লাল সালাম, তাহাদের জন্য

লাল সালাম, তাহাদের জন্য

‘লাল সালাম, লাল সালাম, রক্তে ধোয়া মে তোমায় সালাম।’ ১৮৮৬ পহেলা মে। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট নামক স্থানে আট ঘন্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দেয় শ্রমিকরা। সেই থেকে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন হচ্ছে। আজকে এই দিনে সত্যিই লাল সালাম জানাতে হয় সেই সব বীর শ্রমিকদের জন্য। যাদের ঘামে শ্রমে আমরা বিকশিত হচ্ছি তাহাদের জন্য আমাদের এই লাল সালাম। যুগে যুগে তাহারা থাকুক আমাদের অন্তরে, অনন্য কারিগর হয়ে। মে দিবসের নিরন্তর শুভেচ্ছাও তাদের জন্য।

প্রায় ১৩৪ বছর পরও শ্রমিকদের একই দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। আন্দোলন করতে হচ্ছে ন্যায্য মজুরী এবং মজুরী বৈষম্যর বিরুদ্ধে। এ বছর সারা দুনিয়ার শ্রমিকরা নতুন আতংকের মধ্যে পড়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে আজ যখন মে দিবস পালন হবার কথা, তখন শ্রমিকরা অনাহার অর্ধাহার এবং কাজ হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন। এবছার সারা বিশে^র শ্রমিকরা অন্যান্য সব পেশার মানুষের মতো করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। শ্রমিকদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে দুই ধরণের। একদিকে করোনা, অন্য দিকে কাজ হারানোয় কর্মক্ষেত্রের যুদ্ধ। মে দিবসে যখন তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলবে, তখন তাদের ঘরে খাবার নেই। তাদের অনেকের ভবিষ্যত ঝুলে আছে করোনার মহামরীর মতো।

আজো কেন জনহেনরীর কচি ফুল মেয়েটির মতো শ্রমিক বাবার পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে। কেন অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এখনো শ্রমিকদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করবে। আজ যার কাজ আছে কালকে তার কাজ থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই কেন? কেন কোন কারণ ছাড়াই শ্রমিক ছাটাই হবে? কেন ইউনিয়ন করার দোষে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন নেমে আসবে? এর উত্তর খুঁজে পেতে হবে। এর উত্তর দিতেই হবে। এই দাবি কি অযৌক্তিক? মোটেই নয়। শ্রমিকদের শোষণ এবং বৈষম্যের মধ্যে রেখে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায় না। তারপরও আমরা প্রতি বছর শ্রমিক দিবস পালন করি। নানা বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপাতে শুনি। শুনি নানা আশ^াস বণী। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার একই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর কোন প্রতিকার নেই। শ্রম আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এবছর তো সব আইন করোনা গিলে খেয়েছে। কোন কথা বলারই সুযোগ থাকছে না।

জনহেনরীর প্রিয় সঙ্গীনী মেরী ম্যাকডেলিনের গল্প আমরা সবাই জানি। দিন-রাত সুরঙ পথে রেল রাইনের পাত বসানোর কাজ করতেন হেনরী। আর সেই সুরঙে স্বামীর কাজ করার শব্দ শোনার জন্য কান পেতে থাকতেন মেরী। কখন তার স্বামী কাজ করে বাড়ি ফিরবেন সেই অপেক্ষা করতেন। অপেক্ষায় থাকতো হেনরীর ছোট্ট কন্যা।

দিন-রাত কাজ করা হেনরী পাল্লা দিয়ে চলে ইঞ্জিনের সঙ্গে। সেদিন হেনরীকে পরাস্ত করার জন্য আমেরিকার সাদা বাহিনী বেশি বেশি লোহার পাত আমদানী করে চলে। যে জনহেনরীর হাতুড়ির ঝলকে বিদ্যুৎ চমকাতো। যে হেনরী মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করতো। হার না মানা হেনরী তারপরও ন্যায্য মজুরী পায়নি। কর্মঘন্টা কমেনি। সেই জনহেনরীরা ১৩৪ বছর আগে আন্দোলন করতে গিয়ে রক্ত দিয়েছে। সেই রক্তের ঋণ আজো পরিশোধ করা যায়নি। আজো কোটি জনহেনরীর স্ত্রী সন্তানরা আহাজারি করছে। সেই আহাজারীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা। সব মিলে শ্রমিকদের জন্য ভয়বহ আগামী অপেক্ষা করছে। 

এ বছর করোনার কারণো হয়তো শ্রমিকদের জন্য গালভরা বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটবে না। এমনিতেই শ্রমিকদের অধিকার কথার বুলির মধ্যে আবদ্ধ থাকছে। তার ওপর এবছর করোনা ঘারের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হয়ে আছে। শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন কতটা হবে তা সময়ই বলে দেবে। তারপরও আমরা চাই, এবছর যাতে করোনার কারণে কোন শ্রমিক বৈষম্যের শিকার না হয়। সেব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিক। প্রয়োজনে শ্রমিকদের জন্য দেওয়া প্রণোদনা তাদের হাতে পৌঁছে দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। করোনাকে জয় করে মালিক শ্রমিক যেন আমাদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে পারি সেদিকে নজর দিক।