তোমার আহ্বানের সুবর্ণ জয়ন্তি

যমুনার কূল ছুঁয়ে হাজার বছর, খুঁজেছি স্বদেশ শান্তির কুড়ে ঘর।
হৃদয় পেয়েছে হৃদয়ের কথা আমার প্রিয়তম স্বাধীনতা।
দিয়েছি কতশত রক্ত গোলাপ, মৃত্যুর মুখোমুখি মুক্তির সংলাপ
পতাকা শোভিত সঙ্গীত বুকে জন্মভূমি
পেয়েছে ইতিহাস অমরতা, স্বাধীনতা।
অথবা
‘একটি ডাকে এতগুলো প্রাণ দিয়েছে সাড়া, ভূমিকম্পের দৈত্যপুরিকে দিয়েছে নাড়া...’
রক্তঝরা এই মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস। যে সূচনার মধ্য দিয়ে আমাদের পরম পাওয়া স্বাধীনতা ৫০ ছুঁয়েছে। আমরা পালন করবো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আমাদের স্বাধীনতরা এক উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা রয়েছে। যে আলোকচ্ছটায় বিশ^ভূবন আলোকিত করেছে। সেই আলোকচ্ছটার অনন্য নাম হচ্ছে ৭ মার্চ। আমাদের গর্ব ও অহংকারের আহ্বান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহনের অঙ্গুলী নির্দেশনা। একটি মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান, স্বাধীনতার আহ্বান। আজ সেই আহ্বানেরও পঞ্চশতম বার্ষিকী বা আহ্বানের সুবর্ণজয়ন্তির দিন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রম’। যে ভাষণ আজ বিশ^ ইতিহাসের অনবদ্য দলিল হয়ে গেছে। যাকে বলা হয় ইউনেস্কোর প্রামান্য দলিল। এই অর্জন বাঙালি জাতি হিসেবে একান্তই আমাদের।
আমরা জানি, ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপুর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। সেই ঐতিহ্যের মধ্যে একটি ভাষণ বাঙালির মুক্তিপথের দিকনির্দেশনা সন্নিবেশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আজ বিশ^ প্রামান্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য এর অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭ মার্চের মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণ বিশ^ ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আমাদের পরম পাওয়া। একই সঙ্গে বলতে পারি এমন ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘও সম্মানিত হয়েছে। কারণ, তাদের কাছে পৃথিবীর সেরা একটি ভাষণ সংরক্ষিত আছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিট। রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে পরিনত হযে যায়। তখনই আমাদের কবি অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে উঠে দাঁড়ান। ঘোষণা করেন তাঁর বজ্রনিনাদ। উর্ধ্বাকাশে অঙ্গুলি তুলে একের পর এক মুক্তির দিকনির্দেশনা। বিকেল ৩টা ৩মিনিটে যখন তাঁর আঙ্গুল নামে ততক্ষণে ইথারে ইথারে ভাষতে থাকে অমর কবিতা ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কালজয়ী সেই ১৮ মিনিটের ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হয়ে গেছে। আমরাও একই সঙ্গে ওই ঐতিহ্যের অংশিজন হয়ে গেলাম। এখন বিশে^ আমি এবং আমরা কেবল একটি ভাষণনের কথা বলে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাকে নিজেকে পরিচিত করার জন্য অনন্য উপাদান পেলাম আমরা। এই অর্জন আজ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তির সঙ্গে একাত্ব হয়েছে। আজকে আমরা বলতে পারবো ৭ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি। একের মধ্যে তিন পেয়ে আমরা আরও ঋদ্ধ হলাম।
২০২১ বছরটি আমাদের অনেক পূর্ণতা দিয়েছে। যেমন করোনার প্রাদুর্ভাবকে প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছি। তেমনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবছর। তার সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছ। সব মিলে বাঙালির এক মহা অর্জনের বছর বলতে পারি আমরা।
এত অর্জনের মধ্যেও আমাদের মনের আকাশে কালো মেঘের ছয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির উত্থান দেখছি। দেখছি ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করে মানুষ হত্যার নগ্নতা। ধর্মীয় মৌলবাদী চক্র ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে নতুন একটি আইনের যাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের মুক্তমনা লেখক, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয়ে বাড়ছে নির্যাতন। সবমিলে যখন আমরা সুবর্ণজয়ন্তি পালন করছি সেই সময়ে এই কালো মেঘগুলো দূরে ঠেলে দেওয়া একান্ত জরুরী। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্নের সোনার বাংলার সত্যিকার রূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে যাতে সংকীর্ণ চিন্তা থেকে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।
৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ১৮ কিংবা ২২ মিনিটের ভাষণে যে দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে সেটা যেন আমরা ধারণ করতে পারি। তাহলেই আমাদের সুবর্ণ জয়ন্তি পালন স্বার্থক হবে।