সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে লালমনিরহাট দৃষ্টান্ত হোক

সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে লালমনিরহাট দৃষ্টান্ত হোক

আমরা লক্ষ্য করছি, ধর্মের নামে গোটা দুনিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার এই আঁচে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার শীর্ষে এশিয়া মহাদেশ। ভয়াবহতার শিকার ভারত উপমহাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এই মুহূর্তে ভারতের মুসলমানরা তীব্র সংকটের মধ্যে আছেন। নানাভাবে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন মুসলিম ধর্মের মানুষ। তেমনি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়র মানুষের মনেও শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। আগে পরে বাংলাদেশেও এমন উসকানীর আঁচেন ঝলসে দেওয়া হয়েছে তাদের। কেবল আমার ধর্মের নয় বলেই তাদের ওপর হামলা চালাতে হবে এমন বর্বরতা বিশ্ব মানবতাকে বিম্মিত করছে।

আবার এটাও সত্য এত হানাহানি, ধর্ম নিয়ে বাড়ারি মধ্যেও দুই ধর্মের সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত দেখছি। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে নিশ্চিন্তে আশ্রয় পাচ্ছেন। মসজিদ এবং মন্দির রক্ষায় পরষ্পর বিরোধী ধর্মের মানুষ মানব বর্ম তৈরি করছেন। এটা আমদের মনে আশার সঞ্চর করে। বিশেষ করে আমাদের লালমনিরহাটে একই আঙিনায় মসজি এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানে কোন দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নেই। এটা সম্ভব হয়েছে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের কারণে। তাই আমরা বলতে চাই, সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে আমরা লালমনিরহাটের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি না? চেষ্টা করলে অবশ্যই পারি। তার প্রমাণ লালমনিরহাট। আছে হয়তো উপমহাদেশে অনেক স্থান। সেগুলো সম্পর্কে আমদের তেমন ধারণা নেই।

আমরা যে মানব ধর্মের কথা বলি সেখানে তো এই হানাহনির স্থান নেই। কারণ মুসলমানের আস্তিনের খঞ্জর এবং হিন্দুদের ত্রিশুলের আঘাতে কোন ধর্মের রক্ত ঝরে না। সেখানে কেবল মানুষেরই রক্ত ঝরে। সেই রক্তস্রোতকে হিন্দু-মুসলিম কিংবা অন্য কোন ধর্মে বিভাজন করা যাবে না। খঞ্জর, ত্রিশুল, বল্লম, দা, কাঁচির আঘাতে আমাদের শরীর থেকে বয়ে চলা রক্ত যখন জমিনের সবুজ ঘাস ছুঁয়ে যায় সেখানে কোন ধর্মের নাম লেখা থাকে না। সবাই তাকে রক্তের নদি বলে। ধর্মীয় এই উন্মদানা কোনভাবেই মানব জাতির কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

আমরা সারা দুনিয়ার মানুষের জয়গানের কথা বলতে চাই। যার মাধ্যমে মানব জাতির কল্যাণ সাধিত হবে। সেই ধর্ম যেন প্রতিটি মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যায়। ধর্মীয় উন্মদনায় অন্যের মাথায় আঘাত করার আগে যেন আমার পরিবার, আমার সন্তান এবং বাবা-মায়ের মুখগুলো একবার স্মরণ করি। আমরা যেন ধর্মের নামে মানুষের ওপর নির্যাতন না করি। আমরা যেন মানব বর্ম হয়ে সব ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। সেই মানবতার জন্য আমাদের অবশ্যই লালমনিরহাট কিংবা দিল্লির সেইসব মসজিদ রক্ষাকারীদের অনুসরণ করতে হবে।

লালমনিরহাটে এক আঙিনায় দুই প্রধান ধর্মের উপাশনালয়। মুসলমান ধর্মের মসজিদ আর হিন্দুধর্মের মসজিদের মাঝে দূরত্ব কেবল একটি সরু পায়ে চলা পথ। সেখানে বছরে পর বছর দুই ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষ যার যার ধর্ম পালন করে চলেছেন। কোনদিন সেখানে আজান, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি কিংবা শঙ্খের আওয়াজ নিয়ে কোন বিতর্ক হয়নি। দুই ধর্মের মানুষ একত্রে থেকে ভ্রাতৃত্ববোধের নজির স্থাপন করে চলেছেন।

শতাধিক বছর ধরে লামমনিরহাটের ধর্মপ্রাণ মানুষরা শান্তিপূর্ণভাবে একই আঙিনায় নামজ ও পূজার আয়োজন করছেন। সময়মত নামাজ হচ্ছে এবং নিয়মমাফিক চলছে পূজার আয়োজনও। এখানে এক ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মের মানুষের কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এটা লালমনিরহাট শহরের পুরান বাজারের ঘটনা। জনবসতিপূর্ণ এলাকা এটি। ১৮৩৬ সালে এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। ১৯০০ সালে একই আঙিনায় প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদ। সেই থেকে কোন রকম অনুযোগ-অভিযোগ ছাড়াই হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ যার যার ধর্ম পালন করছেন। দুই ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে সেখানে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দৃষ্টান্ত আমাদের বোধকে নতুন করে নাড়া দিয়েছ।

লালমনিরহাটে যখন দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রয়েছে, ঠিক তখনই ভারতের মতো দেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তায় চলছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার। মুসলমানদের ওপর হামলা মারধরের ঘটনা। নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষরা আহাজারী করছে। ঝরছে রক্ত, পুড়ছে বাড়ি-ঘর। এটা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। এখনো হিন্দু উগ্র মৌলবাদীদের উসকে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। যার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মানবতা। আমরা ধর্মের নামে এই হানাহানি দেখতে চাই না।

আমরা ধর্ম বলতে বুঝি লালমনিরহাট। ধর্ম বলতে বুঝি দিল্লির জুম’য়ার নামাজের মুসল্লীদের রক্ষায় মানব বর্ম তৈরি। ধর্ম বলতে বুঝি হিন্দুর বাড়িতে আমার আশ্রয় কিংবা মুসলমান বাড়িতে হিন্দুর আশ্রয়স্থল। ধর্ম বলতে বুঝি হিন্দু-মুসলামন, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব মানুষের মিলন কেন্দ্র। ধর্ম তো এটাই। আমি আমার ধর্ম পালন করবো। তুমি তোমার ধর্ম পালন করবে। আবার সব ধর্মের মানুষ মিলিত হবো একই মহোনায়। এক ধর্মের আয়জনে অন্য ধর্মের মানুষ সহযোগী হয়ে পাশে থাকবে। তাতে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টো।

কেবল আমার ধর্মের মানুষ নয়, আমরা সংখ্যায় তাঁদের চেয়ে বেশি বলেই তাদের ওপর হামলা চলাতে হবে। ওরা আমার ধর্মের নয় শুনলেই আমাদের মস্তিস্কে উন্মাদনার দানব নখের থাবা বিস্তার করতে উদ্যত হবে? উগ্রতার দানব চিৎকার দিয়ে বলে ওঠবে ওদের মেরে ফেল। ওদের ঘরে অগ্নিসংযোগ কর। নারী-শিশুদের শ্লীলতা হানি কর। এমন চিন্তা কোন ধর্ম করতে বলে এমনটা বিশ^াস করতে চাই না। ধর্মের মূল বিষয়বস্তু মেধায় মননে প্রোথিত থাকলে এই হিংসা, হানাহানিতে লিপ্ত হবার কথা নয়। আমাদের সেই মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। এই দানবীয় উন্মাদনা বন্ধ করতে হবে।

ভারতের বর্তমান সৃষ্ট দানবীয় ঘটনার জন্য মৌলবাদী বিজেপি সরকারকে দায়ি করা একান্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এর দায় অন্য রাজনৈতিক দল কিংবা গোটা ভারতের নাগরিকরা এড়াতে পারেন না। এই ধর্মীয় উন্মাদনা বন্ধ করতে ভারতের প্রতিটি নাগরিককে দায়িত্ব নেওয়া দরকার। একই সঙ্গে এটা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মহলেরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আর ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে যেন আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের সরকার সেব্যাপারে কঠোর আছেন এবং থাকবেন। এব্যাপারে আমরা আবারো লালমনিরহাটের উদাহরণ আমাদের পাথেয় হোক এমনটা প্রত্যাশা করছি।