সুমধুুর সুর থেমে গেল, চলে গেলেন পীর হাবিব

চুপ করে তো থাকাই যায়। নিরূপায় বলা? এতো এখন নিয়ম হয়ে গেছে। চারিদিকের পরিস্থিতি পরিবেশ দেখে শুনে মনে হয় ‘শিল পাটার দিন শেষ এখন চলছে ডিজিটাল মাপের বাংলাদেশ।’ যেখানে মেপে চলা, মেপে বলা, মেপে হাসা, মেপে কাঁদা সব কিছুই একেবারে টু দি পয়েন্ট। একদম মেপে করা। বিষয়টা যে খারাপ তেমনটা বলবার সুযোগ খুবই কম। নিশ্চয়ই এটা ভালো। তবে বলতে চাইলে বলা যায় যে, বিষয়টি মূলত প্রাণহীন।
যেন ‘গানহীন এ দেশের প্রাণহীন চারিধার।’ এখন দারুন উজ্জ¦ল উচ্ছল প্রাণ আছে কেবল দাম্ভিক ক্ষমতা বিচ্ছুরণের। যেখানে মাপের পরিমান নির্ণয়ের কোন একক নেই। আর বলতে গেলে আমরা সবাই এখন তার অনুগত। এই অনির্ধারিত ধারাবাহিকতার বিপক্ষে কেউ কিছু বলার বা বলার চেষ্টা করেন, এমন কিছু বোঝাতে গেলেও, তাকে এক কথায় সবাই বলবে ‘তুই শালা ভন্ড।’
না, প্রকাশ্যে এমন উচ্চারণ সাহস করে উচ্চারিত হলেও কেউ এ কথা শুনেছে, এমন কোন আলামত পর্যন্ত মিলবে না কোথাও। এ এখন এমনই এক বেসুরো সময়। আর হবে নাইবা কেন? সুর অনুধাবনের জন্য তো চাই এক সতেজ প্রশান্ত মন, অনুভূতি। সে এখন আছে কার? চারিদিকের সব কিছুইতো এখন ডিজিটাল। সুর, গান, প্রাণ, বসন্ত, কোকিল সব! নিশ্চয়ই এমন এক ঝকঝকে বোধশুন্য বেসুরের রাজত্বে বোধকরি বেশ ভালোই আছি আমরা?
তাইতো ‘সুরের আকাশে আমি যেন শুকতারা’ এমন প্রাণবন্ত সুর-বাণীর আষ্টেপৃষ্টের বাঁধন কেটে মাত্র সপ্তাহান্তে চলে গেল লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখপাধ্যায় এবং বাপ্পি লাহিড়ী। আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনকে মায়াবী সুরের মুর্ছনায় আবিষ্ট করে রাখা তারাগুলো। তাই মনে হয় সুরের আকাশটা এখন বড় শ্রীহীন কিংবা অসহনীয় তীব্র নীল নয়তো ধূসর। মনে হয় তারকাহীন এই আকাশটা এখন কেবলই চন্দ্র আর সূর্যের চরম আধিপত্যের লালসার এক অর্থহীন রূপ। যেখানে উজ্জ¦ল রূপময় একটি তারাও যেন অবশিষ্ট রইলো না আর!
‘মেঘ থম থম করে’ গাইবে না আর ভুপেন। কিশোর গাইবে না ‘হামে তুমছে পেয়ার কিত্না এ হাম নেহি জানতে’ কিংবা ‘শাওন কা মাহিনা পাবান কারে সোর’ গাইতে আসবে কি মুকেশ? মোহাম্মদ রফির কন্ঠ থেকে আর ভেসে আসবে না ‘পাখিটার বুকে যেন তীর মেরোনা ওকে গাইতে দাও।’ কোথায় আর মিলবে হেমন্তের ভরা কন্ঠে গান ‘এই রাত তোমার আমার।’ জগন্ময়ের সেই গান চিঠি, ‘তুমি আজ কত দূরে।’ সুরের এই মানুষেরা আজ কতদূরে কে জানে? কোকিলও যার কন্ঠ শুনে লজ্জায় থেমে যেতো, ভাবা যায় সেই লতা নেই, সে আর কোনোদিনও গাইবে না কখনো, ‘বাঁশি কেন গায় আমারে কাঁদায়?’ মান্না দে আর সন্ধ্যার অবিস্মরণীয় সেই যুগলবন্দি ‘আমায় চিরদিনের সেই সুর বলে দাও।’ কে বলে দেবে এই সুর? এরা কেউ আর ফিরবে না। বাপ্পি লাহিড়ীও নেই, তবে আর কী করে হবে উদ্দাম সুরের সেই গান, ‘আই এ্যাম এ ডিসকো ডান্সার।’
যদিও এরা প্রায় সবাই একটা বয়সের পূর্ণতা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন, তারপরেও হয়তো যেতে যেতে জেনেও গেছে নিশ্চয়ই যে, এখন আর সুর নেই কোথাও। একটা সময় ছিল মানুষ গান শুনতো অবসরের প্রশান্ত হৃদয়ে। না, তেমনটা আর হচ্ছে না। মানুষ ক্রমশ এখন হৃদয়হীন। তাই আমরা এখন গান দেখি, শুনি খুব কম! তা ছাড়া প্রকাশ না থাকলেও সবাই জেনে গেছে, সকল সুর এখন অসুরদের দখলে। তা না হলে বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিনী লতা মঙ্গেশকর কেন বলবেন, ‘আবার যদি আসি তবে লতা হয়ে আর আসতে চাই না!’ এর থেকে বড় বিস্ময় আর কি থাকতে পারে? অথচ আমরা এই সকল মানুষদের জনপ্রিয়তায় কতই না ঈর্ষান্বিত হই। শয়নে স্বপনে কতই না হতে চাই ওদেরই মতো, তাদের বিত্ত বৈভব দেখে দেখে আমরা কত ছোট ভাবি নিজেদের!
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিসহ সকল শ্রেণি পেশার সার্থক মানুষরাই মূলত একা। তেমন একজনের কথা বলতে আজ বড় সাধ হচ্ছে। যাকে আমি দেখিনি কখনো, কোন কথা আমার হয়নি তার সাথে কোনদিন। নিজ ক্ষেত্রে দারুন সফল সার্থক মানুষ। সাংবাদিক, রাজনীতিক বিশ্লেষক, লেখক পীর হাবিব। যখন এই উপমহাদেশের সুর ও সঙ্গীতের তিন মহারথী বিদায় নিলো সঙ্গীত জগৎ থেকে। তারই ফাঁকে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন পীর হাবিব। তারপর থেকে প্রতিদিন চোখ রাখি পত্রিকার পাতায়। না, কেউ না। তার কোন সহযোদ্ধা এক কলমও লেখেননি তাকে নিয়ে! রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক জ্ঞাপন করেছে। আর কে, কারা?
ভেবেছিলাম আর কেউ কিছু না লিখলেও নঈম নিজাম কলম ধরবেন, শোক জানাবেন। লিখবেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও। হলো না। কেন হলো না? বোধকরি সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ বন্ধুরা প্রায় সবই এখন ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের সার্চ কমিটি নিয়ে। তারা অনেকে নিজেদেরকে ভাবতে শুরু করেছেন জাতীয় বিষয়ের নীতি নির্ধারক হিসাবে। তাই ঠিক সময়টা হচ্ছে না। বন্ধুকে নিয়ে লিখবার, সহযোদ্ধাকে নিয়ে ভাববার। ভালো!
ভালোই, এভাবে ভুলে যাওয়া। কারণ পীর হাবিবদের মনে রাখবার মতো বুক, মন ও মাথার জোর এখন আছে কার? আপোষ কে না করে, কে না করি? কার দিকে আঙ্গুল তুলবো কে চাটুকার নয়, কম আর বেশি এইতো? তার পরেও পীর হাবিবের কলম যা লিখেছে সে কি অভিবাধনযোগ্য নয়? তার দোষ ছিলো সে একটু বেশী আওয়ামী লীগ ঘেঁষা। অন্যান্য সকল রাজনীতিবিদদের বদ্ধমূল ধারণাটা তেমনই ছিল। অতএব তারা তার মৃত্যুর খবরে আনন্দিত না হলেও লোক দেখানো চুপতো থাকতেই পারে। তাই বলে সবাই কেন চুপ?
কারন তার একটাই। সেটা হলো তাঁর কলম। যে কলম ঘরকেই সবথেকে বেশী ব্যাতিব্যস্ত রেখেছিল। তাদের কৃত কর্মের কথা অনবরত লিখে লিখে রক্তাক্ত করেছে সে। মনে থাকবার কথা সবার। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গাড়ি থেকে যখন টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই সময় পীর হাবিব লিখেছিলেন ‘এতো অন্যের বিড়াল খোঁজেন, দেখুনতো নিজের থলের বিড়ালটাকে এবার চিনতে পারেন কি না?’ যে দিন ময়মনসিংহ কলেজের ছাত্রলীগ হোস্টেলে নিয়ে ধর্ষণ করলো কলেজে স্বামীর সাথে ঘুরতে আসা তার স্ত্রীকে। সেই সময় কোন কলম লিখছিলো ‘এ কোন ছাত্রলীগ এদের লালন করে কারা?’ যখন বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত ফুটবল ক্লাবগুলো ক্যাসিনো জুয়ার স্বর্গ সৃষ্টি করে, খেলাধূলাকে বামন বানিয়ে বাক্সবন্দি করে রেখেছিল! প্রমাণ মিললো এরা সবাই যুবলীগ। তখন এই পীর হাবিবই লিখতে পেরেছিলেন ‘এ কোন যুবলীগ, জুয়া যার ধর্ম? এদের উপরের ছায়া কোন আওয়ামী লীগাররা? আমরা কি ভুলে গেছি তার এমন হাজারো লেখা?
আসলে সময়টাই বড় অদ্ভুত। যখন সত্য পড়ে, সত্য দেখে, সত্য জেনে আমরা ডানে বামে তাকাই আর ভাবি কেউ দেখলো কি না। তার পরেও কিছু লেখা থাকে, থাকবে। ভয় অতিক্রম করে কেউ সে লেখা পড়বেও। স্বর্থের উর্ধ্বে গলা তুলে হয়তো কেউ কেউ সাহস করে বলবে, হ্যাঁ, পড়েছি। প্রশংসা জরুরী নয়। জরুরী হলো সত্যের পাশে, সাথে, অনুশীলনে থাকা।
বয়সটা তাকে মারেনি, তাকে মেরেছে রোগ। ক্ষতি হয়েছে অনেক। আমার আপনার সবার। রাজনীতির অন্ধকার গলিতে আলোর দিশার কথা লিখতেন পীর হাবিব। তিনি বারবার লিখেছেন, হেফাজত তোষণ ভীষণ বিপদের। এ পথ আওয়ামী লীগকে চেয়ারে বসে থাকতে দিলেও অপ্রিয় করবে দারুনভাবে। এখন ওরা সুযোগ দিয়ে নিজেরা সুদৃঢ় করছে আগামীর চলার পথ। এই পথে চললে পথ হারাবে আওয়ামী লীগ, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
এতদিন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে যারা ভাবতে পারেনি। তাদের এখন একটাই কাজ, ভোল পাল্টে ঝড়ের বেগে আওয়ামী লীগার হওয়া। আর সত্যিকারের আওয়ামী লীগারদের ঘরে তুলে দেওয়া। এখন বাংলাদেশের প্রায় সকল আওয়ামী নেতাদের হাত ধরে সেই কাজটাই চলছে অত্যন্ত সফলভাবে। কথাগুলো অনবরত লিখতেন তিনি।
বর্তমান উন্নয়নের ভুয়সী প্রশংসা করেও, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের এই মুহূর্তে আর কোন বিকল্প নেই। এ কথা বারবার লিখেও, লিখতে ভুলেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকেই মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারপরে অনেক দিন তার কোন লেখা আসেনি হাতে। তখন তার চিকিৎসা চলছিল দেশের বাইরে। সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসেই স্বরূপ ধারণ করলেন তিনি। লিখলেন পরপর বেশ কিছু লেখা, প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগলো আওয়ামী ঘরে। আপনি লিখলেন, ‘যে সেতু ও সড়ক মন্ত্রী, তার দলবল নিয়ে রাস্তায় গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ণ থামাতে পারে না, সে কি করে রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল ঠেকাবে?’ এবং পরেই লিখলেন সেই লেখা, ‘আপনারা আলালের ঘরের দুলালদের থামান। ওরা উলঙ্গ হয়ে গেছে। সমস্ত কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে’। তার পরেই দেখলাম টাকলু মুরাদের পদচ্যুতি, মন্ত্রীত্ব চ্যুতি, দেশ ছেড়ে পালানোর দেশাত্মবোধ! সম্ভাবত এর পরে আর লিখতে পারেননি আপনি। শরীর আর যথাযথ সহযোগিতা দিলো না। বড় ভালোবাসতেন এই দেশ, মানুষ। ভালোবাসতেন স্বাধীনতার মূল্যবোধ, আওয়ামী লীগ আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। হঠাৎ এ আসর ছেড়ে আপনার চলে যাওয়া বড় কঠিন হলো। যেমন লতা, সন্ধ্যা আর বাপ্পির চলে যাওয়ায় সুর-মধুর সাগর লবনাক্ত হলো।
কেন এমন হলো জানি না। কেবল স্রষ্টাই জানেন এই বিয়োগান্ত বিদায়ের সমাধান। আমরা শুধু চাইতে পারি তাদের আত্মার শান্তি, মুক্তি আর স্রষ্টার আসরের শ্রেষ্ঠ স্থান। তাই-ই চাই। তাই যেন হয়।
লোখক: আজমল হোসেন লাবু, বংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।