পিনাকীর প্রশ্নে উত্তর বিপর্যস্ত

পিনাকীর প্রশ্নে উত্তর বিপর্যস্ত


কখনো কোন ঘটনার আকস্মিকতা আমাদের মনপ্রাণকে একেবারে জাপটে ধরে ফেলে। যে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বাভাবিক হওয়া অনেক কঠিন কষ্টের হয়ে যায়। তার পরেও আমরা স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করি। কারণ আমাদের চলতেই হয় এ সকল ভার কিংবা আকস্মিকতাকে মানিয়ে অথবা অতিক্রম করেই। এই মুহূর্তে তেমনই এক মানষিক চাপে দারুন বিপর্যস্ত আছি। বিষয়টি নিজ সন্তানদের একজনের উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষায় হোঁচট খাওয়াকে ধারন করতে দারুন কষ্ট হচ্ছে। জানি একই কষ্ট হচ্ছে সন্তানদেরও। ওদের শিক্ষা জীবনে ওরা বহুবার আমাদের সন্তষ্টি এনে দিয়েছে। সেই সময় শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে হয়তো কোথাও অহংকার ছিলো। বোধ করি এই কষ্ট তারই পরিনাম। তবু বিশ্বাস রাখি এই কষ্ট কেটে যাবে সন্তানদেরই সফল প্রচেষ্টায়। যদিও এও জানি  এমনই কষ্টে জর্জরিত আছে দেশের অজ¯্র অভিভাবক আর তাদের সন্তানেরা। উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংকুচিত স্থান সম্প্রসারণের ব্যর্থতা, প্রশ্নাতীতভাবেই এই রাষ্ট্রের চিন্তা ব্যবস্থাপনার। যেখানে কেবলই প্রাধান্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং পুনঃনির্মণ। তাকে কার্যকর করবার জন্য যে শিক্ষিত মানব সম্পদের প্রয়োজন। সেই মানসম্মত জাতীয় পথ নির্মাণের পথে কেউ নেই!

এই যখন মনের অবস্থা ঠিক সেই সময় একজন অনলাইনে একটি লিংক পাঠিয়ে নিচে লিখে দিলো। দ্যেখো শোন অভিব্যক্তি জানাও। আমি দেখলাম, শুনলাম। স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং বাকরুদ্ধ হলাম। অভিব্যক্তিতে লিখলাম ‘এতো মুরগীর ফিস ফ্রাই’। দেখলাম লিংকের শ্রষ্টা পিনাকী ভট্ট্রাচার্য। শিরনাম ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কি হিন্দু রাজাকার ছিলো না? ছিলো।’ এই বলে তিনি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজাকারের তালিকাকে ইঙ্গিত করে শুরুতেই আঙুল তুললেন, এই শহরের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু পরিবারের দিকে! যে পরিবারের প্রধান মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানীদের হাতে ত্রিশ গোডাউন এলাকায় নিহত। যার এক সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাতাপ্রাপ্ত। এই মুক্তিযোদ্ধা এবং তার মায়ের নাম প্রকাশ পায় ওই রাজাকার তালিকায়! এখানেই পিনাকীর প্রশ্ন ‘কি করে একই লোক রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে?’ যে বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার এক সন্তান এই শহরের একজন প্রগতিবাদী নারী নেত্রীও বটে।

এই একই ধারাবাহিকতায় পিনাকী আরো উল্লেখ করেছেন শহরের আর এক পরিবারের কথা। যে পরিবারের দুই সন্তানই বর্তমানে বরিশাল আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা! যাদের বাবা ছিলেন শান্তি কমিটির একজন সদস্য। যার এক সন্তানের নাকি ছিলো রাজাকারের ট্রেনিং? পিনাকীর মতে অন্য সন্তান আওয়ামী লীগের অত্যন্ত সক্রিয় নেতা যার মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তিতে বাধা দিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তার দালিলিক উপস্থিতিও আছে ওই লিংকে। একই সাথে এও জানা যায় এই সংসদই নাকি এক যথার্থ মুক্তিযোদ্ধার, অমুক্তিযোদ্ধা ভাইকে তালিকা ভুক্তিতে সর্বাত্মক ব্যস্ত রয়েছেন!  যার পক্ষের প্রস্তাবকের ভূমিকা নিয়েছেন একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাই! এ কথাগুলিও শহরের মানুষের মুখেমুখে ফিরছে। পিনাকী তার লিংকে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন এই শহরের কয়েকজন হিন্দু রাজাকারের নাম এবং তাদের সুস্পষ্ট তথ্য।

আসলে আমরা কোন কোন পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। যে কারণে প্রায়শই খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই সত্যের আড়ালের আসল সত্য। তবে পিনাকীর এই লিংক একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে। সেটা হলো, ‘পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে যে বা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে, মনে প্রাণে চিন্তায় চেতনায় কোন না কোনভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে তারা সবাই রাজাকার। তার আবার ধর্ম বিচার কি? এ সময়ে যারাই আগুন, ধর্ষণ, হত্যা, লুন্ঠণ কর্ম সংগঠিত করেছে তারা রাজাকার। ‘রাজাকারের ধর্ম বিচার জরুরী নয়। জরুরী তার কর্ম বিচার।’ যে বিচারে আমাদের ভুল আছে। কখনো কখনো ভুল করানোও হয়েছে।

তা না হলে এমন একটি বিস্ময়কর আলোচিত বিষয়ের কোথাও কোন আলোচনা নেই কেন? সবাই কেন নিশ্চুপ? এ কিসের আলামত? যে দুটি পরিবার নিয়ে কথা বলেছে পিনাকী সে কি সব সত্যি? কোথাও কি মিথ্যার লেশমাত্রও নাই? যদি বিন্দুবিসর্গও থেকে থাকে, আর সেটা জেনেও স্বীয় স্বীয় পরিবার যদি চুপ করে থাকে। তবে সেটা দুঃখের, বিপদের, বিস্ময়ের, লজ্জার এবং সর্বপরি কষ্টেরও বটে। কেন এমনটা হবে, এটাতো ঠিক নয়।

যে পিনাকীকেই ইদানিং মনে হচ্ছে, তার সমসাময়িক দেশকাল বিষয়ের উক্তি উপলব্ধিগুলি সম্পূর্ণ রাজাকারসম। তাকে কেন ছেড়ে কথা হবে, তার কেন বিষদগার হবে না প্রকাশ্য রাজপথে? যেখানে সর্বসাধারণ সম্পৃক্ত হবে, হবে প্রতিবাদ এমন মিথ্যার। নয়তো মেনে নিতে হবে পিনাকী উচ্চারিত সত্য। তবে একটা কথা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সেটা হলো, পিনাকী কেন কার প্ররোচনায় এমন একটি কাঁচা পাকা সত্যের অবতারণার প্রয়াশ পেলো? তাকে কি কেউ লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, সম রাজনৈতিক আদর্শের ভিত রচনায়, অর্থ কিংবা অনুরোধে? আমরা ঠিক জানি না।

তবে কোন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আশাহত হলে কষ্ট হয়। ধারন ক্ষমতারিক্ত কোন ভার বহন করতে হলে কষ্ট হয়। সন্তানেরা স্বার্থকতার পথে হোঁচট খেলে কষ্ট হয়। পরিবার, দেশ, বিপর্যস্ত হলে কষ্ট হয়। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার উৎকর্ষতায় একজন জেলা প্রশাসককে স্যার সম্বোধনে ব্যর্থ হলে কষ্ট রুদ্ররূপী হয়। আবার প্রতিবাদী শিক্ষককে স্যার সম্বোধনে সালাম না ঠুকলে সেও কষ্ট পায়। ঠিক জানি না এই সুযোগে কোন ছাত্র ওই শিক্ষককে ভাই সমেবাধন করলে তিনি কি করবেন, প্রতিবাদী হবেন, অবস্থান গ্রহণ করবেন ওই ছাত্রের ক্লাসের সামনে? না কি তাকে বুকে জড়িয়ে নেবেন? ঠিক জানি না। এই ঘটনার পরে দারুন স্যার সম্বোধন প্রত্যাশীরা তাদের রূপ কতটা পাল্টাবেন, পারবেন কি? আদৌ কি তা সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি যত সহজ এর উত্তরগুলি ততাধিক জটিল।

এই কারণে একজন পিনাকী যে প্রশ্নের অবতারণা করেছেন আপাতত তার মুখোমুখিই তো হতে পারছি না আমরা। তার সত্য মিথ্যার বিচার তো দূরস্থান। তবে একটি বিষয় বড় সহজিকরণ করা গেছে তা হলো, একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির সঙ্গসাধন করতে পারলে রাজাকারও বৈধতা পাবে মুক্তিযোদ্ধা রূপে। আর অন্য কোন রাজনীতির সঙ্গ নিলেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও হয়ে যাবে রাজাকার! দেশব্যপী এই অদ্ভুত রূপের সহনশীলতা আমাদেরকে হঠাৎ বিপর্যস্ত করে ফেলবে নাতো? অযাচিত এই আশংকার একটিই কারণ। যে কারণের অপার বিচ্ছুরণ আছে আমাদের চোখে, মনে, মেধায়, কেবল আটকে গেছে মুখের ভাষায়! ঠিক সেই কারণেই আমাদের চারপাশের সকল জিজ্ঞাসা সূচক প্রশ্নগুলি কঠিন নিয়ন্ত্রণ রেখায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এও স্পষ্ট এবং কঠিন সত্য, এই সময়ে একই সাথে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা উন্নয়নের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চূড়া স্পর্শ করেছে প্রশ্নাতীতভাবে। এই সফলতার আসল রহস্য সকল ভিন্ন মত ও পথের স্তব্ধতা! এটি যেমন এই সময়ের সব থেকে বড় সফলতার কারণ, তদ্রƒপ এই বিষয়টিই হয়ে উঠতে পারে আগামী পথের সব থেকে বড় অন্তরায়।

লেখক: আজমলহোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।