শোক আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তোমাদের

শোক আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তোমাদের

আজ বরিশাল নাটক, উদীচী বরিশালের মঞ্চসফল অভিনেতা খুরসিদ আলম রফিক ভাই চলে গেলেন। মাত্র চার দিন আগে চলে গেলেন অভিনেতা মজিবর ভাই। খুবই জটিল এবং কঠিন এক সময়ে তারা দুজন না ফেরার দেশে চলে গেলেন। যখন পৃথিবীর মঞ্চে দুর্দান্ত এক বিয়োগান্ত নাটক মঞ্চস্ত হচ্ছে। যার নাম ‘করোনা’। নাটকটির রচয়িতা গণচীন। প্রথম মঞ্চায়ন তাদেরই উহান প্রদেশে। দর্শক পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। শুধু আমাদের জানা নাই এই নাটকের মঞ্চ এবং নেপথ্যে কলা কুশলিদের নাম।

এই এক নাটক যেখানে কোন হাততালি নেই। আছে চাপা ভীতি, আছে নিঃশব্দে ক্রন্দন। আছে নিকটজনের স্পর্শহীন লাশ। একা, একদম একা। আর আছে সরব এক নির্দেশ ‘দূরে থাকো’। আমরা অপরিচিত এই নাটকের সঙ্গে আছি। আমাদের বোধ বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করা এই নাটক। আমাদের নাটক এভাবে কথা বলে না। আমরা মঞ্চে দাড়িঁয়ে যা বলি ‘জোট বাঁধো, ঘন হয়ে আসেন সকলে, দয়া করে স্থির হয়ে বসুন সকলে’। না, রফিক ভাই একেবারেই পারি নাই মঞ্চের এই আদেশ নির্দেশ মানতে। সময়ের রুক্ষতা, ভীতি, হতাশা একই সঙ্গে প্রতিকারহীনতা আমাদের সমষ্টিকে ভেঙে দিয়েছে। তাই পারিনি আপনার মৃতদেহবাহী কফিন কাঁধে নিতে। দারুন কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পারি নাই কাছে যেতে। সময়ের অনেক নিষেধ ছিলো যৌক্তিক কারণেই। তারপরেও জানাজায় দাঁড়িয়েছি মিরণ মুরাদের পাশাপাশি সম্ভাব্য দুরত্ব বজায় রেখেই। সকালে কাজল দা এসে ঘুরে গেছেন। জানি না আমরা আপনার কতটা কাছের ছিলাম। তবে আপনি ছিলেন এই নামগুলির সঙ্গে সার্বক্ষণিক মিলেমিশে। মঞ্চে, মাঠে, শহীদ মিনারে। জীবন মঞ্চে কতো কাছাকাছি ছিলাম আপনার। আপনার সঙ্গে আমার প্রথম মঞ্চ নাটক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘বিবিসাব’। 

মনে পরে, আপনার সাথের নামগুলো বেল্লাল চরিত্রে মুরাদ, বিবিসাব-শ্যামলি দি, কাসেম আলী-কাজল ঘোষ, রিকশা ওয়ালার চরিত্রে সমীরণ হালদার মিরণ, মায়ের চরিত্রে কাজী সেনিলা, আপনি ছিলেন-বসিরউদ্দিন মোল্লা মনে পরে? স্বাধীন বাংলাদেশে পরাধীন শক্তির কি দুর্দান্ত প্রতাপ তখন। কোথাও জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। সকল উচ্চারণ নিষিদ্ধ সর্বত্র। সেই প্রচন্ড বিপরিত স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বরিশাল নাটক মঞ্চে নিয়ে এলো ‘বিবিসাব’। এক পোড়খাওয়া সময়ের ভীষণ সাহসী এক নারী চরিত্র। আর আপনি ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী এক জল্লাদ রূপী চরিত্রের নাম বসিরউদ্দিন মোল্লা। এই দুই চরিত্রের মাঝে ছিলো এক অতি সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র মেম্বর। নাটকের এক পর্যায়ে বিবিসাব একটি সংলাপ উচ্চারণ করে ‘এই মেম্বার কইতে পারেন এই স্বাধীন দ্যাশে ওই রাজাকার বসিরউদ্দিন মোল্লারা বাইচ্চা থাকে ক্যামনে। ঘুইরা বেড়ায় ক্যামনে, ক্যাডায় অগোরে মাপ দেয়? তখন বসিরউদ্দিন মোল্লা রূপে রফিক ভাইয়ের অবিস্মরণীয় সংলাপ ছিলো, ‘ঐ মেম্বার ঐ বিডিরে কইয়া দেও ক্যামনে আমি এই দ্যাশে ঘুইরা বেড়াই, কারা আমারে জায়গা দেয়, কারা আমারে মাপ দেয়? আরে বিডি যে তোগো এই দ্যাশের স্বাধীনতা দিলো, ভালো বাসলো হেই বঙ্গবন্ধুরে তোরাই করলি খুন। হালার এই বেঈমানের দ্যাশে আমি বাচুম না, আমি ঘুরুম না, তয় ঘুরবে ক্যাডায়? এই সংলাপ স্বশব্দে উচ্চারণে যখন আপনি পুরো শহীদ মিনারজুড়ে ঘুরে ঘুরে দিচ্ছিলেন তখন আমি মাঝখানে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একাত্তরের এক জল্লাদের বিভৎস্য রূপ। কি অসাধারণ অভিনয় কি অসাধারণ অভিব্যক্তি। ক্যামন করে ভুলি আপনাকে? অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি, অসুস্থ্য ছিলেন। তাই আপনাকে জানানো হয়নি আপনাদের সময়ের আপনাদেরই এক মঞ্চসারথী মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান নাটকে নকরো চরিত্রের অভিনেতা শিশু সংগঠক মুজিবর ভাই চলে গেলেন মাত্র চার দিন আগে। 

আজ বরিশাল নাটক আপনাদের হারানোর শোকে শোকাহত। দেশের এই কঠিন সময়ে সংগঠনের সকলের উপস্থিতি সম্ভব হলো না। আজ এই বিদায়ের ক্ষণে সম্ভব হলো না নতজানু পুস্পার্ঘ অর্পন। মহান আল্লাহ্কে বলি হে মহান তুমি শান্তি ও তোমার শ্রেষ্ঠ স্থান জান্নাত, খুরসিদ আলম রফিক ভাই ও মুজিবর ভাইকে দান করো। ক্ষণিকের এই জীবন মঞ্চ থেকে সংলাপ শেষে চলে যেত হবে স্থায়ী এক স্থির মঞ্চে। যে দৃশ্য অসীম অনন্ত। সেই মঞ্চে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল-আমীন আপনাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করুক।