পহেলা বৈশাখ থেকে পঁচিশে বৈশাখ ১৪৯২

পহেলা বৈশাখ থেকে পঁচিশে বৈশাখ ১৪৯২

এক ভয়াল যোগ্যতর যোগ্যতার পরিশুদ্ধ নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে নিয়ে কথা বলতে যেয়ে অনেকেই তাকে অনেক অভিধায় ভূষিত করেন। একটু যারা তাকে বাঁকা চোখে দেখতে চেষ্টা করেন, তারাও তাকে নিয়ে বলতে বলতে এক সময় খেই হারিয়ে ফেলে বলতে বাধ্য হন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। ছোটখাটো সমালোচনা সে তো হতেই পারে। কারণ রবীন্দ্রনাথ তো মানুষ ছিলেন। তবে তার পাঁচখানা কবিতা, দুইখানা ছোটগল্প, একটা উপন্যাস, অর্ধেক নাটক পড়ে, দশখানা গান শুনে, বিশখানা ছবি দেখে তেমন বোকামী না করাই ভালো।

তবে সমালোচনা তার আছে। সে তো থাকবেই। কারণ সে যে তার সৃষ্টির আলোচনায় তুঙ্গে চরে বসে  আছেন। সেই সমালোচিত আলোচনাতেই তো সে শুদ্ধ হবে, আরো হৃদ্ধ, আরো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবেন আমাদের জন্য। হচ্ছে তো। কেউ কেউ তো বলছেন, রবীন্দ্রনাথ একই শিরনামে একাধিক কবিতা লিখেছেন। কেউ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ একটি গান লেখার পরে বহুবার সেটা কেটেকুটে পরিশুদ্ধ করেছেন। ‘দেখা যায় একটি গান সে পাঁচবার তার মতো করে সুরে, শব্দে, অর্থের প্রয়োগিক ভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সে ঐ পাঁচটিকেই (গান বা কবিতা) রেখে দিয়েছেন। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। যার ফলে ওর একটিকে শুনলেই মনে হয়, এর আগে কোথায় যেন শুনেছি।’ এমন ছোট বড় বেশ কিছু কথা আছে তাকে নিয়ে। তবে বোধকরি সে গান আর কবিতাতেই সীমাবদ্ধ।

তার সৃষ্টির অন্য কোথাও অন্য কোনখানে এমন বিষয়ের আর কোন উল্লেখ নেই। না কেউ না। এমন কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় নাই। না, কেউ দেখাতে পারেনি চার অধ্যায়, তাসের দেশ, রক্ত করবী কিংবা বিসর্জনের কোথাও কোন অর্থ-শাব্দিক মিল। কে আছে আর ঠাকুরের বিসর্জনের মতো লিখতে পেরেছেন পশুবলী প্রথা বন্ধের কথা? কে অতো সহজে বলতে পেরেছে, ধর্মের গোড়া রূপ কি বিভৎস্য পারে রক্ত সোপান তৈরি করতে? কেউ কি লিখবে আর তার মতো ‘যতোই সংক্রান্তিতে সত্তর পদ তিতার স্বাদে বিদায়নিক বেলা, তবু জানি কমবে না কোন ঘর-পরিবারের বিস্বাদের সে জ¦ালা।’ যেমন কমেনি, থামেনি মনুষ্য পশুবৃত্তি যুগযুগের অজস্র পশু কুরবানীর পরেও। এ কেবলই আচার, অন্য কিছু নয়। তার থাকে সুযোগ সামাজিক বিভাজন তৈরি করে দেবার।

একবার রবীন্দ্রনাথ তার ভ্রমণ পথের সহযাত্রীদের কিছু কথা তার ডাইরিতে লিখে ছিলেন। ‘প্রথমে দারুন জ্ঞানী ভেবে ছিলাম ওদের। পরে জ্ঞান করলাম বিজ্ঞানী নয়তো? তার কিছু বাদেই বুঝলাম জ্ঞানের কোন শাখাই বিশেষত অংক, জ্যোতিশাস্ত্র, ডাক্তারী, মোক্তারি কিছুই বাদ রাখলো না। বিস্ময়ে ভাবছিলাম, বাহ বেস। এমন ভুল সমৃদ্ধ জ্ঞানী সে তো বড় কম ভাগ্যে মেলে না। এ রকম নানান অদ্ভুত, বিস্ময়কর, বেশ মজাদার উপলব্ধিতে ভরা ছিলো ডাইরির সে লেখা। সেই বর্ণনার শেষে এসে যাত্রীদের মধ্যে একজন যখন বলছিল ‘না আর বলেন না বুঝলেন, ইংরেজি বলতে বলতে এখন বাংলাটা আর আসে না’ রবীন্দ্রনাথ তখনই তার ডাইরিতে লিখলেন ‘বাংলাটা ভুলিয়া গেছ দুঃখ নাই, তবে আক্ষেপ হয় ইংরেজিটাও তো ভালো করিয়া শেখো নাই।’

এই মূর্খরা কি কোনদিন জানতে পারবে ঠাকুরের এই আক্ষেপের কথা, তার এই তিরষ্কারের কথা? জানবে না, কারণ মূর্খরা নিজেরা পড়ে না। অন্যকে পড়তে বলে, জানতে বলে। তবু একদিন আমায় একজন বলেছিল আমি কোথায় যেন লেখাটা পড়েছি। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলাম এই লেখা ঠাকুর আর কোথাও লেখেন নাই। সেই থেকে মনে আমার দ্বন্দ¦ এখনো। কি জানি ওর কথা তো সত্যও হতে পারে। তা ছাড়া কটা লেখা পড়েছি আমি ঠাকুরের? তা হলে কি করে বলি আমার কথাই ঠিক?

আজ তার ১৫২ তম জন্মদিনেও রবীন্দ্রনাথ চীর নূতন, উজ্জল, জ্যোতির্ময়। তার পরেও কিছু মানুষ, যারা মানুষের মতো দেখতে। তারা, অড়ালে, আবডালে রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িক ভাবনা নিয়ে কথা বলে। শেষ পর্যন্ত বলে, কোন কোন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একটু আধটু সাম্প্রদয়িক ছিল! কি কিছু কম শুনেছেন কি? হ্যাঁ, বলে কিছু জ্ঞান পাপিরা। যারা নজরুল ইসলামকেও কাফের বলেন!
তাই বলে কি ক্ষুব্ধ হবো? আঘাত করবো, নাই করে দেবো? না রবীন্দ্রনাথ সে কথা বলেন না। তার কথা ‘যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিসনে কিছু।

                       আজকে তোরে কেমন করে অঙ্গে যে তোর ধূলো দেবে
                     কাল যে প্রাতে মালা হাতে, আসবে রে তোর পিছুপিছু
                     যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিসনে কিছু।

এইতো রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের পথ দেখায় সকল অন্ধ রুদ্ধ অমানিশায়। যে আমাদের শক্তি দেয় সকল বিপর্যয়ে ঘুরে দাঁড়াবার। আজ ভেবে ছিলাম যা বুঝি তাই নিয়েই চলবো। এ ভাবনার শিরনাম দেবো পহেলা বৈশাখ চলেছে পঁচিশে বৈশাখের পানে। হলো না, দেখলাম পুরো বিষয়টাই উল্টে গেলো। কি করবো,  যে যার হাত ধরে বড় হয়েছে তাকে আমি কেমন করে পাল্টে দেবো? সুতরাং যা অবধারিত সেই পথে চলি, তার কথা বলি। আমাদের নিয়ন্ত্রক হোক পরিশুদ্ধ সময়। সে যেন আঁধারময় না হয়।

সমসাময়িক সময়গুলো ঠিক কতটা বিপর্যস্ত হলে তবে তাকে বলা যায় অদ্ভুত সময়? জীবনানন্দ দাশ তার সমসাময়িক সাহিত্য সময়ের দ্বারা কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বা তাদের ধারা নির্গত আঁধারের ব্যাপ্তি কতটা অনুধাবন করতে পেরে, তবে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন অদ্ভুত আঁধারের কথা? সে কথা কি আমরা জানি, জানতে পারি, চেষ্টা করি? যদিও বা জানতে পারি তাকে মানতে পারি কি, কে পারে? না কেউ না।

এ কথাগুলোতে সব থেকে কম বিশ্বাস ঐ আঁধার নির্মাতাদের। কেন? উত্তর খুবই সহজ। কারণ ওরা আঁধার বোঝে না, দেখে না। কেবল দেখাতে চায়। ওরা বোঝে না আঁধার যখন ঘনায়, কোনো আলোর কি শক্তি থাকে তাকে নাই করে দেবার? সবাই জানি আলোর খুব প্রয়োজন। তার পরেও জানি এই প্রয়োজনই শেষ কথা নয়। যদি অন্ধকার ঘুরে না দাঁড়ায়! এর সবকিছুরই প্রয়োজন। যখন যেটা যার সয়।

মাত্র সেদিনের কথা। বাংলা ১৪০০ সাল। ১লা বৈশাখ শুরু। বরিশাল নাটক উদীচীর ঘরে সাজ সাজের উদ্যোগ। সর্বত্র রঙ আর রঙিন করে তুলবার সাজ। সবকিছুই রঙিন। হাতি, ঘোড়া, কুমির, হরিণ কিংবা সাপ অথবা ময়ূর। সর্বত্রই যেন চারুকলার শিল্পীদের অপ্রাসঙ্গিক রঙের বাহার। তবু কোন প্রশ্ন নেই কারো। সবাই যেন জানে বৈশাখের এই আয়োজনে হাতিও হতে পারে হলুদ, সবুজ ঘোড়া সে-ই যেন সত্য। ফড়িং এর রঙ কে ভুল ধরে তার? এমন সপ্নীল আয়োজনে বাঘের পাখা থাকবে সেইতো সঠিক।

১৪০০ সাল। শতাব্দীর পরিবর্তন বলে কথা। অতএব ত্রিশ চৈত্র উদীচী সিদ্ধান্ত নিলো, ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের পাশে (বর্তমান কাঞ্চন পার্কে) লাগানো হলো একটি বটবৃক্ষ। প্রথম স্পর্শ করলেন দেবেন ঘোষ। একটি খাতায় স্বাক্ষর দিলেন উপস্থিত সবাই। তার পর কেটে গেলো কতটা সময়। আজো আছে প্রভাতী অনুষ্ঠান। লাল শাড়ি পরে, লাল পাঞ্জাবী গায়ে প্রভাত সমীরণে উচ্চারণ ‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ।’ আছে ঢাকের শব্দে রাখি বন্ধন। পূবের আকাশে সূর্যালোকে গাছের পাতায় ছায়া হয়ে নেমে আশা আলোয়, সুরের মুর্ছনা। নম: নম: নম: বাংলাদেশ মম, চীর মনোরম চির মধুর।’ আছে প্রাণের উচ্ছ্বাস নব বর্ষের সুরের আহ্বান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ অমিত সুরের এই ব্যাঞ্জনা আজো বেজে চলেছে কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে, সত্য, প্রেম, পবিত্রতার বেদীমূল ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। যে ধারার ¯্রষ্টা উদীচী বরিশাল। যে উদ্যোগ বাঙালির আবহমান ধারার দিয়েছে বৈশাখী মেলার ব্যাপ্তি। শহরে বিস্তার ঘটিয়ে ছিলো মঙ্গল শোভাযাত্রার।

যে প্রয়াস ছিলো এই শহর সাংস্কৃতিক কর্ম উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত সবার। তারপর ধীরে ধীরে প্রভাতী অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং ব্রজমোহন বিদ্যালয়, যেন এক শব্দ এক রূপের সমার্থক হয়ে দাঁড়ালো। এর শুরুটা এমন ছিলো না। এটা ছিলো বদিউর, অনুতোষ, মানব, দীপংকর, আ: মতিন, জাহাঙ্গীর সহ অল্পকিছু মানুষের স¦ারসত স্কুল কেন্দ্রিক, ব্যাপক উচ্ছ্বাসময় কাঁচা মস্তিষ্ক প্রষূত আয়োজন। হাটে কেনা ফল, হাতে তৈরি ফুল, নিজেদেরই রঙ করা মাটির বাসন। এলো ক্রেতা, এলো দর্শনার্থী। শহরময় অস্তিত্ব ঘোষিত হলো উদীচীর বৈশাখী মেলার। মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততায় অচিরেই ধারণ ক্ষমতা হারালো স্বারসত স্কুল মেলার মাঠ। মেলা সম্প্রসারিত হলো বি. এম. স্কুল মাঠে। সেই ব্যাপকতার টান কিংবা প্রয়োজন তাকে ক্রমশই করেছে জটিল। কেবল মাত্র শুরুর দিকের মানুষেরা যারা বিশ^াস করতো, মানুষের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক কর্মধারাকে যথাযথ লালন, নিজেদের সংস্কৃতিবান থাকতে সহায়তা করে। সেই বিশ্বাসের সম্প্রসারিত পথেই উদীচী তাদের মেলায় সংযুক্ত করলো মঙ্গল শোভাযাত্রার। সৃষ্টি করলো সংগঠন, বরিশাল চারুকলা। সেই চারুকলা একদিন যারা উদীচীর নিবিড় ছায়ায় রঙ সহযোগে এঁকেছে প্রকৃতির রূপ, বানিয়েছে বাঘ, সিংহ, ঘোড়া, কুমির, ময়ূর কিংবা প্রজাপতি। একদিন সেই নবীশরাই শিক্ষার্থী হয়েছিলো চারুকলা ঢাকার। ক্রমশ তাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করলো ভাবনার রঙ, তরুন্যের উচ্ছ্বাস, সঙ্গে যুক্ত হলো (ভিন্ন আইডেনটিটি) পরিচয়ের উচ্চাকাঙ্খা। বিতাড়িত হলো সাংস্কৃতিক দায়। তারপর একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত। কোন রকম পূর্বালোচনা ছাড়াই আতুর ঘরের বিনাশ ঘটালো চারুকলা। সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম আমরা অনেকে, উদীচীর বঙালি এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তা যাদের গাত্রদাহ ছিলো, আছে এখনো!

পথ হারালো মঙ্গল শোভাযাত্রা। উদীচী, আর ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সকল বন্ধন নিঃসংকোচে দ্বিখন্ডিত করে চারুকলা পা বাড়ালো এক নূতন পথে। বিস্মিত উদীচীর দায় পড়লো মঙ্গল শোভাযাত্রার আতুর ঘরের বাতি জ¦লিয়ে রাখবার। তারা সফল হলো, অস্তিত্বের প্রগাঢ় প্রয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখলো। সফল হলো চারুকলাও নূতন ঠিকানায় তাদের কার্যক্রমের সফল রূপ দিতে। এখন এই শহরে দুই শোভাযাত্রা, ঠিক জানি না সে কতটা মঙ্গলময়। তবে যদি একটি করা যেত তবে প্রশাসনের নুতন করে আর একটি মঙ্গল যাত্রার রূপ নিয়ে ভাববার প্রয়োজনই পারত না। তারা অনায়াসেই মিলে যেতে পারতো তার সাথে।

সেটা এখনো হলো না। জয় পরাজয় প্রশ্নবিদ্ধই থাকলো। তাই বৈশাখ এলে, অন্তত প্রকাশ্যে উদীচীর কর্মীরা জানে না কি হচ্ছে চারুকলায়। চারুকলাও তদ্রুপ জানতে চেষ্টা করে না উদীচীর মঙ্গল শোভাযাত্রার ঔজ্জ¦ল্য কতটা বেড়েছে। কেনরে বিধাতা এমন হলো, কারা করলো এমনটা? কারা এই দুই সংগঠনের সমস্ত কর্মীদের ঘুম হারাম করে দিয়ে তাদের নিজেদের ঘুম নিশ্চত করলো? এ যেন বৃটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসির সফল প্রয়োগ।

কার নাম বলবো, কে বা কারা এই নষ্ট বৃটিশ? আমি, আপনি, স্থানীয়, না কি দূর নিয়ন্ত্রণে অন্য কেউ? অনেকটা সময় ধরে অনেক দূর হেঁটেছে শোভাযাত্রার এই বিভাজিত রূপ। না, আপন মহিমায় নয়। না নয় কোন নির্মল মঙ্গল উত্তোরণের পথে। যতটা পথ হাঁটবার কথা ছিলো তার, ততোটা পথ সে অতিক্রম করতে পারেনি। কারণ চলার পথে ঘাটে ঘাটে তাকে হয়তো মাশুল গুণতে হয়েছে অনেক। গুণতে হয়েছে টাকায়, পদে, অবস্থানে আর অস্তিত্বের প্রগাঢ় প্রয়োজনে। তার পরেও চারুকলার যা যা করণীয় ছিলো শুরু থেকে, তার যতোটুকু করতে পেরেছিল তারা। বিভাজিত এই দ্বন্দ্বে  উদীচী তা করে দেখিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে। তারা প্রমাণ করেছে, এই শহরকে দেখিয়ে দিয়েছে প্রশ্ন করে ‘হে চরুকলা কোথা থেকে তুমি এলে?’

তবুও বলি এ কারোরই বিজয় নয়। এ ছিল চরম বোকামী চারুকলা এবং উদীচীর, সর্বোপরি সবার। যে করণে বৈশাখী প্রভাতটা নির্মলতা দিয়ে নয়, একটা চাপা অসুন্দর দিয়ে শুরু হয় আমাদের। যেন প্রাণের উচ্ছ্বাসটা একটা দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে কেউ ঢেকে রেখেছে। প্রাণ যেখানে হাসপাস করছে, পাখা ঝাপ্টাচ্ছে, তবু মুক্ত হয়ে উড়তে পারছে না। উদার মানবিক মঙ্গলের এই প্রাণময় পাখিটাকে উড়তে দিতে হবে। এ দায় আমাদের। যারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষকে মানবিক উদার মানুষ করে তোলে। আত্ম হননকারী নয়। আজ আমরা এই উদ্ভুত পরিস্থিতি অতিক্রম করতে যেয়ে যেন নিজেরাই নিজেদের হত্যা করে চলেছি। ছি ছি ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে চারিপাশ। তবু যেন শুনতেই পারছি না। অহংকার, দম্ভ আর অসাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের দুষ্ট হাওয়ায় ওড়া ধূলো, আমাদের স্বচ্ছ পথ দেখতেই দিচ্ছে না। চোখ থাকতেও অন্ধের মতো হাঁটা কখনোই মানুষের কাজ নয়। সুতরাং এই শহরে চলা নববর্ষের প্রভাতে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিভাজন আর কাম্য নয়।

এ সম্ভব। দায়িত্ব নিতে হবে উদীচী এবং চরুকলাকেই। আমাদের থাকতে হবে সজাগ। বিভাজনের সুচারু হাত যেন সম্প্রসারিত হতে না পারে। উদীচী বিশ্বাস করে তাদের সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক বোধের উন্মেষ, সাধারণ মানুষের প্রতি দায়। ব্যক্তির বৈসয়ীক লাভের কোন গুরুত্ব সেখানে নেই। বিষয়টি মাথায় রেখে উভয় সংগঠনের নেতৃত্বের উচিত শোভাযাত্রার বিষটির একটি সম্মানজনক সমন্বিত (যা অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক দায় সমৃদ্ধ, অবশ্যই ব্যক্তি স্বার্থজনিত নয়) সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। সুদূর প্রয়াসী সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনায়, প্রয়োজনে আজ অথবা এখনি। নয়তো এর নিয়ন্ত্রক হবে অন্য কেউ। হতে পারে তার নাম রাজনীতি কিংবা প্রশাসন। আমরা অনেকেই এদের কাছে পাশে থাকি, এমন একটি দুষ্ট সমাধান নিয়েও তো ভাবি! করতে পারলেই নিয়ন্ত্রক হবো আমরা।

অতএব এর সমাধান জরুরী এবং সম্ভব, এ হওয়া উচিত। সাপ, কুমির, গাধা, ঘোড়া বাননোর চেয়ে এটিকে কঠিন ভাববার কোন অবকাশ আছে সে বিশ^াস করা যায় না। এখন দুষ্ট বধের সময়। আমাদের ভুলে ভরা বিভাজনের ব্যর্থতা যদি একবার দুষ্টদের হাতে পাশার চাল বনে যায়। তখন শোভাযাত্রার মঙ্গল নয়, আমাদেরই প্রাণ বাঁচানো দায় হয়ে যাবে। ঠিক জানি না, সেই সময়টা কত দূরে। মঙ্গলময়তা আজ অমঙ্গলীয় হাতের টানে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। এড়াতে পারছি না নিজের দায়টুকুও। 

যশোর চারুপীঠের শিল্পী শামীমের দেখানো ও নির্দেশিত পথে এবং হিরন্ময়ের সহযোগিতায় যে বৈশাখী শোভাযাত্রার শুরু সেটা ১৩৯৩ সন অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শুরু করে ১৯৮৯ সালে। প্রখ্যাত সঙ্গীতাজ্ঞ ওয়াহিদুল হক ও ভাষা সৈনিক এমদাদ হোসেনের পরামর্শে ১৯৯০ সালে বর্ষ বরণের শোভাযাত্রার নামকরণ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যতদূর জানা যায় এ-ই সত্য। শিল্পী শামীমই এই বিস্ময় কর্মের জনক। এই কঠিন সত্যকেও মাটি চাপা দিতে চাচ্ছে কিছু জ্ঞান পাপী। কেউ কেউ বলছে বটে, ওরাও রঙেরই মানুষ অর্থাৎ শিল্পী। তাদের এই অতিরঞ্জনও থামানো দরকার। নয়তো সত্য মরে যাবে। যেমন মেরে ফেলা হয়েছে এই শহরের মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস। সময় আছে এখনো, ‘ফিরে চল মাটির টানে, যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ 

কথায় নয়, বিশ^ ব্রহ্মান্ডের জ্যোতিশাস্ত্র বিশ্লেষণে নয়, পঞ্জিকায় নয়, আকবর কিংবা গ্রেগরিয়ান হিসাব নয়, ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর দিন গণনার হিসাবটিও নয়, গ্রহ-নক্ষত্র, চাঁদ-সূর্যও নয়রে পাগল। মিলতে হলে আত্মার শুদ্ধির মিল থাকতে হয়- সম্প্রীতির বন্ধনে। ধার করা জ্ঞান চালাকি দিয়ে নয়।


লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।