ভেজাল মদে বাজার সয়লাব,বিষক্রিয়ায় মৃত্যু

ভেজাল মদে বাজার সয়লাব,বিষক্রিয়ায় মৃত্যু

ভেজাল মদ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু, অঙ্গহানি বা অসুস্থ হওয়ার খবর বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। গত কয়েকদিনে এরকম বেশ ক'টি ঘটনা ঘটে গেছে।

ঢাকায় সম্প্রতি আলাদা আলাদা ঘটনায় মদ্যপানের পর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আরো বেশ কয়েকজন অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে বগুড়ায় সোমবার ভেজাল মদ পান করে অন্তত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

যাদের মৃত্যু হয়েছে এবং যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন, তাদের অধিকাংশের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদনে 'মিথানল বিষক্রিয়া'র উল্লেখ রয়েছে।

মিথানল বা মিথাইল অ্যালকোহল হচ্ছে স্পিরিটের সবচেয়ে অশোধিত পর্যায়।

সাধারণত এটি হালকা, বর্ণহীন এবং উগ্র গন্ধযুক্ত হয়। কাঠের বা প্লাস্টিকের কাজ, বার্নিশ বা রং করা অথবা ছাপাখানার কাজ - এরকম বহু ক্ষেত্রে মিথানল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে প্রায়ই মদের নামে স্পিরিট খেয়ে মৃত্যু হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ভেজাল মদ খেয়ে মারা যাওয়া বা অসুস্থ হওয়ার ঘটনাগুলোয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে ভেজাল মদ তৈরির ক্ষেত্রে মূল উপাদান হিসেবে মিথানল ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সব জায়গাতেই মদ সেবন এবং সব দোকানে মদ বিক্রির বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে।

সাধারণত সরকার অনুমোদিত কিছু ওয়্যার হাউজ, লাইসেন্সকৃত পানশালা এবং বিভিন্ন হোটেল থেকে মদ কিনে থাকেন মানুষ। শুধু মদ সেবন করার লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরাই এইসব জায়গা থেকে মদ কিনতে পারবেন।

ভেজাল মদে অসাধু ব্যবসায়ীরা মিথানল মিশিয়ে দেয়

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাঝে মধ্য বিভিন্ন ক্লাব ও পানশালায় অভিযান চালিয়ে মদ বাজেয়াপ্ত করছে-এমন খবর মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।

তবে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও ক্রেতাদের একটা বড় অংশ মদ কিনে থাকেন অবৈধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে।

গত কয়েক সপ্তাহে মদ পানের পর বিষক্রিয়ার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহে মদ পানের পর বিষক্রিয়ার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে।

আর ক্রেতাদের এই চাহিদার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভেজাল মদ তৈরি ও বিক্রি করেন এক শ্রেণীর বিক্রেতা।

ঢাকার অন্তত চারটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কথা বলে জানা যায় গত কয়েক সপ্তাহে মদ পানের পর বিষক্রিয়ার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে।

চিকিৎসক ও রসায়নবিদদের মতে, মিথানল মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হতে পারে।

বাণিজ্যিকভাবে মদ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যে এ্যালকোহলের পরিমাণ মানুষের গ্রহণের জন্য নিরাপদ মাত্রায় নামিয়ে আনেন।

তবে অসাধু ও অবৈধ ব্যবসায়ীরা অনেকসময় তৈরি করা মদের সাথে শিল্প কারখানার কাজে ব্যবহৃত মিথানল যোগ করেন।

মিথানল দিয়ে তৈরি ভেজাল মদ যেভাবে ক্ষতি করে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, "খুব সামান্য পরিমাণ মিথানলেও অনেক সময় মানুষের বড় ধরণের শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা মিথানলের প্রভাব একেকজনের দেহে একেকরকম হয়।"

মিথানলের দাম বাজারে পাওয়া যাওয়া অন্য স্পিরিট জাতীয় দ্রব্যের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম হওয়ায় ভেজাল মদ তৈরির কাজে মূলত এটিকেই ব্যবহার করা হয় বলে ধারণা প্রকাশ করেন মি. চৌধুরী।

২০১৭ সালে 'অ্যনালস অব অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে আসে যে প্রায় ৪ থেকে ১২ গ্রামের মত বিশুদ্ধ মিথানল সরাসরি সেবন করলে একজন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারেন।

তবে ব্যক্তিভেদে এর চেয়ে কম পরিমাণ বিশুদ্ধ মিথানল গ্রহণেও মানুষের অন্ধ হয়ে যাওয়ার বা মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন মিথানল শরীরে প্রবেশ করলে ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, স্নায়ুতন্ত্রও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে - এই দুই কারণেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

"মিথানল গ্রহণ করার পর যত সময় যায়, ততই তা শরীরের সাথে মিশে যেতে থাকে এবং শরীরের তত বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে", বলেন মি. মাহমুদ।

শরীরে মিথানল প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ার কারণে কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কিডনি সেই অতিরিক্ত অ্যাসিড বের করে দিতে সক্ষম হয় না।

এর ফলে কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র, যকৃতসহ অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

চিকিৎসকরা বলেন, মিথানলের বিষক্রিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ে চোখের স্নায়ুর ওপর। বিষক্রিয়ার শিকার হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া অনেকেই অন্ধত্ব বরণ করেন।

মিথানল বিষক্রিয়ার সম্ভাব্য উপসর্গ

সাধারণত মানুষের শরীরে মিথানল প্রবেশ করার পর বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে উপসর্গ প্রকাশ হতে।

শরীরে মিথানল প্রবেশ করার একটা নির্দিষ্ট সময় পর কিছু লক্ষ্মণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে জানান ডাক্তার সোহেল মাহমুদ।

তিনি বলেন, "মিথানল বিষক্রিয়া শুরু হলে মাথা ব্যথা, বমি হওয়া বা বমি ভাব হওয়া, বুকে জ্বালাপোড়া থেকে শুরু করে খিঁচুনিও হতে পারে।"

এছাড়া ক্লান্ত বোধ করা, পেটে ব্যাথা, মাথা ঘোরানো, চোখে ঝাপসা দেখা বা শ্বাসকষ্টের মত উপসর্গও দেখা যেতে পারে।

কেউ যদি সন্দেহ করেন যে তিনি মিথানল জাতীয় দ্রব্য পান করেছেন, তাহলে উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগে অথবা উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন মি. মাহমুদ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য বলছে বাংলাদেশে মদ বিক্রি ও সেবনের বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই

বিশ্ব স্বাস্থ্য বলছে, বাংলাদেশে মদ বিক্রি ও সেবনের বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই

কীভাবে বুঝবেন মদে ভেজাল আছে কি না

দীর্ঘসময় ধরে যারা মদ্যপান করেন তাদের অনেকেই বাইরে থেকে দেখে বা গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারেন যে মদে ভেজাল আছে কি না।

তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে আসল ও নকল মদের মধ্যে পার্থক্য করা সব সময় সম্ভব হয় না।

ঢাকার কয়েকটি পানশালায় কাজ করা কয়েকজনের কথা বলে জানা যায়, মদের ভেজাল নির্ণয় করার নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি না থাকলেও একটি সহজ উপায়ে মদে ভেজালের উপস্থিতি নির্ণয় করা যেতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পানশালার কর্মচারী বলেন, "মদ পরীক্ষা করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি একটু মদ নিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা।"

"মিথানল মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করতে হলে তাতে সামান্য পরিমাণ হলেও পানি দিতেই হবে।

আর এক ফোঁটা পানি থাকলেও ঐ মদে আগুন জ্বলবে না। কাজেই মদে যদি আগুন জলে, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে সেটিতে ভেজাল থাকার সুযোগ নেই।"    

সূত্র: বিবিসি বাংলা।