সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে এগারো দফা সুপারিশ টিআইবির

সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে এগারো দফা সুপারিশ টিআইবির

সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে দশম জাতীয় সংসদে ব্যাপক ঘাটতি ছিল এমন তথ্য উঠে এসেছে টিআইবির গবেশণায়। সংস্থাটি সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে এগারো দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে।
গতকাল ২৮ আগস্ট বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে ওই তথ্য জানানো হয়।


দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে প্রণীত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে গিয়ে বলা হয়, পরিসংখ্যানগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচকতা থাকলেও কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত আলোচনায় সংসদ সদস্যদের তুলনামূলক কম অংশগ্রহণ, সংসদীয় কমিটির প্রত্যাশিত কার্যকরতা, সংসদীয় উন্মুক্ততার ঘাটতি এবং স্পিকারের জোরালো ভূমিকার ঘাটতির ফলে সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে দশম জাতীয় সংসদ ব্যাপক ঘাটতি ছিলো বলে মন্ত্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)।


সংসদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে এগারো দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে প্রণীত ‘পার্লামেন্টওয়াচ: দশম জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে তেইশতম অধিবেশন’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দশম জাতীয় সংসদের ২৩টি অধিবেশনের নানা তথ্য তুলে ধরে এই সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটির তত্ত্বাবধানে এই গবেষণা পরিচালনা ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার, নিহার রঞ্জন রায়, ফাতেমা আফরোজ এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার।


সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সার্বিকভাবে দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সদস্যদের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এ গবেষণার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলো, দশম সংসদের অধিবেশনের বিভিন্ন পর্বসহ সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা; জনগণের প্রতিনিধিত্ব, সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করা; সংসদের ব্যবস্থাপনায় স্পিকার ও সদস্যদের ভূমিকা পর্যালোচনা; এবং সংসদীয় গণতন্ত্র সুদৃঢ় করতে, সংসদের কার্যকরতা বৃদ্ধিতে সুপারিশ প্রস্তাব করা। এই গবেষণায় সংসদ কার্যক্রমের যে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে সেগুলো হলো: আইন প্রণয়ন কার্যক্রম, জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কিত কার্যক্রম, জেন্ডার প্রেক্ষিত, সংসদ কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা ও সংসদীয় উন্মুক্ততা।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধী দলের সংসদ অধিবেশন বর্জনের যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, দশম সংসদ তা থেকে বের হয়ে আসলেও তা হয়েছিল অনেক উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে। সংসদে বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় সেরকম দলের অনুপস্থিতিতে দশম সংসদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আশা জাগানিয়া তেমন কিছু দেখি নাই। একদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সরকার দলের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং অন্যদিকে কার্যকর বিরোধী দলহীন সংসদ এ দু’টি অভূতপূর্ব ও ব্যতিক্রমী বিষয় পেয়েছি। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের সংসদের জন্য অপরিহার্য বিরোধী দলকে আমরা দশম সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে পাই নি। একদিকে সরকারের অংশবিশেষ ও অন্যদিকে কথিত বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তাদের একধরণের আত্মপরিচয়ের সংকট ছিল।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালিত হয়েছে। অন্যদিকে অধিকাংশ (৭১ ভাগ) আইনই গড়ে ১-৩১ মিনিটের মধ্যে পাশ হয়েছে। এটি সংসদ সদস্যের মূল দায়িত্ব আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের ঘাটতির প্রকট দৃষ্টান্ত। পাশ হওয়ার পূর্বে কোন আইন পড়ে দেখা বা অর্থবহ আলোচনা করে ভোট দেয়ার বিষয়ে তারা কতটা আন্তরিক বা কতটুকু পারদর্শী সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’

গবেষণাকালে দশম সংসদে কার্যদিবস ও কার্যসময়ের ব্যবহার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২৩টি অধিবেশনে মোট ৪১০ কার্যদিবসে সর্বমোট ১৪১০ ঘন্টা ৯ মিনিট ব্যয় হয়েছে। প্রতি কার্যদিবসে বৈঠককাল ছিলো গড়ে ৩ ঘন্টা ২৬ মিনিট। ব্যয়িত সময়ের হার অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কার্যক্রমে (৬০ ভাগ) আর আইন প্রণয়নে (বাজেট ব্যতীত) ব্যয় হয়েছ ১২ ভাগ সময়। ২৩টি অধিবেশনের মোট ব্যয়িত সময়ের ১৬৮ ঘন্টা ১২ মিনিট সময় আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে। পাশ হওয়া বিলসমূহের সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বিলগুলো উত্থাপন এবং বিলের ওপর সংসদ সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একটি বিল পাস করতে গড়ে সময় লেগেছে প্রায় ৩১ মিনিট। যদিও অধিকাংশ  (৭১ শতাংশ) বিলই পাশ হয়েছে গড় সময়ের চেয়েও কম সময়ে। উল্লেখ্য, এই সংসদে ১৯৩টি সরকারি বিল পাস হলেও ১৬টি বেসরকারি বিলের কানোটিই পাস হয়নি। এছাড়া খসড়া বিল পর্যালোচনা করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণে এবং আইন সম্পর্কিত আলোচনা পর্বে অংশগ্রহণের ক্ষত্রে সদস্যদের আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। পূর্ববর্তী সংসদের মত এই সংসদেও বিলের ওপর জনমত যাচাই-বাছাই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কন্ঠভোটে নাকচ হওয়া এবং আইন প্রণয়নে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের চর্চার ঘাটতি দেখা গেছে।

অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সার্বিকভাবে সংসদ সদস্যদের গড় উপস্থিতি প্রতি কার্যদিবসে ২২২ জন- যা মোট সদস্যের ৬৩ শতাংশ। সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের ৩১ শতাংশ অধিবেশনের মোট কার্যদিবসের ৭৫ শতাংশের বেশি উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীদের মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ মোট কার্যদিবসের ৭৫ শতাংশের বেশি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সংসদ নেতা অধিবেশনের মোট কার্যদিবসের ৮২ শতাংশ এবং বিরোধী দলের নেতা ৫৯ শতাংশ উপস্থিত ছিলেন। গড় উপস্থিতির ক্ষেত্রে নারী সদস্যরা পুরুষ সদস্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকতে দেখা যায় (৭১% বনাম ৬২%)। তবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংসদে নারী সদস্যদের সংখ্যাগত বৃদ্ধি ঘটলেও আইন প্রণয়ন, প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় নারী সদস্যদের ভূমিকা এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। প্রধান বিরোধীদল, অন্যান্য বিরোধী বা স্বতন্ত্র কোন সদস্য দশম সংসদ বর্জন করেননি। তবে তারা মোট ১৩ বার ওয়াকআউট করেন। এই সংসদের ২৩টি অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে মোট ১৯৪ ঘন্টা ৩০ মিনিট (১২ শতাংশ সময়) অপচয় হয়। এই কোরাম সংকটে ব্যয়িত মোট সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য ১৬৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৫ হাজার ৩৬৩ টাকা।

গবেষণার দেখা যায়, বাজেট আলোচনায় সরকারি দলের সদস্যরা ৭৭ শতাংশ, প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা ১৮ শতাংশ এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা ৫ শতাংশ সময় অংশগ্রহণ করেন। বাজেটের  বাড়তি আবগারি শুল্ক, বাড়তি ভ্যাট এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো এবং সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য অনিয়ম বিষয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের পাশাপাশি সরকারি দলের সদস্যরাও কড়া সমালোচনা করেছেন। বাজেট বিষয়ক সমালোচনার ক্ষেত্রে সরকারি দলের সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চা দেখা গেলেও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সার্বিকভাবে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে।

দশম সংসদে মোট ৫৭টি কার্যদিবসে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বের উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ হলো প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার পরিবর্তে তার বিভিন্ন কার্যক্রম ও অর্জন নিয়ে সংসদ সদস্যদের আলোচনা বেশি করা হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনা পর্যবেক্ষণে দখা যায়, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপনে এবং সদস্যদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনার প্রস্তাব ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যয়িত সময়ের বাইরে সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক জোট সম্পর্কে অসংসদীয় ভাষার (কটুক্তি, আক্রমণাত্মক ও অশ্লীল শব্দ) ব্যবহার এবং অন্য দলের শাসনামলের কার্যক্রমের ব্যর্থতাই এ পর্বের বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে। সুশীল সমাজ ও আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও বিভিন্ন অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া সংসদ নেতা এবং বিরোধী দলীয় নেতা উভয়ের বক্তব্যে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্পর্কিত আলোচনার পাশাপাশি সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোটের নেতা ও কর্মীদের সমালোচনাও ছিল উল্লেখযোগ্য।

সংসদ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিয়ম সম্পর্কে সদস্যদের নির্দেশনা প্রদানের পরও অধিবেশনের বিভিন্ন পর্বে সদস্যদের আক্রমণাত্মক ও অসংসদীয় ভাষা (কটুক্তি, অশ্লীল শব্দ) ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, যা বিধি ২৭০ এর ৬ উপবিধির ব্যত্যয়; অনির্ধারিত আলোচনা পর্বে মোট ব্যয়িত সময়ের ১৬ শতাংশই এ ধরণের অশোভন, কটু বাক্য ও অশালীন বক্তব্য প্রদানে ব্যয়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। কটুক্তি ও অশ্লীল শব্দ বন্ধে সতর্ক করা বা শব্দ এক্সপাঞ্জ না করার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। এছাড়া কার্যপ্রণালী বিধি (২৬৭-এর উপবিধি ২, ৪, ৮) অনুযায়ী অধিবেশন চলাকালীন গ্যালারিতে শৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রেও স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। উল্লেখ্য, অধিবেশন চলাকালীন সময়ে সদস্যদের একাংশের সংসদ কক্ষের ভেতরে বিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা করা, কোনো সদস্যের বক্তব্য চলাকালীন সময়ে তার নিকটবর্তী আসনের সদস্যগণ নিজেদের আসনে বসেই পরস্পর কথা বলার মত ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়েছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব (বিধি ১৩১) পর্বে উত্থাপিত ১০৫টি নোটিসের মধ্যে ৭০টি আলোচিত হয় এবং ৩২ টি স্থগিত হয়। আলোচিত ৭০টি নোটিসের মধ্যে ৬৭টি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কর্তৃক প্রত্যাখাত হয় যা উত্থাপনকারীদের সম্মতিক্রমে অন্যান্য সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে প্রত্যাহৃত হয়। জরুরি জন-গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে নোটিস (বিধি- ৭১, ৭১ (ক) অনুযায়ী ৪৭৫১টি নোটিসের মধ্যে ২৮৯টি নোটিস আলোচনার জন্য গৃহিত হয়।

সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম ও সুপারিশ পর্যবেক্ষণ করে গবেষণায় দেখা যায়, দশম সংসদের ২৩টি অধিবেশনে ৪৮টি কমিটি মোট ১৫৬৬টি সভা করে। এর মধ্যে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সর্বোচ্চ সংখ্যক সভা করে (১০৮টি)। বিধি অনুযায়ী প্রতিমাসে ন্যূনতম একটি সভা করেছে মাত্র দুইটি কমিটি। কমিটির সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আটটি কমিটিতে সদস্যদের (সভাপতিসহ) কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় যা কার্যপ্রণালী বিধি ১৮৮-এর ২ উপবিধির লঙ্ঘন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ৪৫ শতাংশ। তবে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা না থাকা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা গিয়েছে। এছাড়া স্থায়ী কমিটিগুলোর সভায় গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার না থাকায় এবং কমিটির প্রতিবেদন সংসদ সচিবালয় থেকে প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় কমিটি সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়না। প্রতিবেদন তৈরির সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় একেকটি কমিটির প্রতিবেদন কাঠামো একেক রকম, ফলে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতির চিত্র সুনির্দিষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। এছাড়া, পিটিশন কমিটির মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ থাকলেও প্রচারণার ঘাটতির কারণে এটি কার্যকর নয়।

গবেষণায় দেখা যায়, সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করলেও সরকারের মন্ত্রীসভায় প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি এবং দশম সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের বিতর্কিত অবস্থানের কারণে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে সংসদীয় কার্যক্রমে সরকার দলীয় সদস্যদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোটকে নিয়ে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার, সরকারে তাদের দ্বৈত অবস্থান উল্লেখযোগ্য। আইন প্রণয়ণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পর্বে জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা করা, প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় ওয়াকআউটের মতো সিদ্ধান্ত নিলেও তাদের প্রস্তাবসমূহ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতে দেখা যায় নি। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আর্থিক অনিয়ম নিয়ে সরকারের দৃষ্টি অকর্ষণ করতে দেখা যায়।

গবেষণায় পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সংসদীয় কার্যক্রম টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার অব্যাহত থাকাটা ইতিবাচক হলেও সংসদে উত্থাপিত আইনের খসড়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রচলিত পদ্ধতির (জনমত যাচাই-বাছাই, সংসদীয় কমিটি কর্তৃক জনমত গ্রহণ) কার্যকরতার ঘাটতি এবং জন অংশগ্রহণের সুযোগের চর্চা এখনো সীমিত। দশম সংসদের মোট ৫০টি সংসদীয় কমিটির মধ্যে ৪৫টি কমিটির ১০৫টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সদস্যদের উপস্থিতির তথ্যসহ সংসদীয় কার্যক্রমের বিবরণী, সংসদ সদস্যদের সম্পদের হালনাগাদ তথ্যসহ সংসদের বাইরে সদস্যদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও  স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করার উদ্যোগের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।

গবেষণার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়। পাঁচ ভাগে বিভক্ত এই সুপারিশমালায় সংসদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা, ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ন করা এবং কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হয় এমন সংসদ গঠনের সুপারিশ করা হয়। সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সংসদ সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করাসহ সদস্যদের জন্য ‘নির্দেশিকা পুস্তক’  তৈরি করা; সংসদে অধিকতর শৃঙ্খলা রক্ষাসহ অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে বিধি অনুযায়ী রুলিং দেওয়াসহ অসংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়া; আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ সদস্যদের আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন করা; জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয় এমন বিষয় ব্যতীত অন্যান্য আ ন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের বিস্তারিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার সুপারিশ করা হয়।
সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইনের খসড়ায় জনমত গ্রহণের জন্য অধিবেশনে উত্থাপিত বিলসমূহ সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং এর জন্য  পিটিশন কমিটিকেও কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়। সংসদীয় কমিটির কার্যকরতা বৃদ্ধির জন্য কোনো কমিটিতে সদস্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেলে উক্ত কমিটি থেকে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা; বিধি অনুযায়ী কমিটির প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করা; সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটিসহ জাতীয় বাজেটে তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক বরাদ্দপ্রাপ্ত শীর্ষ দশটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিসমূহের মধ্যে অর্ধেক কমিটির সভাপতি হিসেবে বিরোধী দলীয় সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া; কমিটি সভার প্রদত্ত সুপারিশের আলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা, এবং ব্যবস্থা গৃহীত না হলে তার বিস্তারিত মন্তব্য/ব্যাখ্যা লিখিতভাবে কমিটির পরবর্তী সভায় (বিধি অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে) জানানোর বিধান করার সুপারিশ করে টিআইবি।
তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি, বিধি অনুযায়ী কমিটি প্রতিমাসে একটি সভা করতে ব্যর্থ হলে তার ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন এবং কমিটির প্রতিবেদনসহ সংসদীয় কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং ওয়েবসাইটের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা; বাৎসরিক সংসদীয় ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা; সদস্যদের সম্পদের প্রতিবছরের হালনাগাদ তথ্যসহ সংসদের বাইরে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করারর সুপারিশ করে টিআইবি।

উল্লেখ্য, জানুয়ারি ২০১৪ হতে অক্টোবর ২০১৮ সময়কালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদের প্রথম হতে তেইশতম অধিবেশন পর্যন্ত এই গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গবেষণায় গুণবাচক ও পরিমাণবাচক উভয় ধরণের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎসের মধ্যে রয়েছে সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সংসদ কার্যক্রমের রেকর্ড, অধিবেশন সরাসরি পর্যবেক্ষণ এবং মুখ্য তথ্যদাতার। পরোক্ষ তথ্যের উৎসের মধ্যে রয়েছে সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদন, সরকারি গেজেট, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, বই ও প্রবন্ধ এবং সংবাদপত্র। গবেষণার জন্য প্রথমে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে সংসদের কার্যক্রম শুনে প্রয়োজনীয় তথ্য নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রে সংগৃহীত হয়। এতে সন্নিবেশিত বিষয়গুলোর মধ্যে আছে কার্যদিবস সংক্রান্ত সাধারণ তথ্য, কোরাম সংকট এবং সদস্যদের উপস্থিতি, অধিবেশন বর্জন, ওয়াক-আউট, স্পিকারের ভূমিকা, রাষ্ট্রপতির ভাষণ, বাজেট আলোচনা, প্রশ্নোত্তর পর্ব, জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিস সংক্রান্ত বিষয়, আইন প্রণয়ন, পয়েন্ট অব অর্ডার, বিভিন্ন বিধিতে মন্ত্রীদের বক্তব্য, সংসদীয় কমিটি সংক্রান্ত মৌলিক তথ্য, সাধারণ আলোচনা, সদস্যদের সংসদীয় আচরণ সংশ্লিষ্ট তথ্য ইত্যাদি। সময় নিরূপণের জন্য স্টপওয়াচ ব্যবহার করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যের সংশ্লিষ্ট সামঞ্জস্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সংবাদপত্র এবং সংসদ সচিবালয়ের তথ্যসূত্র থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।