ত্যাগের অপার মহিমা কোরবানী

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির মধ্যে উদযাপিত হচ্ছে ঈদ-উল-আজ্বহা। কোরবানী মানুষের মনের ভেতরের হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ করার অনুপ্রেরণা যোগায়। মানুষের ভেতরের পশুবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। এবারের করোনা মহামারীতে আমরা সবাই যেন পশু কোরবানীর মাধ্যমে নিজের ভেতরের পশুকে নিয়ন্ত্রণ করি। তাহলেই আমাদের পশু কোরবানী সার্থক হবে। নিজেরা যেন নূন্যতম স্বার্থকে ত্যাগ করে মানুষের কল্যাণে দাঁড়াতে পারি। ক্ষমতার দম্ভ আর হিংসা যেন পাথেয় না হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আমরা যেন বিশ্বমানবতার জয়যাত্রার পথে থাকতে পারি। ঈদ-উল-আজ¦হা উপলক্ষে পৃথিবীর সকল মানুষের মঙ্গল কামনা করছি। সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি করোনা মোকাবেলায় যারা নিরন্তরভাবে চেষ্টা লাচ্ছেন তাঁদের সকলকে। নিরন্তর শুভেচ্ছা আমাদের পাঠক, সুভানুধ্যায়ীসহ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা আমাদের বিপর্যন্ত করে দিয়েছে। পৃথিবীর অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। একটা চরম দুঃসময়ে ফেলে দিয়েছে করোনা। এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে উন্নত বিশ্বও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ পাহাড় সমান। তারপরও বাংলাদেশ করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেকটা ইতিবাচক অবস্থানে আছে। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রেই হাতাশার ছায়া। শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। তারপরও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সেভাবে ভেঙে পড়েনি। এটা আমাদের সামনের পথ চলার অনুপ্রেরণাও। আমরা জানি, করোনার এই দুর্যোগ মোকাবেলা করে অবশ্যই একদিন সুন্দর পথের দিশা পাবো। পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশও সেই সম্ভবাবনার পথ খুঁজছে।
করোনা মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও হিংসা দ্বেষ, বিভেদ, অহংকার, দম্ভ, প্রভাব-প্রতিপত্তির ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। পারমানবিক অস্ত্রো আজ অকেজো। দেশে দেশে দখল, নিয়ন্ত্রণ শক্তি পরীক্ষার লড়াই নেই বললেই চলে। মনে হচ্ছে সবার ভেতর মানবতার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এখন সবাই একটাই চিন্তায় মগ্ন, কিভাবে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করা যায়। পুরো পৃথিবী জুড়ে যেন মহাশান্তির বারতা বইতে শুরু করেছে। আমরা শান্তি চাই, আমরা মানুষের মঙ্গল চাই, আমরা পৃথিবীকে মানুষের বাসোপযোগী করতে চাই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সবাই যখন এই প্রার্থণা করছে, তখনো করোনার সঙ্গে লোভের আগুনও ছড়িয়ে পড়ছে। এতো এতো মৃত্যুর মিছিলও আমাদের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে পারেনি? এখনো কোথাও কোথাও দ্বন্দ্ব, সংঘাত, দুর্নীতি, করোনা রোগীদের সেবার নামে পুকুর চুরির ঘটনা ঘটছে। তাহলে আমরা কেমন মানব সমাজ? সামনে পরম স্বজনের মৃত্যুও আমাদের শেখাতে পারছে না। এখনো আমরা পদে পদে অমানবিক আচরণ করছি। ঠুনকো আভিজাত্যকে টিকিয়ে রাখতে অন্যের ওপর চরাও হচ্ছি। করোনার মতো ভয়াবহ দুর্যোগ যদি আমাদের শেখাতে না পারে, তাহলে সত্যি-ই আমাদের মুক্তি হবে?
ত্যাগের অপার মহিমার নাম হচ্ছে কোরবানী। আল্লাহ তাআলা ইসমাইল (আ:) কে তাঁর প্রিয় জিনিষ কোরবানী দিতে বলেছিলেন। ইসমাইল (আ:) বুঝতে পেরেছিলেন তার প্রিয় জিনিষ হচ্ছে তার প্রাণের ধন, প্রিয় সন্তান। আল্লাহর আদেশে তিনি সেই পুত্র সন্তানকেই কোরবানী করছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ ইসমাইল (আ:) এর কোরবানী কবুল করে নেন। তবে তার সন্তান নয়, সন্তানের পরিবর্তে পশু কোরবানীর মাধ্যমে। ইসমাইল (আ:) তাঁর ভেতরের পশুকে কোরবানী দিয়ে আল্লাহর কাছে কোরবানী কবুল করান। মানুষের ভেতরের পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই কোরবানীকে ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি করছি? কোরবানীর নামে প্রতিযোগিতায় নামছি। একধরণের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা। আমাদের ভেতরের অহম দূর করে আমরা কোরবানী দিতে পারছি ক’জন? কোরবানী দিতে গিয়েও যদি হিংসা, দ্বেষ, দম্ভ, ক্ষমতার ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা লোক দেখানো কোরবানী ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে?
আসুন, এই কোরবানীর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ, পাপবোধ, অহংকার এবং ক্ষমতাকে একটু নিয়ন্ত্রণ করি। ভেতরের পশুবৃত্তিকে নিবৃত্ত করে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হই। বিশ্বমানবতার জয়গানে করোনা মোকাবেলায় কাজ করি। আগামী সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই অবদান রাখার চেষ্টা করি।