সিডও সনদের পূর্ন অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আজ ৩রা সেপ্টেম্বর সিডও দিবস। সিডও হলো একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দলিল। ১৯৭৯ সালের ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই সনদ কার্যকর হতে শুরু করে। তাই ৩ সেপ্টেম্বর সিডও দিবস হিসাবে পালিত হয়। ইংরেজিতে এক বলা হয়েছে
(ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ অষষ ভড়ৎসং ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ) বাংলায় বলা হয়েছে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপ করে বলা হয় সিডও (ঈঊউঅড)। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সিডও দিবসে এবারের শ্লোগান: নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজনঃ সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন।
এ পর্যন্ত ১৮৯ টি দেশ সিডও সনদ অনুমোদন বা গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য যে জাতিসংঘ সিডও সনদ অনুমোদনকারী সেই রাষ্ট্র সমূহের কাছ থেকে কেবল জেন্ডার সমতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিই আদায় করেনি, সেই সঙ্গে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার অর্জনেও সক্ষম হয়েছে, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। তাই কোনো দেশ কর্তৃক সিডও ধারা অনুমোদনের অর্থ হচ্ছে যে, তা সেই দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন কানুন ও নীতিমালায় প্রতিফলিত হবে।
সিডও সনদের মূলকথা মূলবাণী হলো, মানব সমাজ সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে যুগ যুগ ধরে নারীরা যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান। সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমস্ত বিশে^ শান্তি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপন করা। মানুষ হিসাবে নারীর উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা। এর জন্য আইন প্রনয়ন প্রচলিত আইনের সংস্কার এরং আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি তথা প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপন করা। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দান। সিডও সনদে নারীর জনজীবন (চঁনষরপ) ব্যক্তিগত জীবন (চৎরাধঃব) উভয় ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার ওপর সমান গুরুত্ব দিয়েছে।
সিডও সনদের ৩০টি ধারাঃ
(১) ১ থেকে ১৬ মূল ধারা যা, নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কিত।
(২) ১৭ থেকে ২২ কর্মপন্থা ও দায়িত্ব বিষয়ক।
(৩) ২৩ থেকে ৩০ প্রশাসন সংক্রান্ত (সিডও)।
বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও অনুমোদন করে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদের ২ নম্বর ধারা এবং ১৬/১ এর(গ) অনুমোদন করেনি।
২ নম্বর ধারা হলো বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ। ২ নম্বর ধারা সিডও সনদের প্রান বলে পরিচিত এটাই মূল ধারা।
১৬/১ এর (গ) বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ কালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায় দায়িত্ব নিশ্চিত করা। সিডও সনদের মূল ২টি ধারায় বাংলাদেশের এ আপত্তি সিডও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০, ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ নম্বর ধারা সমূহে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই আপত্তি জানিয়ে ধারা সংরক্ষণ নারী-পুরুষের সমতার সাংবিধানিক নীতিকেই লঙ্ঘন করে।
জন্মসূত্রে সকল মানুষ স্বাধীন সমঅধিকার ও সমমর্যাদা লাভের অধিকারী সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার এই দর্শন নারীর মানবাধিকারের ভিত্তি। নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে জন পরিসরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেড়েছে নারীদের গতিশীলতা নারীরা গার্হস্থ্য কাজের সকল দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত হচ্ছেন ক্রমবর্ধমান হারে। কিন্তু নিরাপত্তার ঝুঁকি জীবনের ঝুঁকি সহিংসতা মর্যাদা হানির ঝুঁকি তাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে নানা ভাবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কর্মসংস্থান চলাচল তথ্য প্রাপ্তিসহ জনপরিসরের সকল ক্ষেত্রে অসম অবস্থা ও অবস্থানের কারণে নারীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সিডওর মতো মানবাধিকার দলিলের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
সিডও সনদের নিয়ম অনুযায়ী স্বাক্ষরকারী দেশ এটি বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই সিডও সনদ বাস্তবায়নের সকল দায়-দায়িত্ব হলো সরকার বা রাষ্ট্রের। আর এ ক্ষেত্রে জনগণ, সুশীল সমাজ বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠন সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। সনদের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৪ বছর পরপর এটি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে জাতিসংঘ সিডও কমিটিতে সরকার এবং বেসরকারি সংগঠনগুলো প্রতিবেদন জমা দেবে। সিডও কমিটি সেগুলো মূল্যায়ন করে সরকারকে কিছু সুপারিশ দেবে যা সরকার পরবর্তী ৪ বছরে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিবে।
নিজ দেশে নারী নির্যাতনের প্রতিকার লাভে ব্যর্থ হলে সরাসরি জাতিসংঘে অভিযোগ উত্থাপনের হাতিয়ার হলো সিডও অপশনাল প্রটোকল। ১৯৯৯ সালে এই অপশনাল প্রটোকল চূড়ান্ত হয়। ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশ তা স্বাক্ষরের মাধ্যমে অনুমোদন করে।
নারীর সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের আইনে সিডও সনদের অর্šÍভুক্তি এবং সে অনুযায়ী আইনের সংস্কার জরুরী। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সিডও সনদের ২টি ধারায় সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। যার ফলে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। অথচ নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য এ সনদের পূর্ণ অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও উদ্যোগ।
তাই বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, নারী সমাজ, নারী আন্দোলন ও মহিলা পরিষদের দাবি সিডও সনদের পূর্ন অনুমোদন ও বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
লেখক: পুষ্প চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল জেলা শাখা।