রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক

রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক

একটি নাম, একটি ছবি। গর্জে ওঠা বাঙালির তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বর। মাথা নত না করার মন্ত্রে উজ্জীবীত বাঙালি। বরিশালের গর্ব ও অহংকার। বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা আবুল কাশেম ফজলুল হক। আবুল কাশেম ফজলুল হক বললে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কে এই ব্যক্তি? কি তার পরিচয়? কিন্তু এই নামের আগে যদি শের-ই-বাংলা ব্যবহার হয়, তাহলে শিশু থেকে শুরু করে কাউকে বলে দিতে হবে না তিনি কে। সবাই একবাক্যে বলে উঠবেন বাংলার বাঘ, আমাদের গর্ব ও অহংকারের নাম। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রবক্তা, প্রজাস্বত্ব আইনের প্রবক্তা, অভিবক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কৃষকের নয়নমনি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি।

এত এত অবদান যাঁর। যিনি অবিভক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে আমাদের গর্বিত করেছেন। এমন একজন মাহামানব জন্মেছিলেন বরিশালের মাটিতে। বরিশালে জন্মে তিনি গোটা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এমনকজন মানুষের জীবন ইতিহাস আলোচনা শুরু হলেই বলতে শুনি তিনি একটি কমলা এক গ্রাসে খেয়ে ফেলতেন। ১০টা আম একত্রে খেতেন। এরকম খাবার ও নেতিবাচক বিষয় নিয়ই আলোচনা বেশি হয়। প্রদীপের আলোতে উঠে আসে না তাঁর বাস্তবধর্মী ও কল্যাণমূখি কর্মকা-। সাম্প্রদায়িক উসকানী কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে কাজ করে গেছেন। কৃষকদের কল্যাণে তিনিই প্রজাস্বত্ব আইন করে গেছেন। ফজলুল হকের জনকল্যাণমুখি কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় আমাদের সন্তানরা শের-ই-বাংলাকে সেভাবে জানে না। তাদের সামনে শের-ই-বাংলাকে তুলে ধরার উদ্যোগও তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কৃষকরে জন্য নিবেদিতপ্রাণ একে ফজলুল হক এমন কোন বিষয় নেই যেখানে নিজের কর্ম ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেননি। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা ঠেকাতে ভূমিকা রেখে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে দাঙ্গা বন্ধ হয়।

বাংলাদেশের অবিসংবাদিত এই মানুষটির জন্মদিন ছিল গতকাল ২৬ অক্টোবার। অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একে ফজলুল হক আমাদের মাঝে অনেকটাই উপেক্ষিত। কোনমতে তাঁর জন্মদিন পালন করেই দায় শেষ করা হয়। বরিশালের দুই একটি স্থানে নামমাত্র জন্মদিন পালন হলেও। দেশের অনেক স্থানেই তাকে স্মরণও করা হয় না। বাংলাদেশের অবদানের কথা উঠলেই যে কয়টি নাম উচ্চারণ হয় শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক তাদের মধ্যে অন্যমত।

একে ফজলুল হক এসডিও পদে চাকরি করার সময় জমিদার ও মহাজনের নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন। এর প্রতিকার করতে উদোগী ভূমিকা নেন তিনি। কেবল কৃষকের কথা চিন্তা করে ১৯০৮ সালে এসডিওর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা না করে তিনি সেই চাকুরী ছেড়ে দেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে একে ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। কেবল সেই কারণে কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

অনন্য মানুষ শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলাকা নামে নিজে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। এসময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় হুমকীর শিকার হয়েছেন। লেখালেখির মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ ছিল তাঁর।

বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধির কাতারে নাম লেখান তিনি। এর মাধ্যমেই একে ফজলুক হকের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাবার সময় পাননি তিনি। একে একে তিনি আইন পরিষদের সদস্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অভিবক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক পদ অলংকৃত করেছিলেন। যেটুকু তুলে ধরা হলো এটা শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের জীবনের অতি সামান্য অংশ।

এতো এতো গুণের অধিকারী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের পূর্বপূরুষ আঠারো শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময় তারা বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার চাখারে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।
চাখারে তাঁর বসতভিটায় তাঁর নামে একটি জাদুঘর থাকলেও সেটা কেবল তাঁর স্মৃতিচিহ্নের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে গিয়ে পর্যটকসহ দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফেরেন। দাবি ছিল, চাখারে একে ফজলুল হকের বসতভিটায় ফজলুল হক কমপ্লেক্স নির্মাণ করে শিল্পকর্ম, গ্যালারি, বৃহৎ আকারে জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। দাবি ছিল ভাসানী নবোথিয়েটারের মতো একে ফজলুল হক নবোথিয়েটার গড়ে তোলা হোক তাঁর বসতভিটায়। তাহলে মানুষ ওই বসতভিটার প্রতি আকৃষ্ট হবে। যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের শিশু থেকে শুরু করে শেষ জীবনের সব ইতিহাস খুঁজে পাবে। তার জন্মদিনে আমরা এই গুণি ব্যক্তিত্বর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই।

আমরা চাই, তাঁকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সবিস্তরে তুলে ধরা হোক। তাঁর শিক্ষা জীবন, কর্মময় জীবন সম্পর্কে আমাদের সন্তানদের জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।