি করেছেন। বরিশাল ও মহাত্মা অশ্বিনী কুমার তো পরিপূরক নাম। এই দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষ আপনার নামের এমন বিরোধীতাকে অকৃতজ্ঞ বরিশালবাসী হিসেবেই চিহ্নিত করবে। উনি মৃদু একটা ধমক দিয়ে বললেন ‘তুমি তো দেখছি বেশ সমস্যা সৃষ্টি করতে পারো। আমি যে জন্য স্বর্গ থেকে মর্তে এসেছি তা নিয়ে কোন উৎসাহ দেখছি না তোমার’? আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, বলুন বলুন।

উনি বললেন, শোন ‘আমি গর্ব করে শতবর্ষ আগে বলতাম, বরিশাল আজ যা চিন্তা করে সমগ্র দেশ তা পরে ভাবে’। আমি কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আবার কি বলতে না কি বলে ফেলি। মহাত্মা বেশ তৃপ্তির ভঙ্গীতে সাফল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘দেখ তোমাদের এখানে তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি বৃহত্তর দুইটি রাজনৈতিক দল আছে, যারা একে অপরকে ন্যূনতম সহ্য করতে পারে না। এরা সবসময় বৈরী মনোভাব নিয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। যেটা গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পরে না। কিন্তু দেখো, আমার নামের বিরোধীতার ব্যাপারে বরিশালের আওয়ামী লীগ-বিএনপি কি সুন্দর এক আত্মা এক প্রাণ হয়ে আছে। এই যে বরিশালের উভয় দল যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে! যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে এই দুই দল একসাথে পথচলার দৃষ্টান্ত হলেও হয়ে উঠতে পারে(?)। সেজন্যই তো আমি বলেছি বরিশাল আজ যা করে সমগ্র দেশ পরে তা অনুসরণ করে। যা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবও করতে পারত না। তা এই অশ্বিনী কুমার নামকরণ নিয়ে হয়ে গেলো। তাই আমি আনন্দে দিক বেদিক ভুলে স্বর্গ থেকে নেমে এলাম অভিবাদন দেয়ার জন্য বরিশালবাসীকে।

তারপর আরো দেখো, এই করোনাকালে আমার প্রিয় বরিশালবাসী যেভাবে জড়ো হয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি কার্যক্রম সফল করলো এবং এতে যে সমাগম করে এন্টিবডি তৈরি হল তাও তো এই নাম বিতর্কের বদৌলতে, তাই না’? আমি মহাত্মার উচ্ছ্বাস ও গদগদ ভাব দেখে নিচুস্বরে বললাম, যারা একসময় আপনার নামে কলেজের নামকরণ করা হোক এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল তারও দু দশজন ঐ গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে ছিল। এটা কি ঠিক হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? উনি বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক হয়েছে, আলবৎ ঠিক হয়েছে, এজন্যই তো বললাম নামকরণ নিয়ে যে তোলপাড় হচ্ছে এর মধ্যে দুই একটা ভেলকি থাকতে হবে না? এই ভেলকারাই তার কাঁচামাল, যা যুগে যুগে চলে এসেছে এই দেশে।

যা হোক শোন,  আমি অশরীরী তাই এই রাস্তা দিয়ে লোকজন যে চলাফেরা করছে তারা তো আমাকে দেখতে পারছে না। তুমি প্রাক্তন ছাত্র বলে তোমার সাথে শরীরী অশ্বিনী কুমার দৃশমান’ আমি তার কথা শেষ হবার আগেই বললাম এখন অনেক প্রাক্তন ছাত্র নামকরণের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ‘আমার যাবার সময় হয়ে গেছে শুধু একটা বার্তা দিয়ে যেতে চাই তোমার মাধ্যমে, তা হল, এই সময়ে মানে কুরবানীর এই সময় অর্থাৎ আত্ম উৎসর্গ ও ত্যাগের মহিমার সময়। বরিশালবাসী প্রত্যেকে মহিমান্বিত হোক, প্রত্যেকে মহাত্মা হোক এটাই আমার প্রত্যাশা। জয় বরিশালবাসী’। দেখি মহাত্মা ঊর্ধ্বাকাশের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে ধবল মেঘরাশির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছেন। আমি হঠাৎ মহাত্মা মহাত্মা বলে চিৎকার করে তমাল তলা থেকে তাকে ধরবার জন্য লাফ দিলাম। আর অমনি তমাল গাছের মৃতপ্রায় ডালে গোঁত্তা খেয়ে মাটিতে পরে গেলাম। ব্যাথার অনুভুতি অনুভূত হতে লাগলো শরীরে। কানে আমার তখন চিৎকার চেচামেচির শব্দ। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখলাম, সবাই আমায় নিয়ে ব্যস্ত। সবাই জানতে চাচ্ছে অমি বিছানা থেকে পড়ে গেলাম কিভাবে? আমি কাউকে কিচ্ছু না বলে পরিস্থিতি এবং শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করে চলেছি। আর মনে মনে ভাবছি বর্তমানের এই সময়টা কেউ কি আমার মতো ঠাহর করতে পারছে, না কি না?