নিয়ম করে মেনে চলা এক নিয়ম

আমাদের দেশের প্রতিটি জেলা শহরেই প্রতিনিয়ত একজন জেলা প্রশাসক কিংবা জেলা মেজিস্ট্রেট আসেন এবং সময়ান্তে তারা চলে যান। রেখে যান তার সময়ের কর্মের স্বাক্ষর, সমাজ শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায়। যিনি এই কর্ম সাধনে যত সুচারু থাকতে পারেন তার নাম ততদিন ওই শহরে উচ্চারিত হতে থাকে। আর যেজন সীমাবদ্ধ হয়ে পরের নির্দিষ্টতায়, তারা হারিয়ে যান মুহুর্তেই। এ এক নিয়ম। এই নিয়মের ধারাবাহিকতা মেনেই তারা আসেন তারা চলে যান। কেউ বলেন এ নিয়ম বৃটিশ কলোনিয়াল। এর বাইরে আর যা যা দেখি, সেগুলি মূলত অনিয়ম এবং তাও প্রচলিত দেশের সকল জেলায়। বোকা নেটিভদের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রয়োজনে এই নিয়মের প্রবক্তা মান্যবর সকল জেলা প্রশাসকবৃন্দ। যা এখন দারুন প্রচলিত দেশের সকল জেলাতে।
তা হলে কি সেই নিয়ম, কি সেটা? কারা নিয়ম করে মেনে চলে সেই নিয়ম? কেন বাধ্য হয়, কিসের বিনিময়ে? একটা সময় ছিল যখন স্ব-স্ব ক্ষেত্রের বয়জেষ্ঠ, বোদ্ধা কিংবা প্রাজ্ঞজনেরা আসন পেতেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীও আসরে। সে যুগ হয়েছে বাসি। সে স্থান দখলে নিয়েছে কিছু পরিমান চালের বিনিময়ে প্রশাসন আর নগদ নারায়নের বিনিময় রাজনীতি। এমন কথাগুলি নিয়ে একটি অনলাইন মন্তব্য সম্প্রতি দারুন যায়গা করে নিয়েছে মানুষের মুখে মুখে। ‘নূতন ডিসি আসছেন, ডিসির বাড়ির নতুন খাদেম কাম-কামলা বুদ্ধিজীবীরা, তৈরী হোন ভাষা খুঁজুন নূতনের সামনে যা নিয়ে দাঁড়াবেন।’ কেউ বলে ওরা এ কথা লেখেন কারণ ওদের ডিসির দুয়ারে জায়গা হয় না তাই। অবশ্য এ কখাগুলিও যারা বলেন নিত্য প্রসাশনের দুয়ারে হ্যাংলার মত তারাই ঘুরঘুর করেন। এভাবেই রাজা আসে রাজা যায় নির্দিষ্ট প্রজারা প্রতিবার তাদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে নুতন নুতন ভাষায় কুর্নিশ জানায়। তবু রাজা আর প্রজা এদের কাউকে কি ছোট করা যায়? জানি রাজা বড় হয় বোকা প্রজার গুণে। আর প্রজা বড় হয় স্বকীয়তার গুণে, আত্মমর্যাদায়। সে আছে কার? আছে কোন রাজদরবারের চাকর কিংবা প্রজার?
না এ কথা না বলি আর। তার থেকে বরং বলি সদ্য আয়োজিত উদীচীর গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠনের আলোচনার কথা। একজন বলছিল ‘অনেকেইতো দেখলাম ফুল হাতে। তার পরে কোথায় গেলো তারা? অথচ এরা ওই গুণীদের বাড়ির দুয়ারে গুণীর কদর করতে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। আজ এমন কি কাজ তাদের?’ এই প্রশ্নের ভালো উত্তর জানা ছিল না আমার। তাছাড়া মানুষের এখন অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। সব যায়গায় স্বার্থহীন সময় দেওয়া এখন কঠিন। আর কেউ কেউ বলেন ‘এখন সময়, যখন যেমন তখন তেমন রূপ ধরবার।’ আসলে আমরা একটু এমনই, অসভ্য প্রকৃতির। ভয়কে ছালাম ঠুকি আর যোগ্যতাকে এড়িয়ে চলি। আসলে ভয়টা আমাদের যোগ্যদের কাছে, নিজেদের অযোগ্যতাকে ঢাকবার।
খুব ভালো লেগেছে মঞ্চে উপস্থিত দুই গুণীর কথা। মুকুল দাস যদিও এখনো নিজের কথা বলতেই বেশী পছন্দ করেন। তিনি তাই-ই করলেন। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন অপর সংবর্ধিত গুণীজন রাখাল চন্দ্র দে। যেমন সহজ মানুষ সে, তেমনই অতি সহজ ছিল তার কথা। তাই অতি সহজে অনবরত উচ্চারণ করতে পেরেছেন সকলের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন উদীচীর প্রতি। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং সকল দর্শকদের প্রতি। একই সাথে তিনি স্পষ্টত উচ্চারণ করেছেন তার পরিবারের কৃতজ্ঞতার কথাও। অর্থাৎ সত্যিকারের গুণী যাকে বলা যায়। যিনি পারেন নিজেকে অতিক্রম করে অকপটে অন্যের ভালো অন্যের সুন্দরকে প্রাণ ভরে উপস্থাপন করতে। অবশ্যই ভাল লেগেছে এক সময়ের এই শহরের প্রায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মদ্যোগের প্রবক্তা, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক পথ চলার তিক্ষè বক্তব্য। দারুন বিস্ময় ভরে ভালো লেগেছে প্রধান অতিথি বিভাগিয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসানের কথাগুলি। অত্যন্ত সাবলীল উচ্চারণে উপস্থাপন করেছেন উদীচীর প্রতি তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ। তিনি বলতে পেরেছেন অবলিরায়।‘ উদীচী মানেই সত্য আর নৈতিকতার ভীত। উদীচী মানে নিরন্তর সুন্দরের আরাধনা। এই ব্যাতিক্রম প্রয়াসীদের তুলনা মেলা দুষ্কর।’ যদিও এই কঠিন সত্যই আজ সর্বত্র উদীচী কর্মীদের একমাত্র বিপদ। এর প্রধান কারণ সম্ভবত সাংস্কৃতিক বলয়ে নীতি নৈতিকতা আর ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটানোর ব্যর্থতা।
এই প্রসঙ্গে একটি গান প্রায়শই মনে পড়ে আমার। ‘একদিন ভালবাসা মৃত্যু যে তারপর, তাও যদি পাই। আমি তাই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।’ এই গানের গীতিকার পুলক বন্ধোপাধ্যায়। প্রখ্যাত শিল্পী ও সুরকার মন্নাদে। তার কন্ঠে এই গান কতবার শুনেছি আমরা। আরো যে কতবার শুনতে চাইবো সে বোধহয় বলে শেষ করবার নয়। কী অসাধারণ এই গান কী অসাধারণ শিল্পীর গায়কী। কী অসাধারণ এই সকল গানের বাণী বা কথা।
তবু আমরা কেউ কি কখনো ভেবে দেখি কিংবা কখনো চেষ্টা কি করি গানের বাণী শুনতে? না সম্ভবত পারি না। কারণ গানের সুর, তাল, তার এমন বাঁধনে আমাদের সম্মোহিত করে ফেলে, তখন আমরা কথা শুনবার পথ হারিয়ে ফেলি। গানের কথা যেন শুনতেই পাই না। তাই গানের বাণীর অর্থ খুঁজতে পারি না। এই যে গানের দুইটি লাইনের কথা বললাম। তার কি কিংবা কি কি অর্থ হতে পারে?
নিশ্চয়ই সরাসরি সরল উত্তর তার, জীবনের বিনিময়ে হলেও ভালবাসা চাই-ই চাই। অথবা ভালবাসাহীন এ জীবন মৃত্যু সম! তাই তো? শব্দের এ অর্থগুলিও সন্দেহাতীত যথার্থ। তবে এভাবে নির্দিষ্ট অর্থেই কথাগুলি শেষ নয় সম্ভবত। আছে এ কথার অর্থের ভিন্ন বিন্যাস আরো অজ¯্র ভিন্ন রূপ। কিছু ব্যতিক্রম মানুষ বাদ দিলে আমরা সাধারনেরা তা বুঝতে একেবারেই অভ্যস্ত নই। যে কারণে ব্যতিক্রমী চিন্তার পথ সন্ধানী হতে আমরা পারি না। সুতরাং গানের ওই ‘ভালবাসা’ শব্দের অর্থরূপ যে বোধ, বুদ্ধি, বিবেচনা আর ব্যক্তিত্বের প্রতিরূপও হতে পারে, তেমন ভাবনায় নিজেদেরকে কখনোই ব্যাপৃত করতেই পারি না।
তা হলে এই সমাজটায় আমরা আছি কিভাবে? যেখানে আমরা কেউ কোন প্রশ্ন করবার অধিকারী নই। সকল কিছুই বাধ্যবাদকতার উত্তরে ভরপুর। কখনো তা অর্থ কিংবা অবস্থান প্রাপ্তির প্রত্যাশায়, কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বাতেনে ইশারার ভয়ে! যদি প্রশ্ন আসে ভয়টা কিসের? সেখানেও আমরা প্রশ্নাতীত নিরব। যাহেরে এবং বাতেনে।
এখন যে কোন আসরে সরব হতে অস্বস্তি লাগে। কারণ আমাদের পো ধরবার প্রতিযোগিতা। যা দেখলে যে কোন সুস্থ্য লোক (অবশ্য যদি থাকে) অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। যদিও পৃথিবীর সকল দেশে সকল কালে এই পো ধরবার মানুষেরা ছিলো, আছে, থাকবে। তবে এখন এর সংক্রামন সংক্রামিত করে চলেছে আমাদের সমস্ত শরীর, মন, মস্তিষ্ককে। এখান থেকে ফিরতে না পারলে আমি পারবো না স্বেচ্ছায় আমার বাবার নাম নিতে। আমাদের সন্তানরা পারবে না কারোর অনুমোতি ছাড়া তাদের বাবাদের নাম নিতে! তার জন্য বিশেষ কারোর অনুমোতির প্রয়োজন পড়বে। তার পরেও নিয়ম ভেঙ্গে স্বীয় চেষ্টায় সে বন্ধাত্ব যদি কেউ অতিক্রম করেন। দেখবেন প্রগতিরই কিছু মেনিমুখ মানুষ জটলা করবে আপনার সামনে এসে। প্রয়োজনে বুঝাতে আসবে দারুন চাতুর্যের সঙ্গে। মাথা মুন্ডু নাড়িয়ে বলতে থাকবে, ‘এভাবে নয়, ওভাবে নয়। এটা নয়, ওটাও নয়। তাতেও সফলকাম না হলে, সর্বশেষ তারা তাদের ভন্ড রূপের উলঙ্গ উন্মেস ঘটাবে। বলবে চলো, আগাও সঙ্গে আছি। তারপর সরীসৃপের মতো দূর থেকে বিষ ঢালতে শুরু করবে। এই বিষ চেয়ার আগলে থাকবার, এই বিষ সত্য বিমূখ করবার, এই বিষ চীরতরে নূতনের পথ রুদ্ধ করে দেবার, এই বিষ পুরো সমাজ ব্যবস্থার শিকড়ে পচন ধরিয়ে দেবার। আমরা পারছি সেটা। পারছি নানান রূপে, নানান ছল ছুতোয়।
আমাদের এই স্খলিত আত্মসম্মান বোধ যখন অযথা আমাদেরই অবয়বকে অতিক্রম করে বসে। তখনই আমরা এমন কিছু সিদ্ধান্তের দাস বনে যাই। যা কখনো কোন দিনই মনুষ্য কর্ম নয়। অথচ করি। করতে পারি বা অবস্থান ঠিক রাখতে করতে বাধ্য হই। নিকট অতীতে তেমনটা করেছিও। দেশাত্মবোধের অনন্য প্রতীক, স্বরাজী, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। আজকের অধুনিক শিক্ষিত দক্ষিণ জনপদের অন্যতম একজন রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নামের বিরোধিতাও আমরা করেছি। এবং তা করেছি প্রকাশ্যে।
না, একদম লজ্জিত হইনি। না, আমাদের কারোরই কান কাটা যায়নি। না, আমাদের এই বিবস্ত্র স্বাধীনতাকে আমরা উলঙ্গতা মনে করিনি। না এতটুকুও দমে যাইনি এমন কর্মটি করে। বরং এখনো বলি সাফাই গাই। সকল কিছু যেনে বুঝে এখনো গলা লম্বা করে বলতে ভালবাসি। ‘আমি এই স্কুলের কিংবা কলেজের ছাত্র ছিলাম।’ কেউবা বলে ‘আমিতো ছিলামই অমার আরো গর্ব আমার বাবাও এখানকার অত্যন্ত প্রভাবশালী শিক্ষক ছিলেন।’ আছে এমন কথার পরেরও পর। যেখানে ছোট্ট করে এখনো তারা সব যেনে বুঝেও বলেন ‘তবু এমন উদ্যোগ নেবার আগে মেয়র মহোদয়কে একটু জিজ্ঞেস করবার দরকার ছিলো!’ জ্ঞানীর পাপ বোধহয় এমন উচ্চারণের মধ্যেই নিহীত থাকে। নিঃসন্দেহে ভালো এই শীতল বোধ এই জ্ঞানলব্ধ আত্মউপলব্ধি। মহাত্মার শততম প্রয়ান দিবসের (বরিশাল সরকারি অশ্বিনী কুমার কলেজে)। অশ্বিনী স্মৃতি সংসদের আলোচনায় এসে যিনি বা যারা এমনটা ভাবতে পেরেছেন তাদের সাধুবাদ জানাই। এবং সবিনয়ে জানতে আর বলতে চাই, কেন শুধু ভাবনায় সংকুচিত আছেন আপনারা?
আসুন সম্প্রসারিত করি নিজেদের, যা বিশ্বাস করেন সেটা করে ফেলুন, চলুন মেয়র মহোদয়ের কাছে যাই। যেয়ে বলি, ‘মাননীয় মেয়র আপনার অনুমতি ব্যতিরেকে আমরা কিছু অবোধ আত্মভোলা মানুষ। মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের বাড়িতে অবস্থিত সরকারি বরিশাল কলেজের নামের সঙ্গে মহাত্মার নাম সংযোজিত করবার উদ্যোগ নিয়ে হয়তো আমরা ভুল করে ছিলাম।’
সেই ভুলকে শুদ্ধ করবার জন্য (অর্থাৎ বরিশাল কলেজ নামের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের নাম নয়।) প্রকাশ্যে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ ছাত্র ছাত্রীর ব্যানারে বরিশাল কলেজ ছাত্রলীগ। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ শিক্ষক পষিদের সম্পাদক। সব থেকে বড় দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ভুলের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন মহা-শশ্মন কমিটির সভাপতি। বাদ থাকলো না বরিশাল শিক্ষা বোর্ড, মুক্তিযোদ্ধ সংসদ। বাদ থাকলো না সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদও। এর তদানিন্তন সম্পাদকের সরাসরি বিরুদ্ধ মঞ্চে স্বশরীরী উপস্থিতি সংস্কৃতির শুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সমন্বয় পরিষদের অর্গল ভেঙ্গে দু-চারজন এসে আমাদের ভুলের পথেই চলবেন বলে সম্পৃক্তও হয়েছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সমন্বয় পরিষদ অভ্যন্তরে তারা তাদের অবস্থানের উন্মেষ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
কারণ এর একটাই। রাজনীতির দখলদারিত্বে নিজেদেরকে বিলয়ে দেওয়া। জানি এই সময়ে আমরা বড় উপায়হীন। তার জন্য কাউকে কি দায়ী করা যাবে? নিজেদের ভুলের দায়, অস্তিত্বে কালিমা লেপন করে দিয়েছে। বড় গলা, দম্ভ, সংস্কৃতিবান হওয়ার গৌরব আমাদের স্খলিত হয়েছে। এমন অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়া লজ্জা বোধের ক্ষরণ, যদি আমাদের আর ফিরাতে না পারে তবে হয়তো পরিস্কার বিলীন হয়ে যাওয়াই আমাদের গন্তব্য!
মানুষের অর্থ কিছুটা কম হলেও হয়তো চলে। ক্ষমতা? সে আর কজনার থাকে? আমরা এওতো জানি যে, মানুষের শ্রীবৃদ্ধি চেহারায় নয়। মাথায় চুল নেই, কি হয় তাতে? আজো পৃথিবীর অজ¯্র টাকে মানুষ ছালাম ঠোকে। শিক্ষা যোগ্যতার মাপকাঠি, সেই সত্যওতো ধুলায় মলিন। তা হলে, সবাই মিলে পৃথিবীর সকল অযোগ্যতার দায় নিয়ে আত্মঘাতি হবো? সেওতো পাপ।
অতএব বেঁচে যেহেতু থাকতেই হচ্ছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তাহলে সেই জীবনে একটু ব্যক্তিত্বের অনুশীলন কি সম্ভব নয়? বুঝি না সবাই কেন আমাদের সকল অস্তিত্ব নির্লজ্জের মতো তুলে দিচ্ছি রাষ্ট্র আর রাজনীতির পায়? যে মথায় চুল থাকে না সেই মাথাটায়ই সব থেকে বেশী চিরুনির ব্যবহার হয়। তেমনই এক কঠিন সত্য হলো, এই শহরে মহাত্মার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। তিনি এখন সকল কিছুর উর্ধ্বে। কিন্তু আমাদের তো তাকে খুব প্রয়োজন। এই শহরটার স্বকীয়তায় তার অস্তিত্বের প্রগাঢ় প্রয়োজন মহাত্মার নামের যথাযোগ্য ব্যবহার। সেই কর্ম সাধনে আগে মাঠে নেমে যারা ভুল করেছি। আসুন তাদের বাদ দিয়ে নয়তো সঙ্গে নিয়ে চলুন যারা মনে করেন, একে ওকে কিংবা এর ওর পদধুলি অথবা অনুমোতি গ্রহণেই মিলবে সমাধান। সরকারি বরিশাল কলেজ হবে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার সরকারি কলেজ।
আসুন সবাই সেই কর্মে ব্রতী হই। ব্যক্তিত্বহীনাদের ব্যর্থ ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব নির্মাণ করি। সংস্কৃতি মনষ্ক সেজে থাকা মানুষদের অনবরত জিজ্ঞাসা করে প্রমাণ করি এরা কেউ সংস্কৃতির মানুষ নয়। এরা সবাই এই শহরের সুস্থ্য সাংস্কৃতিক কর্ম বিনাশের অন্যতম উদ্যোক্তা। আমরা ক্রমশ দারুনভাবে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছি এই নেতৃত্বের দোতনায়। ইতোমধ্যেই এক প্রচারের প্রশার ঘটেছে শহরে। সংস্কৃতি কর্মীদের ঠিকাদারির অংশিদারিত্ব কিংবা কোন আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে। যেটা (নাকি?) ভাগ হয়েছে মাত্র তিন হাতে! অর্থ অংকের ভাগাভাগির গল্পটা এরকম ৮/৫/৩। তাই উল্টো পথে হেঁটেছে তারা। দাঁড়িয়েছিলো মহাত্মার বিরুদ্ধে।
বিশ্বাস করতে চাই না এমন উদ্ভট সত্য। ধরে নিতে চাই এ দুষ্টদের কথা। আমাদের অভ্যন্তরে বিভাজনের প্রয়াস। তারপরেও যদি প্রমাণ মিলে যায় এ সত্য?! তখনো কি ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে (ঐ তিনের) পিছনেই ঘুরবো? না কি ওদের প্রত্যাক্ষাণ করে প্রমাণ করবো, আমাদের এই যাপিত জীবনের উৎসে যে পুরুষ সেই আমাদের পিতা। আমাদের মায়েরা সেই সত্যকে দ্যার্থহীন স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর যারা তা পারবেন নাÑতাদের জন্মের অস্তিত্বের প্রমাণ চাইবার আমরা কেউ নই। তাদেরকে এই সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং রাজনীতির সকল পথের ধুলো একটি নির্দিষ্ট নামে ডাকবেÑ সেই উচ্চরিত ধ্বণি যা আমি আজ কলমে লিখতে ব্যর্থ হলাম।
এই ব্যর্থতার মূল কারণ আমরা যাদের দেখে পাশে থেকে সংস্কৃতির পথে হেঁটেছি, সেই শিক্ষার পথ আমাদেরই অযোগ্যতার কারণে, লোভের কারণে, নীতিহীনতার কারণে এক ভ্রান্ত পথে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই পথের মোড়ে মোড়ে লোভের হাত, নিশীর ডাক, আমাদের নির্লজ্জতার নিন্দাপংকে নিমজ্জিত করেছে। ঠিক জানি না, কে এসে সংস্কৃতির অতীত স্বর্ণালীর সম্মানে এই বিপর্যস্ত বিপুল বর্তমানকে অসভ্যতার গ্রাস থেকে রক্ষা করবে। কে লিখবে কলাপাতার স্পাইরাল বাইন্ডিং খাতায় ‘সবাই ভালো থাকো।’ কে বলবে? ‘ব্যক্তি যদি ব্যক্তি কেন্দ্রিক, সমষ্টি যদি ব্যক্তিত্ব-রোহিত তবে শিথিল সমাজটাকে ভাঙোনা কেন?’ শুধু গান মনে করে সুরে ডুবে গেলে হবে? এই কথার অর্থ বুঝবার দরকার নেই?
লেখক আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য।