নিম্নবিত্তের ‘বিলাসী খাদ্য’ মাছ, মাংস, ফল

নিম্নবিত্তের ‘বিলাসী খাদ্য’ মাছ, মাংস, ফল

চালের দাম বাড়লে পুষ্টিকর খাদ্য কমিয়ে দিয়ে শুধু সবজি নির্ভর হয়ে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। এ শ্রেণি তাদের আয়ের ৩২ শতাংশ খরচ করে শুধু চাল কেনার পেছনে। তাদের কাছে বিলাসী খাদ্য হিসেবে বিবেচিত মাছ, মাংস এবং ফল।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, আয় কমলে সবার আগে এসব খাবার কেনা বন্ধ অথবা কমিয়ে দেয় তারা। ফলে মারাত্মক পুষ্টি ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

‘হোয়াট ডু উই লার্ন অ্যাবাউট হাউজহোল্ড ফুড ডিমান্ড প্যাটেন্টস অ্যান্ড ইলাস্টিসিটিস ফ্রম মাইক্রো-ডাটা ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ড. ওয়াসেল বিন সাদাত। এটি তৈরি করা হয়েছে দ্য কুয়াইডস মডেলে বিবিএস’র ২০১৬ সালের হাউস হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের তথ্য ব্যবহার করে। এটি পুরোনো তথ্যের ভিত্তিতে করা হলেও এখন প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

মূল প্রবন্ধে ড. সাদাত বলেন, গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি ব্যয় হয় চালের পেছনে। গ্রামের মানুষ জাতীয়ভাবে নিজের মোট আয়ের ৩২ শতাংশ ব্যয় করে চাল কেনায়। আবার গরিবরা ধনীদের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করে চাল কিনতে।

তিনি বলেন, তবে গ্রাম ও শহর উভয় এলাকার গরিব মানুষের কাছে বিলাসী খাদ্যপণ্য মাংস, মাছ ও ফল। তবে ডিম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য খাবার। মাংস কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে শহরের মানুষ। ফল কেনায় এগিয়ে ধনীরা। শাক ও সবজি কেনার ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর প্রায় সমান।

তার গবেষণায় বলা হয়, দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে কম ব্যয় করে ফল ও পুষ্টিকর খাবারের পেছনে। পরিবার প্রধান যদি নারী হন তাহলে কিছুটা পুষ্টিকর খাবারে গুরুত্ব থাকে। সেই সঙ্গে বিড়ি, সিগারেট, পান, জর্দা কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ কম হয়। তবে যদি ১০ শতাংশ আয় বাড়ে তাহলে ১৫ শতাংশ  ভোগ বেড়ে যায়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যদি চালের দাম বাড়ে তাহলে জাতীয়ভাবে ডাল জাতীয় খাবার, মাছ, মাংস ফল এবং অন্যান্য খাদ্য পণ্যের ভোগ কমে যায়। এ ক্ষেত্রে শুধু শাক-সবজি কিনে থাকে দরিদ্র মানুষেরা। যদি ডাল জাতীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় তাহলে অন্যান্য খাদ্যপণ্য এবং মাছের ভোগ কমে যায়। এ ক্ষেত্রে বেড়ে যায় চাল, ডিম এবং সবজি ক্রয়ের পরিমাণ। মাছের দাম বাড়লে চাল, মাংস, সবজি এবং অন্যান্য খাদ্যের ভোগ কমে যায়। অন্যদিকে বেড়ে যায় ফল এবং ডালজাতীয় খাদ্য ক্রয়। ডিমের দাম বাড়লে মাছ ও মাংসের ভোগ কমে যায়, বেড়ে যায় চাল, অন্যান্য খাদ্য, ডালজাতীয় খাদ্য, সবজি এবং ফলের ভোগ। সবজির দাম বাড়লে চাল, ডিম, মাংস এবং ফলের ভোগ কমে। তখন বেড়ে যায় অন্যান্য খাদ্যপণ্য, ডাল এবং মাছ ক্রয়। ফলের দাম বাড়লে চাল, ডাল, সবজি এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ভোগ কমে যায়, বেড়ে যায় মাছ ও মাংসের ভোগ।

প্রতিবেদনে আরেরা বলা হয়, করোনা মহামারীর সময় যখন প্রথম লকডাউন হয় ১১ শতাংশ দাম বেড়ে যায় বিভিন্ন পণ্যের। এ সময় জাতীয়ভাবে আয় কমে যায় ৭০ শতাংশ। দ্বিতীয় লকডাউনের সময় পণ্য মূল্য বেড়ে যায় ২০ শতাংশ। সেই সঙ্গে আয় পুনরুদ্ধার হয়ে ৪৩ শতাংশ কম থাকে। তৃতীয় লকডাউনের সময় পণ্য মূল্য বেড়ে যায় ১৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে আয় পুনরুদ্ধারের ধারা অব্যাহত থাকে। আয় কম হয় ৪ শতাংশ।

এতে করোনার সময় আয়ে প্রভাব পড়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, প্রথম লকডাউনের সময় মানুষের আয় প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। তবে লকডাউনের শেষে তা ৪৩ শতাংশে নেমে আসে। আর দ্বিতীয়বার লকডাউনের শেষে আয় হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের আয় পুনরুদ্ধার হয়ে আসে লকডাউন ওঠে যাওয়ার ফলে।

গবেষণার বিষয়ে ড. বিনায়ক সেন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে দাম বাড়লে মানুষের পুষ্টিকর খাবারের ক্ষেত্রে এক ধরনের ছাড় দিতে হয়। এটা একটি দারুণ তথ্য। আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে সেটা হলো, কভিডের কারণে আয় হ্রাসের পরিমাণ ৭০ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমেছে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক প্রশ্নে জবাবে ড. ওয়াসেল বলেন, অনেক সময় বলা হয় যে মুরগির দাম বেড়ে গেলে মানুষ মাছ খাবে বেশি কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। মাছের দাম বাড়লে ফল ও ডালের ভোগ বাড়বে। আবার মাংসের দাম বাড়লে সবকিছুর ভোগ কমে আসবে।

গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, যেহেতু চালের দাম বাড়লে গরিব মানুষের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বাদ দেয় সেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খোলা বাজারে চাল বিক্রি বাড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া যখন আয় কমে যাবে তখন আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, গরিব মানুষে চাল নির্ভর। কারণ তাদের আয় কম থাকে। চালের দাম বাড়লে ডিমের ভোগ ঠিক থাকলেও মাছ, মাংস, ফল এবং সবজির ভোগ কমিয়ে দেয়। এটা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। গবেষণাটি পুরোনো তথ্য দিয়ে করা হলেও এখনো এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা আছে। তবে এ অবস্থার সঙ্গে দেখা দরকার ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালের অভ্যাস বা খাদ্যগ্রহণের অবস্থা কেমন।