বাড়ি গেলেই বউ জিগায়... ঠিকভাবে বাঁচতে হলে লাফানিটাও শিখবার বিষয়

বাড়ি গেলেই বউ জিগায়... ঠিকভাবে বাঁচতে হলে লাফানিটাও শিখবার বিষয়

আজকাল সত্য কিংবা মিথ্যা যে যাই লিখুক না কেন, সেটা পত্রিকায় ছাপাতে হলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। ভাবতে হয় নিজের এবং কাগজের অস্তিত্ব এবং স্থায়ীত্বের কথা। কারণ স্পষ্ট। পত্রিকার বিপদ ডেকে কোন সত্য নয়। কোন সত্য নয় যদি সে স্বাভাবিক প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এই সত্য ধারণ করতে ব্যর্থ হলে কলম চালানো কেবল কঠিনই নয় একদম নামুনকিন। তা হলে প্রত্রিকাগুলো কি ছাপে, তাতে যারা লেখে কেন এবং কি লেখে? এই যে কালো কালিতে একদম ঢেকে যায় পত্রিকা নামক কাগজ। সেই অক্ষরগুলো আসলে কি? অর্ডার মাফিক রান্না করা খাবার সরবরাহ? তাও কি স্বাধীনভাবে এখন সম্ভব। ঝাল, নূন, তেল নির্দেশের বাইরে হলেই বিপত্তি নয়? আর বোকারা ছাড়া স্বেচ্ছায় এমন বিপত্তি কে ডেকে আনে?

এখন কলম কালি ছাপাখানা সবাই সিঁদ কাটা চোরদের মতো গায়ে তেল মেখে চলে। যাতে কারোর কোথাও ধরা পরবার কোন সুযোগ তৈরি হয়ে না পড়ে। আর নিজগুণে না হলেও দৈব গুণেও কখনো ফেঁষে গেলে, মুহূর্তের মধ্যে রূপ পাল্টে সকল কিছু ম্যানেজ করে চলে। না এ কারো দোষ নয়। বেঁচে থাকবার জন্য এগুলো সময়ের দাবী। রাজনীতির ভাষায় বাঁচবার অধিকার। যা বিশ^ব্যাপী নিয়ন্ত্রিত হয়  নেতা নাম শক্তিধর এক শব্দের দ্বারা। স্থান কাল পাত্র ভেদে এই শব্দ রূপের ভিন্নতা আছে। যেমন দাদা, গুরু, ভাই, স্যার, বস, আভিভাবক ইত্যাদি। কেন হবে না? নেতা কর্মী, চাকর মালিক, কর্তা কর্মচারি, সে কি কখনো সমন্তরাল কোন ব্যাপার? এটা কি কোন না বোঝা সহজ সমাজতান্ত্রিক যুক্তি, যেখানে সকলেই সমান? আর্থাৎ উঁচু নিচু শব্দের কোন ভিন্নতা নেই? আছে তো। যেখানেই স্বাদের আক্ষেপ সেখানেইতো তার জন্ম। 

ছোট একটি উদাহরণ। মাত্র শেষ হলো এই প্রিয় শহর বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। একজন মেয়রের সময় নির্ধারনী শেষ হওয়ায় পূর্বেই আর একজনের বিজয় ঘোষিত হয়ে গেলো। হয়ে গেল শপথ বাক্য পাঠ। তবে কি আর রইলো বাকি? আমরা শহরবাসী বা নির্দিষ্ট রাজনীতির সমর্থক কিংবা দর্শক তারা এই নির্বাচনের টক ঝাল মিষ্টি সকল স্বাদের বিচ্ছুরণ পর্যবেক্ষণ করেছি। এবং এখনো করে চলেছি। যদিও এই কথা আমার পূর্বাপর লেখার উদাহরণ নয়।

তবে উদাহরণটি বড় মজার। এবং বেশ উপলব্ধির। কারণ এই নির্বাচন ঘিরে নির্বাচন সফল করবার প্রয়োজনে, বিজয় নিশ্চিতকরণে, নানান কমিটি করা হয়েছিল। তার ভিতরে একটি ছিল নানা শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে সর্ব জনাব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রায় পঁয়ত্রিশ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটি। কেবল এই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সহ দুএকজন ছাড়া আর সকলেই ছিলেন গতানুগতিগকতার বাইরের। কেন কিভাবে সে উত্তর আমার প্রায় অজানা। তবে অনেক গতানুগতিক গদাধরদের কেন প্রবেশাধিকার মিললোনা সেখানে সে উত্তর জানে এই শহর।

তারা একদিন বসেছিলেন তাদের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করতে। না সেটা প্রধান উপদেষ্টার আদেশ অনুরোধ বা নির্দেশে নয়। একেবারেই উপদেষ্টাদের মধ্যে একজনের স্বীয় সিদ্ধান্তে শতপ্রণোদিত উদ্যোগ ছিলো। যেখানে সিদ্ধান্ত ছিল সকলকে রাস্তায় নামতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে। ভোট চাইতে হবে। তাই হয়েছিল। যদিও এই কমিটির অনেকেই তাদের স্বশরীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেননি। যদিও তখনো সেটা সবার জন্য সহজ ছিলো না। অতঃপর ভোট শেষ হলো। অনেক কথা অনেক আলোচনা অনেক বিশ^াস অবিশ^াসের কথা মারিয়ে অবশেষে অবুল খায়ের আব্দুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হলো। ইতোমধ্যে শপথও সম্পন্ন হয়েছে নূতন নির্বাচিত মেয়রের। কেবল বাকি নিয়ম রক্ষায় দায়িত্ব হস্তান্তর। অতএব বলাই যায় বরিশাল আর একবার বিজয়ী হলো। এবং মানুষের ভোটে। নিশ্চয়ই সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হলো উপদেষ্টাদের কমিটি? নিশ্চয়ই সেটাইতো নিয়ম, ভদ্রমতে! ব্যক্তি বিশেষের এমন চিন্তায় ভিন্নতা থাকলেও (যারা বা যাদের অভিষ্ঠ কোন লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায় আছে) থাকতে পারে তবে সিংহভাগই এমন ভাবনা ভাববার কোন প্রয়োজন ছিল না এবং নেই। 

সেভাবেই চলছিল। হঠাৎ ফোন। ‘আজ একটু উপদেষ্টা মণ্ডলীরা একত্র হবো সন্ধ্যায়। সবাই মিলে নবনির্বাচিত মেয়রকে ফুল দেব।’ প্রশ্ন ছিল কিছু, নাই বা বললাম সেগুলো। অনুরোধ ছিল একটা। ‘সবাই সুন্দরভাবে গুছিয়ে, গুতোগুতি পারাপারি না করে কাজটি করা যাবে?’ উদ্যেক্তা উত্তর দিয়েছিল, ‘আমরা সবাই সবার ভুলগুলো দেখতে পাই। কোন কোন সময় অন্যদের ভুল নিয়ে কথাও বলি। আমরা নিশ্চয়ই পারবো গুছিয়ে কাজটি করতে।’ অর্থাৎ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে মেয়রকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে। সেই বিশ^াসে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। শুরুতেই আপ্যায়ন। টেবিলে উপস্থিত মিষ্টি এবং কেক। মেয়র পত্নী ঘুরে ঘুরে অত্যন্ত আন্তরিকতায় তদারকী করছেন। যার একটি মিষ্টি গ্রহণও সাস্থ্যসম্মত নয়, তাদের অনেককেই দেখলাম একাধিক মিষ্টিযোগে কেকেরও সদ্ব্যবহার করে চলেছেন! কি আর করা, উপদেষ্টা বলে কথা!  তার পর এলো সেই সময়। যার জন্য উপস্থিত যারা ছিলেন প্রায় সবাই তারজন্য ভোট চেয়েছেন। রাস্তায় হেঁটেছেন, ঘাম ঝরিয়েছেন শরীরের। মানুষদের জনে জনে বলেছেন ‘বিশ্বাস করেন আমরা যার জন্য পথে নেমেছি, ভোট চাইছি, মানুষটা ভালো।’ একটু বাদেই সেই মানুষ অর্থাৎ নবনির্বাচিত মেয়র অবুল খায়ের আবদুল্লাহ এসে ছালাম দিয়ে দাঁড়ালেন। এবার ফুল প্রদান পর্ব। আমি এতটা সময় ধরে যে বিষয়টা নিয়ে দ্বন্দে¦ ছিলাম, দেখলাম- সেটাই হতে চলেছে। দেখলাম যার মাথায় আমার থেকেও চুল কম, সেও পরিপাটি হচ্ছে। মুখমন্ডল হাস্যজ্জল হচ্ছে এবং শরীরের গতি সরব করছে। 

উপদেষ্টা উদ্যেক্তার হাতে ফুল উঠবার সঙ্গে সঙ্গে সকল আচার আচরণ অবস্থান অস্তিত্ব ভেঙে, নিবীড়ভাবে অবুঝের মতো প্রায় সবাই সামনের সারি নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। সেই মুহূর্তে মনের মধ্যে একটা ভাব একটা লোভ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভাবলাম সবথেকে ছোট বিবেচনায় হয়তো কেউ বলবে ‘আসো সামনে।’ দেখলাম, না। অনবরত আমাদের পিছনে থাকবার যোগ্যতাকেই তারা সবাই সহজে মেনে নিয়েছে। অনবরত ফুল দিয়ে আর নিয়ে নিয়ে অভ্যস্তরা হাস্যমুখে ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। নির্বাচনের মাঠে যাকে সবথেকে কম পেয়েছিলাম তাকেই দেখলাম মেয়রের একদম পাশে। হয়তো আত্মীয় বলেই, গত পাঁচ দিনের পত্রিকায় পরপর বিভিন্ন বিষয়ের সাথে যুক্ত থেকে ছবি তুলেছেন। অথচ এই আত্মীয়কেই সব থেকে বেশি দূরে রেখেছিলেন এখনো যিনি মেয়র আছেন সে। হয়তো প্রয়োজনই ছিলো? কারণ সবথেকে বেশি সুবিধা যিনি গ্রহণ করবেন বঞ্চিতওতো তারই হওয়া উচিত? 

সেখান থেকে ফিরে একদিন পরে সেই উপদেষ্টাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি কেন ফুল ও ছবির পিছনে এতো ছুটলেন? কেন আপনারও মনে হলো ‘আমি বাঁচলেই বাপের নাম।’ আপনিতো এর ঘোর বিরোধী। সবার অনিয়ম নিয়ে লেখেন কথা বলেন? তার উত্তরটি ছিল বেশ মজার। দারুন মজার, উচ্চতর শিক্ষার। উত্তরটি ছিল কঠিন সত্যাশ্রয়ী। উত্তরটি ছিল সৎ। উত্তরটি ছিল যারা এমনটা করেন তারা কেন করেন তার উত্তর। আর সেটা হলো ‘কি করবো ভাই, বাড়ি গেলেই বউ জিগায় এতো যে লাফাও তুমি কি পাও? এই জন্য একটু খেই হারাইয়া ফালাইছিলাম।’

উত্তরটা আমায় আনন্দিত করেছে অনেক। এর পর থেকে এমন ফুল নিয়ে সামনে যাবার জন্য ধাক্কাধাক্কি করা মানুষদের দেখলেই আমার ঐ কথাটা মনে পরবে। (ভাই বাড়ি গেলেই বউ জিগায় তুমি কি পাও?) আমরা যারা বাইরে হালুম দিয়ে বেড়াই, তাদেরই কর্মভুল এই কথা কি প্রমাণ করে না ভিতরে আমরা কতটা মিউ শব্দধারী বিড়াল? কতটা সুবিধা প্রত্যাশী লোভী? যারা সারাদিন হুঙ্কার দিয়ে মিটসেফ থেকে চুরি করে খাবার খাওয়া বিড়াল তাড়াই। সেই তারাই সুযোগ পেলে কি অদ্ভুত বিড়াল বনে যাই। আসলে হুঙ্কারে নয়, কর্ম দেখে বুঝে নেওয়া দরকার কোনটা রক্ত মাংসে গড়া আর কোনটা কাগজের বাঘ কিংবা বিড়াল। লেখাটা শেষ করে নিজেনিজে ভাবছিলাম কেন লিখলাম এমন একটি কল্প কাহিনি? এর কি কোন অর্থ হয়? এর থেকে বোধ করি এই গল্পটা কিছু অর্থবহ হলেও হতে পারে।

এক গাধার মালিক তার গাধা নিয়ে একই রাস্তা দিয়ে সকালে যায় বিকেলে ফেরে। এই আসা যাওয়ার পথে প্রতিদিন লোকটি দেখতে পায় এক লোক একটি মজা পুকুর পাড়ে বসে আছে। আজ ফিরবার পথে তার সাথে দেখা হতেই লোকটি জানতে চাইলো ‘আপনি গাধাকে নিয়ে রোজ কোথায় যান? গাধার মালিক বললো, আমরা দুজনে যাতে দুজনের কথা বুঝতে পারি সেই জন্য এক শিক্ষকের কাছে শিক্ষার জন্য যাই। লোকটি বললেন, বুঝতে পারেন এখন দুজনে দুজনার কথা?’ কোন উত্তর না শুনেই লোকটি যেয়ে পুকুর পারে বসলো এবং হাতের লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করতে লাগলো। এবার গাধার মালিক গাধাকে সঙ্গে নিয়ে লোকটার পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘তুমি রোজ এখানে কি করো? উত্তরে সে বললো, ব্যাঙাচিদের লাফ শিখাচ্ছি।’ কথা শুনেই গাধা জ্ঞান হারিয়ে ধপাশ করে পড়ে গেলো। চিন্তিত গাধার মালিক দ্রুত মুখে পানি ছিটিয়ে গাধার ‘জ্ঞান’ ফিরালো! এবার গাধা সোজা দাঁড়িয়ে তার মালিককে বললো ‘বস অরে থামান। হালায় তো আমারেও বেইজ্জত করে ছাড়লো। ঐ গাধার বাচ্চারে কন ব্যাঙাচির লেজ খসলে ওরা নিজের থেকেই লাফাবে। ও কেডা ব্যাঙরে লাফ শিখাবার? ওটা ওদের জন্মগত অধিকার।’ 

এবার লোকটি হাতের লাঠিটা পুকুর পাড়ে সুন্দর করে রেখে যেতে যেতে গাধার মালিককে বললো ‘যাইগো ভাই আবার কালকে আসতে হবে। লাফানোটা ওদের জন্মগত অধিকার হলেও জীবনে সঠিক ভাবে বাঁচতে হলে সেটাও শিখবার বিষয়, নয়তো পুরো ব্যাঙ জাতিটাই পিছিয়ে পড়ে যাবে।