বিপদে আমি না যেন করি ভয়
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ এমন আয়োজনহীন চৈত্র সংক্রান্তি দেখিনি কেউ। কেউ ব্যাস্ত নেই কোথাও বছরের অবর্জনা জঞ্জাল উপরে ফেলে দেওয়ার কাজে। হালখাতার আয়োজন নেই দোকানির। আয়োজন নেই দর্জিপাড়ায়। ময়ররা ব্যাস্ততা নেই মিষ্টির দোকানে। হাটে বাজারে কোথাও আয়োজন নেই বৈশাখী মেলার। ব্যস্ততা নেই গানের আসোরে, কবিতার উচ্চারণে। ব্যস্ততা নেই নৃত্যের ছন্দে, রঙিন বসনে। ব্যাস্ততা নেই মঙ্গল শোভাযাত্রার উপকরণ নির্মাণে। সকলই থেমে আছে মনের গভীরে। রূপ-রস ঘ্রাণ অভিব্যক্তিহীন স্তব্ধতায় গুমট মন এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কখন সে শরীর আশ্রয়ী হয়ে বাইরে এসে চিৎকার করে সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত হয়ে সরবে গেয়ে উঠবে ‘বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক। এসো হে বৈশাখ’।
চারিদিকে এখন কবরের শুনশান নিরবতা। এ কোন মানব সভ্যতা পথহীন, গতিহীন, সমষ্টিহীন? পৃথিবীর সকল ধর্ম উপাসনালয় স্থবির, স্তব্ধ, স্থির হয়ে আছে। মানুষ নেই মানুষের কাছে। এ যেন শুধুই দম বন্ধ করে একা অন্ধকার ঘরে বেঁচে থাকা। এ কার আঘাত কেমন শত্রু, প্রতিকারহীন? চিকিৎসা সাস্ত্র হতাশ তাকিয়ে আছে একমাত্র ভরসা তার অলৌকিক ধর্মের দুয়ার। ধর্মজ্ঞানিরা সকল পথ হারিয়ে তাকিয়ে আছে বিজ্ঞানের পথে! আজ কোথায় পালালো সকল সত্য, শক্তি, দম্ভ? সর্বত্রই শুধু এক আওয়াজ- করোনা করোনা করোনা। কি অসাধারণ তার পথ চলা! পৃথিবীর মানচিত্র মেপে মেপে প্রতি স্কয়ারফুটে।
কেন এমন হলো, তবে কি মানব সভ্যতা দাম্ভিকতায় ভেসে গিয়েছিলো? কেন সাবধান হলো না সে, কেন আকাশ জুড়ে পথের ঠিকানা দিলো? যে পথে সর্বত্রই এখন করোনার বিস্তার? প্রতিদিন সকালের খবর হাজার ছাড়িয়ে মৃত্যু এখন লাখ স্পর্শ করেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে অব্যাক্ত কান্না, ভয় অতংক আর হতাশায় ভরা গ্লানি। যেন লাশের সারির প্রতিযোগিতা, মুখ থুবরে পরেছে লাশ ব্যবস্থাপনাও। সবার দৃষ্টি সর্বশক্তিমান অপার স্রষ্টার দিকে। এতো মৃত্যুর খবর নিয়ে প্রতিদিন যে সকাল আসে তাকে দেখে কি মনে হয় না ‘এ কোন সকাল এ যে রাতের চেয়েও অন্ধকার’। অনবরত কানে ভেসে আসে যে পাখির গান ‘সে কি পাখির কুজন, না কি হাহাকার’?
তবু অপেক্ষায় আছি বুকে সাহস নিয়ে। মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই ফের। করোনা তুমি স্থির হও। মানুষকে আর চোখ রাঙিও না। সব মানুষ কাঁদে না। কোন কোন মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। চরম বৈরিতার মধ্যেও শত্রুকে আঘাত করবার পথ খুঁজতে হয়। ইতিমধ্যে প্রাণ কেড়েছো লক্ষাধিক, এর পরিণাম মানুষ অচিরেই তোমায় অস্তিত্বহীন করে দেবে। তোমার জায়গা হবে পৃথিবীর কোন জাদুঘরে। মানুষ ফের মানুষের কাছে আসবে। সেই সমষ্টির শক্তিতেই তোমার বিনাশ।
পৃথিবীতে শুবাতাস বইবেই। আমরা ফের বৈশাখী প্রভাতে গানের আসরে মিলিত হবো। আমরা ফের কবিতায় উচ্চারণ করবো ‘হে বন্ধু, তোমাকে নববর্ষের সাদর সম্ভাষন’। আবার ফের সত্য, প্রেম, পবিত্রতার বেদী ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে নগর প্রদক্ষিণ করবে। যে র্যালীর অগ্রভাগে থাকবে মানুষের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করোনার শরীর। সেই দৃশ্য মনে ধারণ করে শরীরটাকে বাড়িতে ফেলে এ মন আজ নিশ্চয়ই ছুটে যাবে বৈশাখী মেলার মাঠে। যে মাঠে সুদির্ঘ ৩৯ বছর যাবত ঊদীচী বনা আয়োজন করে আসছে বৈশাখী মেলা। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের যে মেলা মঙ্গল শোভাযাত্রা আজো ঐতিহ্য এই শহরের। যেখানে এলেই প্রভাতী অনুষ্ঠানে দেখা হতো শ্রী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, শ্রী নিখিল সেন, সাবের আহম্মেদ, নারায়ন সাহা, প্রাণ কৃষ্ণ সেন, এম মোয়াজ্জেম হোসেন, মিন্টু বসু, এসএম জামান, মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস হোসেন, মোকলেছুর রহমান, কাওসার হোসেন, গাজী মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর, আব্দুল মতিন, সাজেদা মতিন এমন শ্রদ্ধাভাজনদের সাথে। আজ আর তারা নেই রয়ে গেছে পরম্পরা।
আজো প্রভাতে গেলেই দেখা মিলবে ফরাদ ভাইয়ের। দূর থেকে ডাকবে মানব দা, হাসি দিয়ে কাছে ডাকবে জীবন দা ও ইকবাল ভাই। বিশ্বনাথ দা বলবে আমি মিরণের সাথে কথা বলে অনুষ্ঠান শুরু করছি। কাজী সেলিনা, সোনিয় আল আকসা, সঞ্জয় আর সুজয় অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাস্ত। শুভেচ্ছা জানাবে সৈয়দ দুলাল, নজরুল ইসলাম চুন্নু, শান্তি দা। পঙ্কজ রায় চৌধুরী, নজনুল হোসেন আকাশ জিজ্ঞেস করবে কেমন আছিস? জগলুল হায়দার সাহিন জিজ্ঞেস করবে কিরে শুভ এইদিকে আসে নাই? মুকুল দা এসেই বলবে আরে বেডা আমি জনমভর এই জায়গা আইছি, এই জায়গায়ই আমু। কাজল দা এসে বলবে আমি ব্যানার নিয়ে সামনে গেলাম। সবুজ ভাই ব্যাস্ত হয়ে পাশ দিয়ে চলে যাবে। তার অনেক দায়িত্ব। মুরাদ, আমান, মহিউদ্দিন মানিক ভাই একে অপরকে বলবে এই মেলার দারোয়ন হিসেবে আমাদের সিনিয়ার কেউ নেই। আমার চারপাশে দেখবো এই মেলার প্রাণ ছোট বড় সকলের নির্মল উপস্থিতি। এমন এক বিস্ময় আবেশ ছেড়ে শুধু ঘরে থাকা সে কঠিন, কঠোর, যাতনার। হে মহান তুমি ক্ষমা করো। মৃত্যুর মিছিল স্তব্ধ করে দাও। শক্তি দাও, তোমার সৃষ্টিরে পথ দেখাও আলোর, সুন্দরের, সত্যের, প্রেমরে, পবিত্রতার এবং সাম্যের।