সরকারি প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হোক

সরকারি বরিশাল কলেজের নামকরণ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানান বক্তব্যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই বিভ্রান্তি দূর হওয়া একান্ত আবশ্যক। সাবেক ছাত্রদের অনেকে বলছেন কলেজের নাম পরিবর্তন হলে তাদের সার্টিফিকেটের কি হবে? ওই ছাত্রদের এটা বোঝা উচিত কোন কলেজ সার্টিফিকেট দেয় না। দেয় শিক্ষা বোর্ড। তাই সার্টিফিকেট নিয়ে অহেতুক শঙ্কার কথা তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোন মানে নেই। একই সময় সাম্প্রদায়িক উসকানীও দেওয়া হচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। আবার কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন ঐতিহ্যবাহী বরিশালের নাম মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এখানে অশ্বিনী কুমারের নামে কলেজ হলেও বরিশালের নাম কোনভাবেই মোছার সুযোগ নাই। তাছাড়া সরকরি বরিশাল কলেজের নামকরণ অশ্বিনী কুমারের নামে করার প্রস্তাবনা সরকারের। সেই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই এসব অবান্তর বিষয় নিয়ে কোনধরণের বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে বিষয়টির একটু ষুষ্ঠু সমাধান হওয়া দরকার।
একটা বিষয় পরিষ্কার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তর বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের সরকারি বরিশাল কলেজ। শুরু থেকেই অশ্বিনী দত্তের নামে কলেজের নামকরণের দাবি ওঠে। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মূলত ৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর পুরো ৮০’র দশক পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটি ভিন্ন পথে হাঁটে। ৯০ দশকে সেই যাত্রা কিছুটা পরিবর্তন হলেও মৌলবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরাই বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে থেকে যায়। সেকারণে বরিশাল কলেজের সঙ্গে অশ্বিনী কুমার দত্তের নাম যুক্ত করার বিষয়টি অনেকটা চাপাই পড়ে যায়।
২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সকরার ক্ষমতায় আসার পর ওই দাবি আবারো জোরালো হতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস বরিশালের রাজিৈনতক অভিভাবক আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আবদুল্লার পরামর্শ নিয়ে জাতীয় সংসদে সরকারি বরিশাল কলেজের নাম অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে করার প্রস্তাবনা তোলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ওই প্রস্তাবনা না পৌঁছানোর কারণে বিষয়টি আবারো চাপা পড়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে বরিশালবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে বরিশালের জেলা প্রশাসক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ একটি পত্র দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডকে এব্যাপারে একটি প্রতিবেদন দিতে বলে। এরপরই শুরু হয় বিরোধ। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন করোনার মধ্যে কেন এমন প্রস্তাব দেওয়া হলো। তাদের জন্য বলি, এটা করোনার সমেয়র প্রস্তাবনা নয়। এটি অনেক আগের। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এটি চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে বলতে পারেন। তাই অহেতুক বিরোধীতা না করে বরিশালের সঙ্গে কিভাবে মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করে প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে নজর দিতে অনুরোধ করবো।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ তথা বরিশালের কৃতি সন্তান মহাত্মা অশি^নী কুমার দত্ত। তাঁর নামে বরিশাল সরকারি কলেজের নামকরণের দাবিতে কয়েক যুগ ধরে বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলন করে আসছে। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকারি বরিশাল কলেজের নামকরণ মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে করে গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়।
আমরা সবাই জানি, বৃটিশ আমলে বরিশালের শিক্ষা, রাজনীতি এবং জ্ঞান অন্বেষণে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আর তার এই চিন্তার ফসল হিসাবে নিজের অর্থব্যয়ে বরিশাল নগরীর কালিবাড়ি রোডে জমি কিনে প্রথমে ১৮৮৪ সনে তাঁর পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রজমোহন বিদ্যালয়’। পরবর্তিতে তিনি দক্ষিণাঞ্চলে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ অর্থে ১৮৮৯ সনে তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রজমোহন কলেজ। কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন এই মহাবিদ্যালয়টিকে এক সময়ে ‘অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল’ নামে বৃটিশ সরকার অভিহিত করতো। এই মহামানব কলকাতায় চিকিৎসা গ্রহণকালে ১৯২৩ সালে মারা যান।
পাকিস্তান সরকারের আমলে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনটি সরকার রিকিউজিশন করে এবং তিনি সর্বদা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন বলে তার বাসভবনে ব্রজমোহন কলেজের কসমোপলিটান ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৬ সনে তার বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বরিশাল নৈশ মহাবিদ্যালয়’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নৈশ কলেজটিকে প্রথমে বরিশাল দিবা ও নৈশ কলেজে রূপান্তর করা হয়। পরে এটির নামাকরণ করা হয় ‘বরিশাল কলেজ’। এরশাদ সরকারের আমলে কলেজটিকে জাতীয়করণ করা হলে কলেজটির নামাকরণ করা হয় ‘সরকারি বরিশাল কলেজ’। ১৯৯০ সনে মহাত্মার ঐতিহাসিক বাসভবনটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়।
আমরা চাই, কোন ধরণের বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সুযোগ সৃষ্টি করে না দিয়ে সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে কেউ যেন প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ না পায় কিংবা সুযোগ করে দেওয়া না হয়। রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে সরকারের নেওয়া প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হোক। অবিলম্বে বরিশাল সরকারি কলেজের নামকরণ মহাত্মা অশি^নী কুমারের নামে করার প্রস্তাবনা দ্রুত বাস্তবায়ন হোক সেই প্রত্যাশা করছি।