সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

সেতু মানে একটা নাম। মানুষ, নদী, কিংবা ঐতিহ্য জনপদের। সেতু মানে গতি, সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া অজস্র ভালো মন্দ জড়ানো স্মৃতি। যদিও আকার আকৃতির ভিন্নতা থাকে। বাকি সকলই এক। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা সব। আমরা যারা নদী বেষ্টিত এই জনপদের মানুষ, তাদের থেকে এই সত্য আর কে বেশী জানে? একদিন শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতি আর ধর্ম বিস্তারের পথ সুগম করে দিয়েছিলো নদী। যার এক পারে আমি এক পারে তুমি, মাঝ খানে বয়ে যেতো নদী। সেই দুই পারের দুই হাত আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছে সময়ের অধুনিক রূপ, সেতু। হয়তো কষ্ট পেয়েছে নদী, দ্বিখন্ডিত হয়েছে তার বুক, হারিয়েছে তার স্রোত। বিনিময়ে সমৃদ্ধ করেছে সে মানুষের অনবরত আগামী। তবু আমরা ভুলে যাই তাকেই। বাড়িয়ে জীবনের গতি আর মনে রাখি না। কোন দিন ছুটে চলা চোখ দুটো স্থির দাঁড়িয়ে আর প্রশ্ন করে না নদীকে ‘নদী তুমি কোন কথা কও?’ এ ভাবেই নদীকে পেছনে ফেলে আমরা চলি সামনে। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি নদীর চিৎকার ‘আমার পানি ফিরায়ে দাও, আমারে বাঁচাও। নয়তো মরে যাবে তোমরাও।’
দিন দিন এইসব কথা বলে বলে জীবন পথটা ক্রমশ ভারী হচ্ছে প্রতিদিন। কি জানি, এই যা লিখলাম সে কি ঠিক? না কি ভারি হচ্ছে বয়স, শরীর, সঙ্গে না চাইতেও মনটা? তাইতো প্রায়শই সঠিক করে খুব কিছু আর বলা হয়ে ওঠে না। সমস্যা থাকে নানাবিধ। বিশেষত এখন সময়টাই না কি সমন্বয় করে চলবার। সবাই তাই করছি। এই সহজ কথাটা প্রকাশ্যে যে মানতে চায় না, তাকে কি বলা যাবে হিপোক্রেট? মুর্দা কথা আমরা যা করে চলছি সেটাকে ঠিক সমন্বয় বলা যায় কি? এখন যে কোন লাভের প্রয়োজনে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া। হতে পারে সেটা টাকা কিংবা পদ, পজিশন, ক্ষমতা! নিদেন পক্ষে একটু ভাবের উণে¥ষ ঘটবে এমন কিছু পেলেও বিকিয়ে যাই। কি লিখবো, বিকিয়ে যাই সবাই, না কি কেউ কেউ? এই যে প্রশ্ন ভালো মন্দের, এই যে অদ্ভুত ধরণের পরম্পরা আলোচনার। তাকে অতিক্রম করেওকি চলছে না সুন্দর আর সমৃদ্ধির আরাধনা? চলছে। সেটা যারা দেখেও দেখছে না। জানতে, বুঝতে, শুনতে চাইছে না। তারা যে অন্ধ, তা বিশ্বাস করে বেকুব সাজবার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হচ্ছে না।
কেন হবে? কেউ কেউতো বলবে, আকছাড় বলছে ‘টাকার এ পিঠ ওপিঠ সমান’ তাকেই সত্য ভাবতে হবে? তা কি করে সম্ভব? সংসদ ভবনের ঠান্ডা ঘরে বসাদের হাতের টাকার এ পিঠ ওপিঠ। গুলিস্তানের প্রচন্ড গরমে সেদ্ধ কঠিন কঠোর উপার্জনক্ষম মানুষদের টাকার এ পিঠ ওপিঠ আর দেশের সর্ব দক্ষিণে সাগর পারের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের অর্জিত টাকার এপিঠ ওপিঠ কি সমান? সে কি করে হয়? তবু কিছু মানুষ এই সহজ অর্থহীন কথাটা বলে। মানুষ আকৃতির কিছু মানুষ বলে এখনো। সেই মানুষেরা এখনো বলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তিতে দঁড়িয়েও বলে ‘এর থেকে পকিস্তান আমলে আমরা ভালো ছিলাম!’
এমন উচ্চারণের পরেও কেন বলি না তোদেরও বোধ বুদ্ধি এখনো যে কোন পশুবৃত্তির এপিঠ ওপিঠ। হোক সে বরাহ, শারমেয় কিংবা খচ্চর। তাই আজ চোখের সামনে এমন বিস্ময়কর যোগ্যতম পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে, ইতিহাস ঐতিহ্যের সীমান্ত অতিক্রম করে, যখন জাতি হিসাবে শিড়দারা সোজা করে দাঁড়িয়েছি। তখন কোনো ছলছুতয় করো কোনো নপুংশকীয় আচরণ দেশের মানুষের কাছে আর গ্রহণযোগ্য নয়। আজ পদ্মায় শুধু মাত্র পানির স্রোতের উন্মাদনা নয়। আজ সেখানে দেশের মানুষের প্রাণের আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রয়োজন, উন্মত্ত পদ্মার সীমাহীন স্রোতের ঘূর্ণ মাতনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। আজ সেখানে দেশ স্বাধীনতার সূবর্ণ পথের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ যোগ্যতার আকাশ স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। তা হলে কেন আজ লক্ষ কোটি কন্ঠে ধ্বনিত হবে না, ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। কেনো আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে সমস্বরে উচ্চারিত হবে না বিজয়ের ধ্বনি ‘জয়বাংলা’? যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে। যেমনটা হয়েছিলো ক্রিকেট বিশ্ব আসরে বাংদেশের প্রথম বিজয়ের পর?
এমন গর্বিত অর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে কেন আজ বলতে ইচ্ছা করবে না এ দেশ, মাটি, মানুষদের? কেন বলবে না, আজ আমরাও পেরেছি। দেখুক পৃথিবী, বাংলাদেশ আজ দাঁড়িয়েছে বিশ্ব শ্রেষ্ঠ স্থাপনা নির্মাতাদের সারিতে। তবে আজ কেন বলবো না, অফসেট নীলে মোড়া ঐ যে দিগন্ত প্রসারিত আকাশ সে আমার। কেন বলবো না পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গমালা আমার। কেন বলবে না আজ বাংলাদেশ? বিয়াল্লিশটি পিলারে চুয়াল্লিশটি স্প্যান সংযোগ সমন্বয়ে যে সেতুটি প্রমত্তা পদ্মা নদী অতিক্রম করে দু’পারের মাটি স্পর্শ করলো, কি নাম তার? মুক্তির সূবর্ণ সেতু পদ্মা-।
মাওয়া জাজিরা প্রান্ত থেকে শিমুলিয়া প্রান্ত। এ পার ওপার দুই পারের অজস্র মানুষের আজ প্রাণের যে উচ্ছ্বাস, উল্লাস, যে অভিব্যাক্তি তার কি কোন ভাষা হয়? সত্যিই আজ আমাদের মতো অনেকেরই এই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রত্যাশা পুরণ কি নয়, আজকে উন্মোচিত হওয়া এই পদ্মা সেতু? আজ এ কথা বলতে যেয়ে যদি গর্বে ভরে ওঠে প্রাণ, তবে কেন বলবো না ‘আজ গর্বে আমার পা পড়ে না মাটিতে’। গত বিশ পঁচিশ বছরে আমরা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলাম ঢাকা থেকে দক্ষিণ জনপদের শেষপ্রান্ত সাগর কন্যা কুয়াকাটা পথের নদী পরাপারের সকল ফেরীগুলো একদিন নাই হয়ে যাবে? এমন কি পদ্মায়ও হয়ে যাবে সেতু! এর পরেও যে হৃদয় গর্বিত নয়। তারা সবাই চাপা পড়ে গেছে পদ্মায়, ঈর্শার বালুতে।
তাই তারা এখন সবাই কথা বলছে পাগোলের মতো। কি সে কথা, সে কি সম্ভব উচ্চরণ ভাষায়? তবু প্রয়োজনেই কখনো কোনো কথা মানুষের বিবেচনার সামনে তুলে ধরতে হয়। ওরা বলছে ‘এই সেতু কি প্রধান মন্ত্রী তার বাবার টাকায় করেছে? এটা কিসের উন্নয়ন, এটাতো কোন উন্নয়ন নয়। এটা হলো প্রয়োজন।’ তাও মন্দের ভালো ঈর্শার আগুনে পোড়া দৃষ্টিতে ওরা উন্নয়নটা না দেখলেও প্রয়োজনটাতো বুঝতে পেরেছে? তা হলে প্রয়োজনটা যখন দয়িত্বে ছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনার, তখন বুঝতে পারলেন না কেন? করলেন না কেন? কি ভেবেছিলেন কার বাবার টাকায় সেতু করবেন? একটা সহজ বুঝ বুঝে রাখুন। কারো বাবার টাকায় রাষ্ট্র চলে না। রাষ্ট্র চলে জনগণের টাকায়। কিন্তু মুশকিলটা হলো এই দেশের আমরা গাধা যারা জনগণ তারা কখনোই সেটা বোঝে না, জানে না, শোনেও না। আর শুনলেও সেটা বিশ্বাস করে না। যেদিন এই বুঝটা তারা বুঝতে শুরু করবে। সে দিন প্রশ্ন করবে তারা ‘কার বাবার টাকায় দেশে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হলো? কোন ভবনের হাওয়া ছিলো তাতে?’ প্রশ্ন করবে ‘যদি কেউ পদ্মা সেতুর অগ্রযাত্রার পথ ঘোলা করেও থাকে তার পরেও তাকে কেন পদ্মার জলে ফেলে চুবানোর কথা বলতে হবে?
অনেক আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে গর্বের পদ্মা বহুমুখি সেতু তার স্বপ্নের চোখ মেলেছে। সে উন্মোচিত হয়েছে গণমানুষের চলাচলের জন্য। তরিখ নির্ধারিত, ২৫ জুন ২০২২ সাল। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর সাহস, সততা, একাগ্রতা আর এতো যন্ত্রের সমন্বয়ে নির্মিত এই সেতু। কেবল সড়যন্ত্র, ফাঁকা বুলি, নাশকতার আগুন আর চোপ াদিয়ে থামানো যাবে না। আগুন জ্বলেছে সিতাকুন্ডে, আগুন জ্বলেছে ট্রেনে, আগুন জ্বলেছে গ্যাসের লাইনে, লেগেছে সে আগুন জুতা আর কাপড়ে। জানি না, এগুলি দুর্ঘটনা, না কি ঘটানো কোন ঘটনা? রাজনীতি তার প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে পারে। যখন লোভ আর হিংসার আগুন লেগে যায় মনে। সে প্রয়োজনে কেবল দেশ নয়। তার সাথে যুক্ত হয় দেশ বহির্ভূত হাত! আমাদের স্বাধীন ভৌগলিক সীমান্ত ঘিরে আছে প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো। সেই অকৃত্রিম বন্ধু প্রতিবেশীদের ইদানিংকালের হঠাৎ হঠাৎ আচরণ শত্রুর যোগ্যতাকেও হার মানায়। থেকে থেকে সীমান্তের ওপারে গুলি, নাফ নদীতে ভেসে আসে লাশ। বারবার সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি তার পর খবর যুবক কিংবা যুবতির লাশ। আমরা চুপ থাকি কারণ আমরা অকৃতজ্ঞ নই। কিন্তু সে কতক্ষণ? চুপ থেকে কি সব প্রশ্নের উত্তর মিলানো যায়? প্রশ্ন কি করতে হয় না, কেন এমন সময় আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)কে নিয়ে কটু উচ্চারণ আপনার দেশের নোংড়া রাজনীতির মুখে? কার জন্যে? আমাদের মনে রাখা দরকার বন্ধু, শত্রু সবার। সেটা হলো ইচ্ছা হলেই সীমা লঙ্ঘন নয়। ইচ্ছা হলেই ছোট বড়র যে কোন কুট চাল অবিশ্বাসকেই শক্তি যোগায়।
আমাদেরও অযোগ্যতা আছে, সীমাহীন সন্দেহ নাই। তা না হলে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কী করে বলেন ‘অমন জোরা জোরা তালি দিয়ে কিসের সেতু হবে?’ অথচ তার মতো শিক্ষাদীক্ষা, বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন একজনকে আমরাই আমাদের নেতা বানিয়েছিলাম বারবার। এমনটা হয়। এ বিস্ময় অতিক্রমযোগ্য নয়। এইতো মাত্র কিছুদিন আগের কথা, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ সম্মানিত সভাপতি বরিশালে এলেন। এসে গেলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, সঙ্গে মাননীয় মেয়র। পুষ্পার্ঘ্য অর্পন শেষে মেয়র বলছে আমরা দেখেছি অনলাইন লাইভে। মেয়র বলছেন, ‘আপনি জানেন, এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছেন বঙ্গবন্ধু। এ কথা কেউ আমারে জানায় নাই!’ এমন প্রশ্ন করবার মতো দৃঢ় প্রত্যয়ী মানুষ আমাদের মাননীয় মেয়র। যার শতভাগ নিয়ন্ত্রণে এই শহর, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। তিনিই আমাদের আগামী গড়বার অভিষ্ট লক্ষ্য। তার হাত ধরেই চলবে এই শহর বরিশাল।
এ সমস্ত কিছুই আছে, থাকবে। গত ২৫ জুনই প্রমত্তা পদ্মার ঘূর্ণি ¯্রােত স্তম্ভিত হয়েছে পদ্মার দুই পারের বিজয়ী বঙালির গগণ বিদারী জয়বাংলা শ্লোগানে। না কোন আমিত্বের উচচারণ নয়। কেবল থেকে থেকে উচচারিত হয়, ‘সাবাশ বাংলাদেশ। সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খাড় তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
এই পদ্মা পাড়ে উচ্চারিত হয়েছে ‘মহান জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ এর নাম। মওলানা ভাষানীর নাম। শের-ই-বাংলার নাম। জাতীয় চার নেতার নাম। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলনের সকল শহীদ ও বীরঙ্গনাদের নাম। আর শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হোক সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের নাম। স্ব-বিশেষ স্বর্ণ উচ্চারণে প্রকম্পিত হোক মাননীয় প্রধামন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নাম। যিনি দেশের জনগণকে প্রত্যাশা পূরনের শিখরে তুলেছেন। তার সঙ্গে উচ্চারিত হোক দক্ষিণ জনপদের আওয়ামী রাজনীতির বর্ষিয়ান দুই নেতা। আওয়ামী রাজনীতির কম্পাসখ্যাত জনাব আমির হোসেন আমু আর জনাব তোফায়েল আহমেদের নাম এবং অবশ্যই উচ্চারিত হোক জননেতা আবুল হসানাত আবদুল্লাহর নামও।
এই পদ্মা সেতুর নির্মাণকে যারা বলছেন সফলতা নয়, উন্নয়ন নয়, শুধুই প্রয়োজন। তারাও আসুন না পদ্মা পারে। দেখুন, বুঝুন, জানুন, শুনুন। তা না হলে বারবার ভুল বুঝে দেশ নেতৃত্বের এপিঠ আর ওপিঠের অর্থ করবেন। কিছুই মিলাতে পারনে না। কারণ বর্তমান সময়ের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হসিনার দেশ পরিচালনা এবং দেশাত্মবেধের, ধরন ধারণা আর যোগ্যতার কোন এপিঠ ওপিঠ হয় না। না, নেই। কেউ না।
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।