নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অলংকার ও আপদ : তৃণমূল নারী প্রতিনিধি

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বলা হলেও বাস্তবে ক্ষমতায়নের জায়গায় পৌছানো সম্ভব হয়নি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো অনেকাট অলংকার ও আপদ হিসেবে গন্য হচ্ছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীকে মর্যাদার পরিবর্তে আপদ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।
অন্যদিকে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামীম বলেছেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের উচ্চ, মধ্যম ও স্বাবলম্বী দেশের পরিনত হতে হলে নারী-পুরুষ একযোগে কাজ করতে হবে।
বরিশালে নারীর রাজনৈতিক ক্ষতায়ন বিষয়ক বিভাগীয় সংলাপ ও তৃণমূল পর্যায়ে অপরাজিতাদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের মতবিনিময় সভায় এমন অভিব্যাক্তি তুলে ধরেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এবং তৃর্ণমূলের নারী জনপ্রতিনিধিরা।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের হোটেল গ্র্যা- পার্কের হল রুমে তৃণমূল পর্যায়ে অপরাজিতাদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামীম।
মতবিনিময় সভায় মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য ফাহমিদা বেগম মুন্নি তাঁর ধারণাপত্রে বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো অনেকাট অলংকার ও আপদ হিসেবে গন্য হচ্ছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীকে মর্যাদার পরিবর্তে আপদ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। রাজনীতিতে ৩৩ ভাগ নারী সদস্য রাখার বিয়টিও সেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেসব ক্ষেত্রে ৩৩ ভাগ নারী সদস্য নেওয়ার উদ্যোগ আছে, সেখানেও তাদের কোন সাংগঠনিক পদ দেওয়া হচ্ছে না। কেবল কোটা পূরণের জন্য নারীদের রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংরক্ষিত নয়, সুযোগ পেলে নারীরা সাধারণ আসনে নির্বাচন করে যোগ্যতা প্রমাণ করবে।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, ১০ বছর আগেও নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আজকের আমাদের জতীয় সংসদে ৭২জন নারী প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিরোধী দলের নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, দেশের প্রশাসনসহ সরকারি বেসরকারী অনেক দপ্তরে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারপরও নারীর প্রতি বেষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য রাতারতি পরিবর্তন হবে না। তবে পরিবর্তনের লক্ষে কাজ চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই লক্ষ্যে রাজনীতিতে নারীর ৩৩ভাগ যুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকা-ে দেশ ছেয়ে গেছে। সন্ত্রাস থাকলে নারীরা এগোতে পারবে না। নারী পুরুষ মিলে এইসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও নারী পুরুষ মিলে একযোগে কাজ করতে হবে। সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ হলে একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
বিভাগীয় কমিশনার ড. অমিতাভ সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অথিথি ছিলেন, বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম। বক্তব্য রাখেন, স্থানীয় সরকারি বভিাগ বরিশালের উপপরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল, সচেতন নাগরিক কমিটি সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক পুষ্প রাণী চক্রবর্তী, উন্নয়ন সংগঠক আনোয়ার জাহিদ, কাজী জাহাঙ্গীর কবির, রহিমা সুলতানা কাজল, শুভংকর চক্রবর্তী।
মতবিনিময় সভাটি পরিচালনা করেন রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খোকন।
মতবিনিময় সভায় সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম বলেন, পরিবার, সমাজ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নারীর এগিয়ে চলায় বৈষম্য ও বাধা থাক উচিত নয়। কিন্তু ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে আমাদের নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। নারী শিক্ষাকে পিছিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নারীদের ঘরে আটকে দিচ্ছে। পরিবারিকভাবেও নারীরা বৈষম্যে শিকার। শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে বাধার সৃষ্টি করা হয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদিও আজকের অবস্থানে এসে নারীরা এগিয়ে চলেছে। নারীর ভেতর নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। সবাই মিলে এগিয়ে আসলে এই বৈষম্য এবং বাধা কমতে বাধ্য। রাজনীতিতে যে নারী বা যারা নেতৃত্ব দিতে পারবে তাদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ করে দিতে হবে।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার ড. অমিতাভ সরকার বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল অর্জনে নারীদের অবদান রয়েছ। তাই নারীদের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এর পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার। আবার একথাও সত্য পুরুষরা নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে নয়। কেবল নারীর অধিকার বললে হবে না, আমাদের মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্যরা উপস্থিত থেকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন।
পিরোজপুর জেলার অপরাজিতা সোমা ম-ল বলেন, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ হতাশাজনক। রাজীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজনীতির মাঠে নারীরা আরও বৈষম্যের শিকার। আজও তারা অধস্তন হিসেবেই মূল্যায়িত হচ্ছে। এটার পরিবর্তন হওয়া উচিত।
মঠবাড়িয়া উপজেলা ভাইচ চোরম্যান অ্যাডভোকেট নাছরিন জাহান বলেন, রাজনীতিতে নারীর কেবল অংশগ্রহণ নয়, সাংগঠনিক পদে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অংশগ্রহণের নামে কোটা পূরণের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ৩৩ ভাগ নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও বর্তমানে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কোনটিতেই ৫ ভাগের বেশি নারীর অংশগ্রহণ নেই। যেসব নারীরা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন তারাও সেখানে বৈষম্যের শিকার। তাদের কোন কথা বলতে দেওয়া হয় না। উপজেলা ভাইচ চেয়ারম্যান হিসেবে নারী তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারে না। এমনকি উপজেলা ভাইচ চেয়ারম্যান হিসেবে উপজেলার গাড়ি পর্যন্ত ব্যবহার করার সুযোগ পায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ ভোটের মাঠে সমানভাবে লড়াই করে নির্বাচিত হতে হয়েছে। কিন্তু সুযোগের বেলায় কোটার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নারীকে আর অলংকার হিসেবে নয়, মানুষের মর্যাদা দিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে।
ঝালকাঠি জেলার ইসরাত জাহান সোনালী বলেন, দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হচ্ছে না বলেই নারীরা পিছিয়ে আছি। পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে পা ফেলে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ালেও বৈষম্য কমেনি। আমদের পেছনে রাখার চিন্তা থেকে বের হতে পারছে না। তাই নারী রাজনীতির মাঠসহ সব ক্ষেত্রে ভালো থাকার একটা অভিয়ন করে চলে। নারীকে তার যোগ্যতা দেখানোর সুযোগই দিতে চায় না। যোগ্যতা দেখানোর সুযোগ দিলে নারীরাও সমানভাবে উন্নয়নে যোগ্যতা রাখতে পারবে। নারীরা মেয়ে মানুষ নয়, একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদা পেতে চায়। সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
বরিশাল জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা দেলোয়ারা খানম বলেন, সমাজে নারীরা এগোতে চাইলেও নানামূখি বাধায় সামনে যেতে পারছে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীর জন্য আস্থা সৃষ্টি হলেও তারে জন্য অবস্থান সৃষ্টি হয়নি।
এ ছাড়াও নারী প্রতিনিধি হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, পিরোজপুর জেলার নেছারাবদ উপজেলার ভাইচ চেয়ারম্যান নার্গিস জাহান, বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভাইচ চেয়ারম্যান তাহমিনা বেগম, পিরোজপুর জেলার অপরাজিতা খনা এইচ সরকার, রাজাপুর উপজেলা ভাইচ চেয়রম্যান আফরোজা আক্তার লাইজু।