বাড়বে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থামবে মনোনয়ন বাণিজ্য

বাড়বে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থামবে মনোনয়ন বাণিজ্য

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই দেশজুড়ে বইছে উপজেলা নির্বাচনের হাওয়া। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটের ময়দানে থাকছে না দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’। ক্ষমতাসীন দলের এমন সিদ্ধান্তের পর কনকনে শীতেও তৃণমূলে ভোটের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে আশা ও আশঙ্কা। নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ায় তৃণমূলের কিছু প্রভাবশালী নেতা, সংসদ সদস্য ও কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতার মনোনয়ন বাণিজ্যের পথ বন্ধ হচ্ছে। সেইসঙ্গে কমছে স্বজনপ্রীতি ও নিজ বলয়ের অযোগ্যদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ। এসব কারণে নৌকার প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণায় হতাশ হয়েছেন অনেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা। বিভিন্ন পর্যায়ের মনোনয়ন সিন্ডিকেটেরও মন খারাপ। যদিও নেতাকর্মীদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে দলীয় নেতাদের প্রার্থী হওয়ার অবাধ সুযোগ তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তীব্র করে তুলবে বলে কারও কারও আশঙ্কা।

জানা গেছে, গত সোমবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকারের মধ্যে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান আছে। সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ। সেই সুযোগে দলের ৫৯ জন নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তবে ওই নির্বাচনে বিভিন্ন এলাকায় নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো এলাকায় সেই দ্বন্দ্ব এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় দলীয় ও স্বতন্ত্র পরিচয়ে বিভক্তি রোধে উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-কোন্দল হ্রাস পাবে বলে দলটির নীতিনির্ধারকদের আশা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘তৃণমূলে যে স্বতন্ত্র-নৌকার প্রার্থীর দ্বন্দ্ব, তা কমে আসবে। দলের ভেতরে কোন্দল থাকবে না। ভোটে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। একই সঙ্গে মনোনয়ন ঘিরে যে অনিয়ম, তা থাকবে না।’

তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। সারা দেশের জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তাদের মতে, মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে তৃণমূলের ভূমিকা খুবই নগণ্য। মূলত শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা থেকেই দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; কিন্তু এতে দলের কোন্দল ও বিভেদ তো কমবেই না বরং আরও বাড়বে। কারণ, যে কেউ ইচ্ছা করলেই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাবেন। দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ফলে আগের গ্রুপিং আরও তীব্র হবে এবং প্রার্থীদের কেন্দ্র করে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। ভোটকেন্দ্রিক এই বিভেদ বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে। সেইসঙ্গে নির্বাচনে হেরে গেলে পরাজিত প্রার্থী কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তুললে তা দল ও সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে।

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান কালবেলাকে বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে দলে অনৈক্য আরও বাড়বে। স্বতন্ত্র ও নৌকার প্রার্থীর মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বেড়াজালে যেভাবে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হলো, উপজেলা নির্বাচন কিন্তু সেভাবে পাড়ি দেওয়া যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের রেশ উপজেলায়ও থাকবে। দলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা কষ্টকর হবে এবং এই অনৈক্য বাড়তে থাকলে ক্ষতবিক্ষত হবে আওয়ামী লীগ।’

তৃণমূলের নেতারা জানান, স্থানীয় সরকারে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরুর পর থেকে দলীয় মনোনয়ন পেলেই বিজয় নিশ্চিত—এমন ধারণা তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে। ফলে অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী নির্বাচনী মাঠ গোছানোর চেয়ে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতেই বেশি মরিয়া থাকে। আর তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত একটি বিশেষ চক্র এর সুযোগ নিচ্ছে। মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নামে তারা আর্থিক ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। এদের প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দলের যোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়নবঞ্চিত হন। তৃণমূলের মতামত ও বিভিন্ন জরিপের ওপর ভিত্তি করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড। তৃণমূলের মতামতের নামে গোপনে লেনদেন, স্বজনপ্রীতি, বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেওয়ায় অনেক যোগ্য প্রার্থীর নামই সুপারিশ করে না কেন্দ্রের কাছে। ফলে যোগ্যতা থাকলেও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া হয় না অনেকের। এ মনোনয়ন বাণিজ্যের পাশাপাশি স্থানীয় বা কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যদের ভূমিকার কারণেও ত্যাগী নেতাদের অনেকে দলের মনোনয়নবঞ্চিত হন। টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভেদ, যা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলেরই অনেক নেতাকর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর প্রভাবে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিলে বেশিরভাগ জায়গায় একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে এবং দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেই নির্বাচনে অংশ নেবে। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্ন আসবে। সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতেই উপেজলা নির্বাচন উন্মুক্ত রেখে দল নিজের সম্মান রক্ষা করল।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘দলের নেতাদের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে নৌকার বিপক্ষে অনেকে ভোট দেয়, সে বিষয়টি থাকবে না। বিভেদ ও মনোমালিন্য কমে আসবে। শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার ফলে ভোটের হার বাড়বে। ফলে উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ নির্বাচনে তৃণমূলে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না মিললেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে শুনেছি, এবার এসব একেবারেই থাকবে না।’