সুবর্ণ জন্মের পথে বাংলাদেশ

সুবর্ণ জন্মের পথে বাংলাদেশ
সুবর্ণ জন্মের পথে বাংলাদেশ
-আজমল হোসেন লাবু

২৫ মার্চ ১৯৭১। অপারেশন সার্চলাইটের 
নিষ্ঠুর নির্মমতাকে ভুলুন্ঠিত করে-  
পৃথিবীর মানচিত্রে ভিসুভিয়াছের অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো রক্তাক্ত উজ্জ্বল হলো এক নাম- 
বাংলাদেশ।

এক নিপীরিত জাতির দেশ নির্মাণের গল্প।
যে জননী জন্মভূমির দু’শ বছরের ইংরেজ গোলামি 
একুশ বছরের পাকিস্তান।

তাড়িত দুঃখ আর বৈষম্যের সীমাহীন উৎপীড়ণ, 
কন্ঠরুদ্ধ মায়ের দৃঢ়চিত্ত প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠিত 
রক্তে রঞ্জিত ভাষার চিৎকার- বাংলা। 
যে পথে অংকিত হয়েছে বাঙালির অহংকার
জন্ম স্বদেশ।

যে পথে হেঁটে হেঁটে এই জন্মভূমির শৈশব, কৈশোর 
আর এখন চিরন্তন যৌবন; সকল যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সময়।
মনে পড়ে- 
তার জন্মক্ষণে 
একাত্তরে একদিন হঠাৎ দুপুর বেলায় 
অফিস, কাচারি, স্কুল ছেড়ে হুড়াহুড়ি করে সবাই ছুটছে বাড়ির পথে।
পথে ভীড়,
দিক-বিদিক ছুটছে সবাই-
ছুটছে সময়, বিভৎস্য আতংকের জনপদে।
আকাশে তখনো যুদ্ধ বিমান,
তারই মাঝে ‘স্বাধীনতা’ নামের সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট চিৎকার ‘জয় বাংলা’।

ক্রমেই সে ভূকম্পনসহ বিস্তারিত হলো শহরজুড়ে।
পরাজয়ের সেই ঘন্টাধ্বনি শুনে
পাকিস্তানি সেনা সেদিন পালাচ্ছিল এ দেশ ছেড়ে। 
না, দেয়নি পালাতে মিত্র যুদ্ধবিমান
স্টিমার ডুবিয়ে দিয়েছিলো তালতলির বাঁকে।
সময়ের অস্পষ্ট স্মৃতি বলছে-
নিশ্চয়ই একদিন দেখেছিলে- ঝুনাহারের বাঁকে,
পাক সেনার গুলিতে খুলি ওড়া এক অর্ধডোবা লাশ;
ভেসে ভেসে খেয়ে নিচ্ছিলো কাক।
সেই অভাবনীয় বিভৎস্য দিন গুলোর অলিতে গলিতে 
কালো রাত্রির নৃশংস ভয়াল হাত।

আজ অত ভালো মনে নেই,
কে করেছিলো ভোর সকালের সেই চিৎকার- 
‘মিলিটারি আইছে’ শুনে সন্ত্রস্ত সবাই মিলে লুকিয়ে ছিলাম ঘরের পিরার কোনে।
বাড়ির পাশের সেই লোকটা
ধর্ম আর বয়স শ্রদ্ধার কারণ ছিলো যার,
শালা বারবার বলতো ঘুরে ঘুরে-
‘খান সেনারা পৃথিবীর সেরা, অগো লগে মুক্তিবাহিনী পারবো না’।

সেই বিভৎস্য বিভিষন যারা প্রতিনিয়ত করেছে দংশন,
ছড়িয়েছে বিষ, এই বিপন্ন দেশের পথে প্রান্তরে-
পুড়িয়ে ছাই করেছে ঘর, বাড়ি, মাটি, লুন্ঠন করেছে সম্ভ্রম, হত্যা করেছে  লক্ষ লক্ষ প্রাণ।

তবুও অদম্য মানুষ মুক্তির মিছিলে জ্বালিয়ে মশাল
ছুটেছে অপ্রতিরোধ্য অসীমের পানে।

কেবল এক, দুই, তিন নয়- আরো দীর্ঘ নয়টি মাস,
হাড়কাঁপা তীব্র শীত, জলে জঙ্গলে সাপ আর জোঁক,
ডাঙায় পাকিস্তানি তপ্ত ঝাঁঝালো বুলেট, 
ধর্মান্ধদের বিষাক্ত ছোবল,
সম্ভ্রমহীনাদের অশ্রুজলে স্বজনের লাশের জোয়ার।
আগুনে পুড়ছে ঝালকাঠি, আটঘর কুড়িয়ানা 
পেয়ারা বাগান; পুড়ছে স্বদেশ।

দূরে গোলার শব্দ যেন গর্জন ধ্বংসের,
রক্তাভ অগ্নিশিখা, যেন ভৈরবী হাহাকার সূর্যের।
তবু এক হাত এক অঙ্গুলী দেখে 
যুদ্ধ চলেছিলো এই দেশে 
ঘৃণার, প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, স্বাধীনতার।

রবিশংকরের সেতারের ঝঙ্কারে সেদিন বেজে উঠেছিলো সুর ‘বাংলাদেশ’
জর্জ হ্যারিসনের সুরের মুর্ছনায় দুলে উঠেছিলো ‘বাংলাদেশ’
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ের তপ্ত উচ্চারণে প্রকম্পিত হয়েছিলো ‘বাংলাদেশ’
গেরিলা যুদ্ধে রণাঙ্গনে
মুক্তি বাহিনীর থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ঝাঁঝাঁলো গর্জন
‘বাংলাদেশ’
অবারিত মাঠের সবুজ প্রান্তরে উষ্ণ রক্তস্রোত মিশে জেগে উঠেছিলো ‘বাংলাদেশ’।
সেইখানে অমোঘ বাণী, প্রাণের উচ্ছ্বাস- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। 

যেখানে চোখের মলিন জলে মায়ের বদন গেছে ভাসি
সেইখানে বাঙালির প্রাণের গান
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ 
ভালোবাসি ভালোবাসি, বুঝি না কেমন করে এতো ভালোবাসা যায়, এমন ভালোবাসাহীন!
বুঝি না তবু কেমন করে বারবার ভেঙে যায়
কালো চশমার ফ্রেম, 
কেন ভেঙে যায় তর্জনী তোমার?
দিশা কেন বারবার হারিয়ে যায় 
সুস্থ্য সুবর্ণ পথে ফিরে আসার? 
বুঝি না বুঝি না তব হায়- 
কি করে মনের গভীরের এই প্রশ্ন  যোজন যোজন দূরে ছুড়ে ফেলা যায়?
জানি না অনেক আলোকবর্ষ দূরে কেমন আছো তুমি- 
মানবসৃষ্ট আঁধার আলোকিত করেছে কি-
তোমার জন্মভূমি- বাংলাদেশ?


(২৪/১২/২০২০)