নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণমাধ্যম তৈরি করা গেলে করোনাসহ সকল দুর্যোগ মোকাবেলা সম্ভব হবে
সারা দুনিয়ায় গণমাধ্যম প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। মূলত গণমাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যম বলতে আমরা বুঝি, সংগৃহীত সকল ধরণের মাধ্যম। বলা যায়, একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে সারা দুনিয়া গণমাধ্যমের আওতায় এসেছে। তবে নাম মাত্র সংবাদ প্রকাশই গণমাধ্যমের একমাত্র কাজ নয়। সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্র বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবমুক্ত হলেই গণমাধ্যমের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব হবে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণমাধ্যম তৈরি করা গেলে বৈশ্যিক করোনাসহ সকল দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এবারের করোনা মহামারীতে গণমাধ্যমকর্মীরা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ হারানোর ঝুঁকি করোনার থাবার চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে। তাই কেবল মুক্ত গণমাধ্যম নয়, মুক্তভাবে লেখনি এবং কাজের নিশ্চয়তা একান্ত দরকার।
বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ও ভয়ভীতি আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে সারা দুনিয়ায় গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। এবছর করোনার কারণে সেই ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়েছে। অনেক গণমাধ্যম করোনার দোহাই দিয়ে বন্ধ হয়েছে। অকেন প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাটাই করা হয়েছে, যা মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
গোটা বিশে^ মুদ্রিত মাধ্যম হিসেবে খবরের কাগজ, সাময়িকী, নিউজ লেটারই গণমাধ্যম নয়। এর সঙ্গে বর্তমান বিশে^ ইলেকট্রনিক মাধ্যম হিসেবে আছে টেলিভিশন, বেতার গণমাধ্যমকে আভিজাত্য এনেদিয়েছে। এ ছাড়া মুঠোফোন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটে ইউটিউব, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম্যমকে নতুন যুগের গণমাধ্যম হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে।
সংবিধানের বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমের স্বাাধীনতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। সে লক্ষ্যেই ৩ মে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ অথবা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যম বিষয়ক সচেতনতা।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যগতভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতেই ভূমিকা পালন করে থাকে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য ছিল ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার কালাকানুন বাতিল করা। এ জন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।
বাকবাধীনতা অধিকারের রক্ষাকবচ অবশ্যই যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষেই নাগরিক ও সাংবাদিকেরা ভোগ করে থাকেন। কেউ সেই বিধিনিষেধ না মানলে তাঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। গণমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তাও আমরা অস্বীকার করছি না। তাই বলে সেটা কেবল তার পুলিশি শক্তি বাড়ানোর ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না।
সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে যে কালাকানুন বাতিল হয়েছে, সেটি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব যেমন গণমাধ্যমের ওপর আঘাত, তেমনি গণতন্ত্র ও সভ্যতারও পরিপন্থী। মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা সব ধরণের কালাকানুন, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাধা ও হুমকির অবসান।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ পালিত হয়।
আমরা যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষপটের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই, তথ্য অধিকার আইন পাশ হওয়ার পর থেকে সংবাদকর্মীদের কলমের স্বাধীনতা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হয়েছে। রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকীতে পরে এমন তথ্য ব্যতিত অন্যান্য সকল বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে। আর এই তথ্য সেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন সংবাদকর্মীরা। তাই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি বিশ^ব্যাপী সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টির দিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
নির্ভিক সংবাদকর্মী পেতে চাইলে সবার আগে তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। তা না হলে দিন শেষে কোন এক অদৃশ্য পিছুটান তাকে বাধ্য করবে অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করতে। সংবাদ মাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করাও একান্ত প্রয়োজন। একপাক্ষিক মতাদর্শের প্রচার কখনোই সংবাদ মাধ্যমের কাম্য নয়। কাজেই গণমাধ্যম কর্মীদের নিরপেক্ষ থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতে হবে। গণমাধ্যমকে সবসময় মুক্তভাবে কাজ করতে হবে। মুক্তভাবে কাজ করা গণমাধ্যমের একটি মৌলিক বিষয়। তবে বর্তমানে শুধু বাংলাদেশে নয় আমাদের চেয়ে উন্নত দেশগুলোও পুরোপুরি মুক্তভাবে গণমাধ্যমকে কাজ করতে দেয় না। গণমাধ্যম মুক্তভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে একটি দুষ্ট মহল বিরুদ্ধে থাকবেই।
এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার দেশের সুন্দর ও সুস্থ্য আইন, আইনকানুনের যথাযথ প্রয়োগ, ক্ষমতাশীলদের উদার মানসিকতা। পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মাঝে সত্য সহ্য করার ক্ষমতা গড়ে উঠতে হবে। অনেক সময় বন্তুনিষ্ঠ সংবাদগুলো কোনো একটি মহলের বিরুদ্ধে গেলেই তারা বাধ সাধে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমকে হতে হবে আরো দায়িত্বশীল। তাদের বুঝতে হবে ঘোষিতভাবে না হলেও অঘোষিতভাবে তাদের দায়িত্ব অনেক বড়। শুধু মুক্ত গণমাধ্যম নয়, মুক্ত ও সুস্থ্য গণমাধ্যম তৈরি করতে হবে।
বিশ^ব্যাপী সাংবকাদিক হত্যা, নির্যাতন, লাঞ্ছনার ধারাবাহিকতা কখনোই মুক্ত চিন্তার জন্ম দিতে পারে না। জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজন আপোশহীন নিয়ন্ত্রণমুক্ত নির্ভিক সাংবাদিকতা। গণমাধ্যমকে সততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও মহানুভবতা দেশ ও দেশের নাগরিকের কাছে প্রমাণ করতে হবে। তাদের বিশ্বাস করাতে হবে, ‘আমরা স্বাধীনতা পেলে, স্বেচ্ছাচারিতা করবো না’। যদি তারা এটা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে নাগরিকরাই তাদের পক্ষ হয়ে মুক্ত প্লাটফর্মের জন্য আওয়াজ তুলবে।
তাই আসুন, এবারের বৈশ্বিক ক দুর্যোগ করোনা মোকাবেলায় সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে মানুষের পাশে দাঁড়াই। সবাই মিলে করোনা মোকাবেলায় একজোট হয়ে বিশ^ব্যাপী নিয়ন্ত্রণমুক্ত সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হই।