শান্তিলতা দত্তের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

শান্তিলতা দত্তের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

গতকাল ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। এই দিনে পটুয়াখাী জেলায় জন্ম নিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শান্তিলতা দত্ত। শনিবার ছিল তাঁর ১০৮তম জন্মদিন। শান্তিলতা দত্তের জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

শন্তিলতা দত্ত ১৯১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তখনকার বাকেরগঞ্জ মহাকুমার ৬ নম্বর ফরিদপুর ইউনিয়নের কাকরধা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আশ্বিনী কুমার মজুমদার এবং মা বিমলা মজুমদার। ১৯৩০ সালে শান্তিলতা বরিশালের গৌরনদী থানাধীন বাটাজোড় ইউনিয়নের অনুকুল চন্দ্র দত্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামীও স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। সেই সুবাদে পরিচয় ও পরিণয়। স্বামীর অনুপ্রেরণা শান্তিলতা দত্তকে ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট’-এ আরও সক্রিয় ও সাহসী করে তোলে। 

শান্তিলতা দত্তের পারিবারিক নাম হিরণপ্রভা। ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময় কৌশলগত কারণে ছদ্মনাম ‘শান্তিলতা’ ব্যবহার এবং সে নামেই পরিচিতি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীনের পর অপরাপর স্বজনদের সঙ্গে তিনি ভারত যাননি। তিনি দেশে থেকে ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে তৎকালীন পটুয়াখালী মহকুমা তথা আজকের পটুয়াখালী জেলায় বসত গড়েন। আমৃত্যু তিনি পটুয়াখালী শহরের কেন্দ্রস্থল শহীদ আলাউদ্দিন শিশু পার্কসংলগ্ন নিজ বাড়িতে বসবাস করেছেন।

লেখকের সঙ্গে এই মহীয়সীর শান্তিলাতা দত্তের সঙ্গে ১৯৮৪ সালের এই দিনে কাকতালীয়ভাবে সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর জন্মদিনে এই সান্নিধ্য লাভ করেন লেখক। ১৯৮৪ সালের আগস্টের ১ তারিখ তিনি এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ADB-GiProject Construction Cell (Food) প্রকল্পে শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রথম কাজে যোগদান করার সুবাদে সাগরবিধৌত পটুয়াখালি জেলায় যান। হৃদয় জুড়ে সংস্কৃতির নিদ্রোত্থিত পোকাগুলো নড়েচড়ে ওঠায় কর্মক্ষেত্রের অগোচরে পটুয়াখালী ড্রামাটিক ক্লাবের থিয়েটার ওয়ার্কসপে যেতেন মাঝেমধ্যে। সেখানে পরিচয় ঘটে ড. ফজলুল করিম, ড. আলম, বিরেশ্বর বসু, কাঁলাচাদ সরকার, বাদল রায়, প্রফেসর বুলবুল, প্রফেসর আউয়াল বিশ্বাস, নির্মলদা, গাজী টারজান ভাইসহ অনেক সাংস্কৃতিক ও নাট্যকর্মী সঙ্গে।

শান্তিলতা দত্তের একমাত্র পুত্র মানসকান্তি দত্ত ড্রামাটিক ক্লাবের একজন কর্মাধ্যক্ষ। ক্রমশ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, যার পুরোভাগে ছিল মানসকান্তি দত্ত। ওনার উৎসাহ-উদ্দীপনায় অল্প দিনে ড্রামাটিক ক্লাবের কাযর্ক্রমে জড়িয়ে পড়েন লেখক। নানান আলাপে জানতে পারেন মহীয়সী নারী শান্তিলতা দত্ত সম্পর্কে। একদিন মানস কান্তি সঙ্গে আলাপের অগোচরে জেনে নেন শান্তিলতা দত্তের জন্মদিনের কথা। ছেলের সঙ্গে চলে যান এই মহীয়সীর সাথে পরিচিত হতে। ব্যাস এটুকুই পরিচয় পর্ব।

এরপর আর কারোর সঙ্গে যেতে হয়নি। সময়-সুযোগ হলেই একজন মায়ের সান্নিধ্যে ছুটে যাওয়া। তাঁর যৌবনের কথা শোনা। বিপ্লবের কথা শোনা। বিভিন্ন অপারেশনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শোনা। ‘বিয়ের আগে-পড়ে’ এসব নিয়ে অনেক কথা সাবলীলভাবে বলে যেতেন তিনি। এমনকি দেরীতে সন্তান গ্রহণ করাটাও তাঁর সংগ্রামের অংশ বলে অকপটে জানান বিপ্লবী এই নারী। একদিন আমার প্রশ্ন শুনে একাকী কতক্ষণ হেসে ধীরলয়ে বলেন, ‘রোমান্স করার সময় পেলাম কোই? দেশের কাজ করেই তো কুল পেতাম না।’

তখন ভিসিআর যন্ত্রটি বাজারজাত হয়েছে কেবল। মানসকান্তি কোন এক বিকেলে মাকে জানালো ‘লাভলুর ঘরে যাচ্ছি, ভিসআর-এ মুভি দেখতে।’ অমনি উল্টো তলব। রিসিভার জাগিয়ে তাঁর অফিসের ফোনে ‘কাম হিয়ার উইথ ইয়োর ভিসআর এন্ড দ্য মুভি হুইচ নেমড গান্ধি!’

যা বুঝার বুঝে ফেলি। সারা পটুয়াখালী শহরে ‘গান্ধি’ মুভির কোন কপি পেলাম না। অগত্যা উইক-এন্ডে ঢাকা থেকে ‘গান্ধি’ মুভির প্রিন্ট এনে তাঁকে দেখানো। কতবার দেখেছেন জানি না। প্রায় মাস খানেক তাঁর ঘরে বসে দেখেছেন। আমি পাশে থাকলে সেই সঙ্গে ছয় দশকের স্মৃতিচারণ থেকে থেকে। রাতের খাবারটা নিজ হাতে পরিবেশন করে খাইয়েছেন। তখন স্মৃতিচারণ করেছেন, কিভাবে শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের মা হতে পেরেছিলেন তিনি।

কালের সাক্ষি শান্তিলতা দত্ত জীবদ্দশায় অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পথিকৃৎ। এই মহীয়সী ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টে’র কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে প্রতক্ষভাবে স্বদেশী অসহযোগে আসীন হয়ে তৎকালীন প্রতিভা রাণী সেনগুপ্ত, কালিতারা বসন, নিবেদিতা সেনগুপ্ত এবং ভক্তিসেন গুপ্তর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে সামীল হয়েছেন। কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের তৎকালীন অগ্নি-মানব অস্ত্রবিদ্যায় বিদ্যায় পরদর্শী ড. বসন্তবাবুর কাছে শান্তিলতা দত্ত অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে নিজকে সক্রিয়ভাবে নিবেদিত করেন এবং বোমা তৈরি কাজে পারদর্শী হয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। নিবিড়ভাবে সাহচর্য পেয়েছেন, বিপ্লবী জননায়ক সতীন্দ্রনাথ সেন (সতীন সেন), দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, প্রাণকুমার সেন, শোভা সেনগুপ্ত, শান্তিসুধা ঘোষ, লটুসেন গুপ্ত, গজনন্দী নিত্যানন্দী, কেদার সমদ্দাররঞ্জন কুমার দত্ত, ঝর্না দেবী, সুধান ষেন গুপ্ত, লাফলু চান প্রমূখ। ১৯৪৪ সালে তিনি ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘসময় কারা বরণ করেন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর তৎকালীন ইন্ডিয়ান সরকার তাঁকে যে ভাতা প্রদান করত, তাও তিনি আর্থ-সামাজিক কাজে ব্যাবহার করতেন। 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি পটুয়াখালীর স্বরাজ প্রাঙ্গণে মহিলা সমিতি গঠন করে কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ভাষা আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে জনমত গড়ে তোলেন। এ ছাড়াও তিনি স্থানীয় মেয়েদের জন-সচেতনতা বৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থানের বিষয়ে গুরুত্মারোপ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। 

১৯৫৫ সালে দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনের প্রান্তে তিনি সন্তান লাভ করে কিছুদিনের জন্য সংসারী হন। ১৯৬২ সালে তিনি আবারও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হন। তখন রামকৃষ্ণ মিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় দুস্থদের সহযোগিতা করেন। এছাড়াও স্থানীয় হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন সমুন্নত রাখতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে সফল হন। 

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পড়ন্ত বয়সেও বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে সাড়া দিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা, চাল-ডাল, জ্বালানী, তেল, সংগ্রহ করে তাঁর অনুরক্ত মেয়েদের দিয়ে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠাতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান সম্বলিত লিফলেট গোপনে ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিলিবন্টন করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র স্থানান্তর কাজ নিজ দায়িত্বে করতেন। তরুণ পুত্র মানসকান্তি দত্তকে মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। এভাবে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলা-মায়ের মাতৃত্ব বিলিয়ে দেন তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির জন্য। ১৯৭৫ সালে বৈধব্য গ্রহণের পরও তিনি সামাজিক কার্যক্রমে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। ২০০৩ সালের ২২ নভেম্বর এই মহিয়সী নারী পৃথিবীর কক্ষপথে তাঁর পরিভ্রমণের সমাপ্তি টানেন। নিভৃতে স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যান সকল কোলাহল পাশ কাটিয়ে।

নিভৃত বলা এই কারণে যে, স্বদেশী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা,বাহান্নর ভাষা সৈনিক, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা শান্তিলতা দত্ত জীবদ্দশায় পেলেন না কোন রাস্ট্রীয় সম্মান। তাঁর মৃত্যুর সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শোক প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ওইপর্যন্তই। তাঁর ১০৮তম জন্মদিনে আবারো নবিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।