সত্যজিৎ রায় ছিলেন চলচ্চিত্র বিপ্লবের পথিকৃৎ

সত্যজিৎ রায় ছিলেন চলচ্চিত্র বিপ্লবের পথিকৃৎ
প্রথম সিনেমা বানানোর আগে প্রায় ছয়টা বছর কলকাতা চলচ্চিত্র সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে। সুকুমার রায়ের সন্তান হিসেবে শিল্প সাহিত্যে যুক্ত হবেন এটা হয়তো সবাই জানতো। কিন্তু চলচ্চিত্র জগতে অসামান্য অবদানের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম অস্কার বাগিয়ে ফেলবেন তা হয়তো ভাবেনি কেউ। তবে একজন সত্যজিৎ এর কর্ম যেকোনো পুরষ্কারের চেয়েও অনেক বিশাল। তাই হয়তো বিবিসির করা জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালির কাতারে তাঁর নাম। প্রিয়জনদের কাছে মানিক দা হিসেবে পরিচিত মানুষটার পুরো ভাবনা জুড়েই ছিল জীবনের বাস্তবতার সহজ সরল কিন্তু আকর্ষণীয় দৃশ্যায়ন, তাঁর জীবন জুড়েই ছিল সিনেমা। তাইতো তাঁর বলে যাওয়া ‘যভাবেই হোক সমাপ্তিটা সুন্দর হওয়া চাই, সমাপ্তির আগ পর্যন্ত যতই বিষাদময় দৃশ্য আসুক জরুরী হলো সমাপ্তি সুন্দর করা’ - এই কথাটি সফল চলচ্চিত্র নির্মাণের টোটকার চেয়ে সফল জীবন গড়ার পরামর্শ হিসেবেই বেশি জনপ্রিয় হয়েছে মানুষের কাছে; যেভাবেই হোক শেষটা সুন্দর করা চাই! সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সৃষ্টি 'মহানগর' আমার ব্যক্তিগত পছন্দের একটি চলচ্চিত্র। রক্ষণশীল পরিবারের এক বধূর সেলস পারসনের চাকরি পেয়ে যাওয়া, স্বামীর উপার্জনের অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল ধরা, অন্তঃপুরবাসিনী গৃহকর্ত্রীর হঠাৎ পুরুষতান্ত্রিক সংসারে কর্তৃত্ব হওয়ায় অশান্তির সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক নারীবাদী সংঘাত আর পারিবারিক নাটকীয়তার এমন বাস্তব প্রতিফলন বাংলা ভাষায় আর কেউ সৃষ্টি করতে পেরেছে কি না আমার জানা নেই। একটা মুহূর্তে ‘সংসারের শান্তিটাই মূল’ বলে স্ত্রীকে চাকরি চালিয়ে যাবার ব্যাপারে নিষেধ করা অসহায় অনিল চট্টোপাধ্যায় যখন আবার শেষ দৃশ্যে স্ত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে ভীড় ঠেলে সাহসী ভাবে বেরিয়ে যায় তখন মনে হয় এমন শাশ্বত সুন্দর রোমান্টিক সমাপ্তি আর হতে পারে না। 'অপুর সংসারের' বিয়োগাত্মক হাহাকার শেষমেশ যখন বাপ-ছেলের হাতে হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া দিয়ে শেষ হয় তখন দর্শক চোখে পানি আর মুখে হাসি নিয়ে পর্দার সামনে থেকে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদীর বিরুদ্ধে 'হীরক রাজার দেশের চেয়ে ভালো স্যাট্যায়ার বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এখনো বিরল। আর বাঙালির শৈশব- কৈশোর রাঙাতে তো তাঁর সৃষ্টি অনবদ্য চরিত্র 'ফেলুদা' কিংবা 'প্রফেসর শঙ্কুকে' এখনো কেউ টপকাতে পারেনি। বাংলা সাহিত্য আর চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ একটা নতুন শ্রেণির সৃষ্টি করেছিলেন, তবে আশ্চর্যের বিষয় সেই শ্রেণির অভ্যন্তরে কোনো ভেদ ছিল না, ছিল না কোন সংঘর্ষ বা সংগ্রাম। একজন কৃষক যেমন সত্যজিতের গল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলতে পারতেন তেমনি ওই গল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারতেন সমাজের ওপর তালার মানুষটিও। এটাই সত্যজিৎ রায়ের জাদু। যে জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হতে বাধ্য তাবৎ পৃথিবীর সকল দর্শক। আর এই জাদুকরী কৃতিত্বের জন্যই অস্কারসহ অজস্র পুরষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীতে তিনি প্রায় পূজনীয় আদর্শ হয়ে গেছেন। শুধু সিনেমা নয়; সাহিত্য, চিত্রাংন, সঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন কলায় নাম কামানো এই সব্যসাচী কিংবদন্তির জন্ম কলকাতায় উনিশশো একুশ সালের আজকের এই দিনে। বেঁচে থাকলে হতেন আটানব্বই বছরের সিনিয়র সিটিজেন, তবে একমাত্র নিজ দেশের গন্ডির মধ্যে নয়, হতেন বাংলাদেশেরও। পূর্বপুরুষদের ভিটা আমাদের এই বাংলাদেশে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাঁর হৃদয়ে দাগ কেটে গেছিলো গভীর ভাবে, যেটার ওপর বানাতে চেয়েছিলেন সিনেমা। কিন্তু উইকিপিডিয়ার মতে, মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির হাতিয়ার কিংবা ব্যবসাদারী পণ্য বানাতে চাননি বিধায় সিনেমা করার দিকে এগোননি। আজ যখন স্বাধীনতার কথা বলে অনেকে মুখে ফেনা তোলে শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ হাসিলের আশায় তাদের কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা উচিত বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা যে কি না অন্য দেশের নাগরিক ছিলেন; সে কতটা সম্মানের চোখে দেখতেন আমাদের এ অর্জনকে! উনিশশো বাহাত্তর সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনের অতিথি হয়ে যখন ঢাকায় এসেছিলেন, নিজেকে তিনি দাবি করেছিলেন এ দেশের মানুষ হিসেবে। এই কিংবদন্তীকে তাই তাঁর বাংলাদেশের মানুষদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।