বড় ধস পোশাক রপ্তানিতে

বড় ধস পোশাক রপ্তানিতে

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে পোশাক খাতের প্রধান বাজারগুলোতে রপ্তানিতে অনেকটা গতি এসেছে। তবে বড় ধাক্কা লেগেছে এই খাতের নতুন বাজারে। রপ্তানিতে প্রণোদনা থাকায় তুলনামূলক কম মূল্যে এসব দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। বর্তমানে ভারত বাদে এসব দেশের করোনা পরিস্থিতিও আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। এরপরও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে ১০ শতাংশেরও বেশি ঋণাত্মক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষ করে চীন, জাপান ও ভারতে রপ্তানি আয় কমেছে অস্বাভাবিকভাবে।

নতুন বাজারে হঠাৎ এমন খারাপ অবস্থায় বিস্মিত রপ্তানিকারকরা। আগামী এক বছরেও এ অবস্থার পরিবর্তনের আশা দেখছেন না তারা। মূলত করোনায় দেশগুলোর ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এমনটা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ার বাজারে রপ্তানিতে প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় নতুন দিগন্ত দেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসের মোট পোশাক রপ্তানিকে মন্দের ভালো বলছেন তারা।

পোশাক কারখানা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানিতে ৮৩ শতাংশ আয় করা পোশাক খাত চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে আয় করেছে ১০ দশমিক ৪৫০ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন), যা আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ২০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে এই খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০ দশমিক ৫৭৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের পোশাক খাতের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশ (ইইউ), যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশগুলো থেকে মোট রপ্তানির ৮৩-৮৫ শতাংশ আয় হয়ে থাকে। এর বাইরের দেশগুলোকে নতুন বাজার হিসেবে ধরা হয়।

গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে নতুন বাজারে মোট রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৮১৪ মিলিয়ন ডলার (১ মিলিয়ন= ১০ লাখ), যা ওই সময়ের মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন বাজারে ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। গত জুলাই-অক্টোবরে সেখানে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৬৩১ মিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।

২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপ ও আমেরিকার নাগরিকদের ভোগক্ষমতা এবং চাহিদা কমে আসে। প্রচলিত এ দুই বাজার হারানোর শঙ্কায় নতুন বাজারের সন্ধানে নামে সরকার এবং উদ্যোক্তারা। নতুন নতুন দেশ বা অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি উৎসাহ জোগাতে প্রচলিত বাজারের বাইরে নতুন বাজারে রপ্তানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করে সরকার। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে এই প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যকর হয়। এ সুবিধায় অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, ভারতসহ অন্তত ৩০টি দেশে পোশাক রপ্তানিতে গতি আসে। গত অর্থবছরের করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পূর্ব পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। করোনাকালে এসব বাজারে রপ্তানিতে ধাক্কা লাগলেও সেটাও খুব একটা বেশি ছিল না। কিন্তু গত ৪ মাসে নতুন বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের হিস্যা কমতে শুরু করেছে।

নতুন বাজারে রপ্তানিতে এমন ধস নামার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর ১ম সহ-সভপতি মো. হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধান বাজারের চেয়ে নতুন বাজারে এভাবে রপ্তানি কমে যাওয়া সত্যি অবাক করার বিষয়। বিশেষ করে চীন ও জাপানের করোনা পরিস্থিতি তো অনেক আগেই উন্নতি হয়েছে। এটা ঠিক যে, ওইসব দেশে করোনায় বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। এরপর আমরা জানাতে পারব।

কারখানা মালিকরা মনে করছেন, পোশাকের নতুন বাজারের অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রধান বাজারের চেয়ে অনুন্নত। আর ওইসব দেশে তুলনামূলক কম দামের পণ্য রপ্তানি হতো। যেহেতু করোনায় সব দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থায় ধাক্কা লেগেছে তাই হয়তো সেখানকার দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এজন্য রপ্তানিও কমেছে।

বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘তুরস্ক বা অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু আমরা ভালো করছি। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় অন্য বাজারগুলোর নাগরিকের ক্রয় ক্ষমতা ভালো না। আর ২০২১ সালের মধ্যে হয়তো এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এদিকে নতুন বাজারের সম্ভাবনাময় দেশগুলোয় যখন রপ্তানিতে ধস নেমেছে তখন আশা দেখোচ্ছে তুরস্ক, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। এসব দেশে করোনাকালেও রপ্তানিতে প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এছাড়া পরিমাণে কম হলেও প্রবৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারলে রপ্তানিতে আরও অগ্রগতি আসবে। বিশেষ করে তুরস্কসহ যেসব দেশে বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক আছে সেসব দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা গেলে ভালো ফল মিলবে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, তুরস্ক আগেও আমাদের একটি ভালো বাজার ছিল। তুরস্ক হয়ে আমাদের পণ্য আগে পাশর্^বর্তী দেশগুলোতে যেত। কিন্তু কয়েক বছর আগে ওরা আমাদের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। আমরা তুরস্ক থেকে যেসব পণ্য আমদানি করি সেগুলো আমাদের দেশে উৎপাদিত হয় না। তাই দেশটির সঙ্গে দ্রুত একটি এফটিএ করা গেলে তুরস্ক আগামীতে আমাদের জন্য ভালো একটি সম্ভাবনাময় বাজার হবে। ব্রাজিলসহ অন্য নতুন বাজারেও আমাদের দ্রুত এফটিএ করা জরুরি। তাহলে নতুন বাজার প্রধান বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চলে আসবে।’


ভোরের আলো/ভিঅ/১১/২০২০