মাদারীপুরের ২৩ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি

মাদারীপুরের ২৩ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি

‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে দালাল হারুন। এর আগেও প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? হারুন দালালের মাধ্যমে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর কথা হয়েছিলো।

হারুন দালাল আমার ছেলেকে লিবিয়ায় মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এর কয়েক মাস পরে ওই দালাল আমাদের কাছে আরো ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। না দিলে আমার ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং অত্যাচার করে সেই ভিডিও আমাদের ফোনে পাঠায়।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো রবিন সিকদারের মা নুরজাহান। পরিবারের চাহিদা মেটাতে উন্নত জীবিকার আশায় অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের পাঠানো হচ্ছে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে। লিবিয়ায় নিয়ে মাদারীপুরের ২৩ যুবককে জিম্মি করে নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ।

রবিন সিকদারের মা নুরজাহান বলছিলেন, ‘ছেলেকে অত্যাচারের ভিডিও দেখে আমাদের বাড়িঘড়, জমিজমা বিক্রি করে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দেই। কয়েকদিন যোগাযোগ করতে দেয় দালাল চক্র। কয়েকদিন পর যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ওই চক্র আমার ছেলেকে অমানুষিক মারধর করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে ইমোতে কল দিয়ে তা আমাদের দেখায়। আমরা এখন নিরুপায়। টাকা না দেয়ার কারণে ছেলের সাথে যোগাযোগ এখন আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে মাফিয়া দালাল চক্র। এখন আমার ছেলেকে ফেরত আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’

পাঁচ মাস আগে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় পাড়ি জমান মাদারীপুর সদর, কালকিনি ও ডাসার উপজেলার ২৩ জন যুবক। এর মধ্যে লিবিয়ায় পৌঁছালেও এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবারের।

তাদের স্বজনরা জানান, লিবিয়ায় ওই যুবকদের জিম্মি করে বাড়িতে ভিডিও কল দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে তাদের নির্যাতনের হুমকি দিয়েছে জিম্মিকারীরা।

ভুক্তভোগী এসব পরিবারের মুক্তিপণের টাকা দেয়ার সাধ্য কারও নেই। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা। সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আকুতি জানিয়েছেন তারা।

মাদারীপুর সদর উপজেলা থেকে লিবিয়া জিম্মি হওয়া ৭ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা হলেন, বাহাদুরপুর গ্রামের আবুল হোসেন হাওলাদারের ছেলে রকিব হাওলাদার, আবদুল হাকিম খলিফার ছেলে এলেম খলিফা, সিরখাড়া ইউনিয়নের রব সিকদারের ছেলে রবিন সিকদার, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিথাপুর গ্রামের ফুকু বেপারীর ছেলে জসিম বেপারী, মিঠাপুর এলাকার আসমত আলীর মোল্লার ছেলে ইব্রাহীম মোল্লা, মস্তফাপুর ইউনিয়নের হাবিব সরদারের ছেলে জাহাঙ্গীর সরদার, হালিম সরদারের ছেলে আল আমিন। তাদের বয়স ১৯ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।

লিবিয়ায় বন্দি রবিন সিকদারের মামা ইব্রাহিম মোল্লা বলেন, হারুন দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য বডি কন্ট্রাক্ট হয়েছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। লিবিয়া পৌঁছানোর কয়েকদিন পর (২৬ মে ২০২২) রবিন সিকদার শিমিয়া থেকে ফোনকল করে জানায় দালাল হারুন তাকেসহ আরও কয়েকজনকে অন্য মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন যদি আরও ৯ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা এই মুহূর্তে না দেয়া হয়, তাহলে মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলবে।

তিনি আরও বলেন, এই কথা বলার পরই রবিন সিকদারের তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে দালাল বলেন, ‘যে কোনো কিছুর বিনিময় হলেও আপনার ভাগিনার নিকট টাকা পাঠাইয়া দেন। টাকা না পাঠাইলে আর তাকে পাওয়া যাবে না।’ এসব বলার পর ফোনে নির্যাতনের ভিডিও দেখায়, পরে ফোন কেটে দেয় মাফিয়া চক্রের সদস্যরা। তারপর কোনো উপায় না পেয়ে দিশেহারা হয়ে নিজের বসতবাড়ি আর জমিজমা বিক্রি করে দালালকে ৯ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা এক সপ্তাহের মধ্য পাঠিয়ে দেয় ভুক্তভোগীর পরিবার।

একাধিক ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, ইতালি যেতে চন্ডিবর্দি এলাকার হারুন দালালের সঙ্গে কথা হয় তাদের। আলোচনায় ঠিক হয়, তাদের লিবিয়া হয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে। জনপ্রতি ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা লাগবে। চুক্তি অনুযায়ী, হারুনের কাছে সাড়ে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে দেয় ওই ৭ যুবকের পরিবার।

এরপর লিবিয়ার উদ্দেশ্যে তারা দেশ ছাড়েন দেড় মাস আগে। এরই মধ্যে তারা লিবিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। সেখান থেকে গত ২৬ মে ইতালি যেতে সাগর পাড়ি দেয়ার কথা বলে নিয়ে তাদের জিম্মি করা হয়।

পরিবারের সদস্যদের দাবি, এরপর প্রত্যেক যুবকের পরিবারের কাছে তাদের সন্তানদের দিয়ে ভিডিও কল করিয়ে ৯ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এক মাস না যেতেই আবার ১০ লাখ টাকা দাবি করেন।

ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো এলেম খলিফার বাবা আবদুল হাকিম খলিফা বলেন, ‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ৯ লাখ টাকা দাবি করছে। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? যে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি, তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমার ছেলেকে ফেরত আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’

ইউনুস শেখের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ‘ধারদেনা করে পোলারে বিদেশ পাঠাইলাম। এখন আর টাকা দেয়ার মতো সাধ্য আমার নেই। দালালের ধর্না দিয়েও কোনো কাজে আসছে না। টাকা না দিতে পারায় আমার ছেলের সাথে আজকে পাঁচ মাস ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় মাফিয়া চক্র। কীভাবে আমারা আমাদের সন্তানকে ফিরে পাব? সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই, আমি আমার পোলা ফেরত চাই।’

এসব বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত হারুনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। খুদে বার্তা দিয়েও তার সাড়া মেলেনি।

দালাল হারুনের গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করা হলে কেউ সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কথা বলতে রাজি হননি। হারুন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।

মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবপাচার মামলা করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযুক্তদের খুঁজে বের করা হবে।’

মাদারীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাইনউদ্দীন খান বলেন, ‘দালালদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। দালাল চক্র ধরার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।’

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘আমাদের কাছে একটি অভিযোগ এসেছে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে দালালের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’