সাংবাদিকতা চাপের মুখে : টিআইবি

সাংবাদিকতা চাপের মুখে : টিআইবি

রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা থেকেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত চাপ বেড়েছে। এই চাপ মোকাবিলা করে সৎ সাহস ও নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা এবং শুদ্ধাচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘করোনাকালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা এবং ‘কোভিড-১৯ বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২০’ ঘোষণা অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন আলোচকরা।

মঙ্গলবার (২২ জুন) অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ। অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন, বৈশাখী টেলিভিশনের প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট জুলফিকার আলি মাণিক, এমআরডিআইর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সহায়তা ডেস্কের প্রধান বদরুদ্দোজা বাবু এবং টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম।

প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অধ্যাপক ড. আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সাংবাদিকরা এখন আর নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন না। কোভিড বিষয়ে চুরি নিয়ে সব সাংবাদিকতা হচ্ছে, কিন্তু কোনো কাঠামোগত বিশ্লেষণ খোঁজা হচ্ছে না। এ সময়ে এসে নতুন পর্যায়ের সাংবাদিকতায় যেতে হবে। শুধু চুরি হওয়ার খবর নয়, কেন চুরি হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে সেটার কারণ খুঁজতে হবে।’

করোনা অতিমারি সাংবাদিকদের দায়িত্ব আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে মন্তব্য করে ড. গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘অসুস্থতা, মৃত্যু ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এসময়ে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগের ঘটনাও বেড়েছে। এখন সাংবাদিক এবং পাঠক-দর্শকরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন। দর্শক-পাঠকরা প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। তাই পাঠক-দর্শকরা সাংবাদিকদের ওপর ভরসা না করে কোনো সামাজিক মাধ্যমে ভরসা রাখছেন তা ভাবা দরকার, সেটা নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত।’

নীতি-নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতার গুরুত্ব তুলে ধরে জুলফিকার আলী মাণিক বলেন, ‘সাংবাদিকতায় বাইরের চাপ আমাদের নতজানু করে ফেললেও নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করেই সাংবাদিকদের তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ করতে হবে। তরুণ সাংবাদিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন হতে হবে। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্য বুঝেই সাংবাদিকতা করতে হবে।’

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন বলেন, ‘সাংবাদিকতায় সবসময়ই চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাংবাদিক সংগঠনগুলো সাংবাদিকের জন্য কী করছে? বিভিন্ন ব্যাপারে দোষারোপ করে সাংবাদিকতার সঙ্কট দূর করা যাবে না। এই ব্যাপারে অ্যাকাডেমিক আলোচনা প্রয়োজন।’

সাংবাদিকের সুরক্ষায় আইনি বিধানের গুরুত্বারোপ করে এশিয়ান টেলিভিশনের বার্তা প্রধান মানস ঘোষ বলেন, ‘গণমাধ্যম কর্মী আইন মন্দের ভালো। তারপরেও আরও অনেক কিছু দরকার আছে।’

আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে ফল ঘোষণা ও সমাপনী বক্তব্যে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় ধরনের চ্যালেঞ্জই বিদ্যমান। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা সাংবাদিকতাকে আয়নার সামনে দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়। বহিরাগত চাপের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবেশ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এটি সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল বিষয় হলে ‘জিরো সাম গেম’ অর্থাৎ ‘জিততেই হবে বা ক্ষমতায় থাকতেই হবে’! এজন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে, তাকে ধরাশায়ী করতে হবে। আর এই কাজটা যখন সাফল্যের সাথে বা তুলনামূলক সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হয় তখন বাকি থাকে নাগরিক সমাজের একাংশ এবং গণমাধ্যম যারা কথা বলে, যারা লেখে, যারা সরকারের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে চায়। সহায়ক ভূমিকা পালনের এই প্রয়াসকে সরকারের একাংশ শত্রু হিসেবে দেখে।’

টিআইবির কোভিড-১৯ বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২০ ঘোষণাকালে জানানো হয়, এ বছর নিয়মিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের বাইরে পৃথকভাবে কোভিড-১৯ বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রকাশিত-প্রচারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য টেলিভিশন এবং জাতীয় ও স্থানীয় প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়া এই তিনটি বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনটি বিভাগে বিজয়ী সাংবাদিকদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক দেয়া হবে।

প্রিন্ট মিডিয়া আঞ্চলিক ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের স্টাফ রিপোর্টার আবু রায়হান তানিন। ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন পত্রিকায় চট্টগ্রামে ‘করোনা রোগী আইসিইউ পায় না, ১২ হাসপাতালের গল্প পুরোটাই ফাঁকি!’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য তিনি এই পুরস্কার অর্জন করেন।

প্রিন্ট/অনলাইন মিডিয়া (জাতীয়) বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন সাংবাদিক সৈকত ভৌমিক। তিনি বর্তমানে অনলাইন পত্রিকা সারাবাংলা ডট নেট এর সিনিয়র করেসপন্ডেট হিসেবে কর্মরত।

ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন সাংবাদিক মুফতী পারভেজ নাদির রেজা। তিনি বর্তমানে একাত্তর টেলিভিশনে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজারে বিষাক্ত মিথানল’ শিরোনামে একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিভাগে এই পুরস্কার অর্জন করেছেন।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এমআরডিআই এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এশিয়ান টেলিভিশনের বার্তা প্রধান মানস ঘোষ, একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা প্রধান ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের রোভিং এশিয়া এডিটর মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, সিলেটের দৈনিক জালালাবাদের সম্পাদক মুকতাবিস উন নুরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকরা।