শ্রদ্ধা শহীদ জননী সাহান আরা বেগম

শ্রদ্ধা শহীদ জননী সাহান আরা বেগম

১৯৭৫-র ১৫ আগস্টের নির্মমতা থেকে একটি প্রজন্মকে আগলে রাখা শহীদ জননী মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম। ১৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়েও তিনি শেষ মহূর্ত পর্যন্ত স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। সেদিনের ঘাতকের বুলেট বিদ্ধ করলেও তিনি আগামীর স্বপ্নকে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। গত বছর এই দিনে তিনি ভালোবাসার সোনার বাংলাদেশ এবং প্রিয় জন্মভূমি বরিশাল থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। আজকের এই দিনে মহিয়সী এই নারীর প্রতি আমাদের বিম্র শ্রদ্ধা।

পুরুষ শাসিত সমাজে সব সময়ই নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়। কথা বলার অধিকার, নিজেকে বিকশিত করার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। নারীকে তাঁর পথ পরিক্রমায় অনেক বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। যুগে যুগে নারীরা আমাদের উন্নয়ন অর্থনীতির মূল অনুসঙ্গ হলেও তাদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। শত বধাবিপত্তির মধ্যেও কোন কোন নারী আমাদের সমাজ, উন্নয়ন-অগ্রগতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে অনন্য হয়ে আছেন। শত বাঁধা অতিক্রম করেই নারী আমাদের উন্নয়নের সমান অংশিজন হয়ে উঠছে। তাঁরা এক একজন হয়েছেন আমাদের অভিভাবকও। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের বুকে আমদের নারীরা যে অবদান রেখে চলেছে তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। সেই প্রমাণের এর এক নাম হচ্ছে সাহান আরা বেগম।

সাহান আরা বেগম। এক নারীর নাম। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেছেন বুদ্ধিদীপ্ত সাহসের সঙ্গে। সংসার, সন্তান, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবই সামাল দিয়ে অনন্য হয়েছেন তিনি। স্ত্রী, মায়ের মমতার স্পর্শ ছাড়িয়ে একান্ত আপন হয়েছেন সাহান আরা বেগম। দুহাতে আগলে রেখেছেন তাঁর পরিবারসহ রাজনীতি ও সংস্কৃতি। সকল প্রকার বৈষম্যকে পিছে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলা বরিশালের অনন্য সাহসী নারী হচ্ছেন সাহান আরা বেগম। দীঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি নারীদেরই এগিয়ে দিয়ে গেছেন। যে পথে তিনি হেঁটেছেন, বেড়ে উঠেছেন সেই পথ আরও সুন্দর হবে এমন প্রত্যাশা ছিল তাঁর। সাহান আরা বেগমের র্দঢ়তা, মমতা এবং সরল জীবনযাপন অনুসরণ করে অন্য নারীরা আগামীর পথ চলায় অনুপ্রেরণা পাবে। তাঁর আজন্ম চাওয়া নারীর অংশগ্রহণ, নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় করার পথ আরও সুগম হবে।

বরিশাল নগরের কাউনিয়া এলাকায় অন্য আর পাঁচটা কন্যার মতো বেড়ে ওঠেন সাহান আরা বেগম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ কাউনিয়াতেই। এই নগরের আলো-বাতাসের কৈশোর পার করেছেন। মাধ্যমিক গ-ি ছাড়িয়ে নিজেকে রাজনীতির মাঠে মেলে ধরেন তিনি। ছাত্রজীবনে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন সাহান আরা বেগম। ছাত্র রাজনীতির সেই পথচলায় ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের একজন হন তিনি। পড়াশুনার পাঠের মধ্যেই শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াাবাতের পুত্র বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বাক (মন্ত্রী) আলহাজ¦ আবুল হাসানত আবদুল্লাহর সঙ্গে জুটি বাঁধেন। এরপর সংসার আর রাজনীতির মাঠে সমানতালে ছুটে চলা তাঁর। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভেবেছিলেন স্বস্তি ফিরবে। ফিরেছিলোও। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় চরম ট্রাজেডির মধ্যে পড়তে হয় সাহান আরা বেগমকে। ৭৫ এর নারকীয় হত্যাকা-ের পর চেনা মানুষগুলো তাঁর কাছে অপরিচিত হতে থাকে। শিশু সন্তান হারা মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ২১ বছরেরও বেশি সময় প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ই করেছেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি কালো তিলক। সেই তিলক বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যায়। ওই কালো রাতে জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে নববধূসহ শিশু সন্তানদের। সেই দিনের ঘৃণা ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্টের মধ্যেও জীবন সংগ্রাম অব্যাহত ছিল তাঁর। সেই জীবন সংগ্রামের জীবন্ত ফসিলের নাম হচ্ছে সাহান আরা বেগম। যিঁনি সেই মৃত্যুপুরির মধ্যে থেকে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন শিশু পুত্র সুকান্ত বাবুকে। তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় নরপশুদের বুলেট। শিশু সন্তান সুকান্ত বাবু মায়ের বুকেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সেদিনের সুকান্ত বাবুর মা ৭৫’র ট্রাজেডির প্রত্যক্ষকারী শহীদ জননী সাহান আরা বেগম। অসীম সাহস নিয়ে সেই মৃত্যুপুরী থেকে আরেক পুত্র সাদিক, আজকের সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আাবদুল্লাহকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলেন। স্বামীকে ওই মৃত্যুপুরী থেকে রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওই নির্মমতার মধ্যে গুলি খেয়ে প্রাণে বেঁচে যান সাহান আরা বেগম। কেউ তাঁকে সানু বলে ডাকতেন। কেউ কেউ বলতেন সাহান আরা আবদুল্লাহ। ৭৫’র ট্রাজেডি বুকে ধারণ করে ৪৫ বছর ছিলেন বাংলার জমিনে। সুন্দর একটি দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিসংগ্রামের একজন ছিলেন ৭৫’র শহীদ জননী মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম। ৭৫-এ যিনি প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে স্বামী-সন্তানসহ সকলকে আগলে রেখেছিলেন, সেই শহীদ জননী সাহান আরা বেগমকে স্বামী, সন্তান-স্বজন, রাজনীতি কেউ আগলে রাখতে পারলো না। গত বছর এই দিনে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তবে তাঁর রেখে যাওয়া পথে হাঁটতে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন সব নারীদের।

৭৫-এর ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির শহীদ জননী সাহান আরা বেগম বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালের সেই দিনের নৃশংতা বলা কঠিন। ওই দুঃসহ স্মৃতি আজো আমি বুকে চেপে বয়ে চলেছি। ওই দিনের স্মৃতি বলতে গেলে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। সেদিন সেনা সদস্যরা বাড়িতে এসে আমদের সবাইকে দোতলা থেকে নীচে নামিয়ে আনেন। তখন আমার শ্বশুর সে সময়ের কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত বলেছিলেন, ‘তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? জবাবে ঘাতকরা বলেছে, আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই।’ এরপরই তারা ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। আমার চোখের সামনে আমার শ্বশুর আবদুর রব সেরনিয়াবতকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে। আমরা তখন ভয়ে আতঙ্কে জড়োসরো অবস্থা। এর কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যরা ওই কক্ষে এসে আবার ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু গুলি খেয়ে আমার কোলে মারা যায়। আমার গায়েও বেশ কয়েকটি গুলি লাগে। একজন মায়ের কোলে শিশুকে হত্যা করার স্মৃতি যে কতটা যন্ত্রণার হয়, সেটা কেবল মা-ই বুঝতে পারে। সেই স্মৃতি আজো আমি বয়ে চলেছি। পরে আহত অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও আমার সঙ্গে কাউকে দেখা পর্যন্ত করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন স্বপরিবারে হত্যা করেছে ঘাতকরা, তেমনি আমি এবং আমার পরিবারকেও তারা শেষ করতে চেয়েছিল। আমি আহত হয়ে বেঁচে আছি। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ১৫ আগস্টের ওই রকম দুঃসহ স্মৃতি যেন কোন মা কিংবা কোন পরিবারকে বহন করতে না হয়। আমরা চাই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন হোক। সেই বাংলাদেশে নারীরা বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখুক।’

সাহান আরা বেগম-এর স্বপ্ন আজ ডানা মেলেছে। তবে এখনো নারীরা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। নারীর অংশগ্রহণ, অথনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করতেই হবে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর হলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। তবে সেজন্য নারীর তাঁর আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে সকল বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে হবে। 
সাহান আরা বেগম। কারো তিনি ভাবী, কারো বোন, কারো কাছে স্নেহের ভালোবাসার সানু। আজকের বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মা হিসেবে কি তিনি পরিচিত হবেন? হয়তো অনেকেই সেই পরিচয় দিয়ে তৃপ্তি পাবেন। কেউ বলবেন বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক স্বাক্ষী সাবেক চীফ হুইপ, বর্তমান মন্ত্রী মর্যাদার আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আবদুল্লণাহর স্ত্রী। সব পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে সাহান আরা বেগম একজন সংগ্রামী নারীর নাম। স্রোতের সঙ্গে এবং স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে বেয়ে আমাদের সুন্দর আগামীর পথে আসতে কাজ করে গেছেন তিনি। রাজনীতির বাইরে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। আজকে তাঁর স্বজন, সন্তান, রাজনৈতিক কর্মী এবং সংস্কৃতিকর্মীরা খুঁজে ফেরে।  চলে যাওয়া মানে শেষ কথা নয়। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্যে অনেক ইতিহাস রেখে যাওয়ার গল্প আছে, যা আমাদের দিন দিন প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করবে। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া মহিয়সী নারী সাহান আরা বেগমের প্রতি আবারো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।