স্মৃতিপটে বঙ্গবন্ধু

স্মৃতিপটে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরর রহমানকে প্রথম দেখা আমার ছেলেবেলায়। সময়টা হবে ১৯৫৫-এর শেষের দিকে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আমি। বাবার হাত ধরে স্টিমার ঘাট গিয়েছিলাম জনসভায়। সেই জনসভায় এসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেক নেতা। তখন তিনি পূর্ববঙ্গ সরকারের ভূমিমন্ত্রী। অতি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন শেখ মুজিব। তাঁর ভাষণের মূল কথা দুর্নীতিমুক্ত ভূমিরাজস্ব বিভাগ সৃষ্টি। তিনি বললেন, ‘আর দুর্নীতি নয়। কেবল তিন পয়সার একটা পোস্টকার্ড লিখে জানাবেন, তারপর ঘরে বসেই খবর পাবেন, দুর্নীতিবাজের কী হয়’। আরও বললেন, ‘ঠিকানা লিখবেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারিয়েট, ঢাকা’। সেই জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সেই স্মৃতি, কেবল স্মৃতিই। আমার বাবা করতেন কেএসপি বা কৃষকশ্রমিক পার্টি। ৫৪-র নির্বাচনে তিনি সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে। সেই সূত্রেই বাবার হাত ধরে রাজনৈতিক সভায় যাওয়া। 

তারপর দীর্ঘকাল পেরিয়ে আবার যখন বঙ্গবন্ধুর দেখা পেলাম, তখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাঙলার ইতেহাস ও ভূগোলে। ‘পূর্ববঙ্গ’ হয়েছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ (১৯৫৫-এর ১৪ অক্টোবর থেকে)। ঘটেছে অনেক ঘটনা, অনেক অঘটন। 

১৯৭০ সালের কথা। সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু বরিশাল অঞ্চলে এসেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। কার্যসূত্রে ভীরে গেলাম তার নির্বাচনী কাফেলায়। আমি তখন এপিপি-র (্এসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান, দেশ স্বাধীনের পর যা হয় বাসস বা বিএসএস) বরিশাল প্রতিনিধি আবার ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা। রাজনৈতিকভাবে তখন আবার ন্যাশনাল আওয়ামীপার্টির (ন্যাপ, মোজাফ্ফর) কর্মী। পেশার সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী। মঠবাড়িয়ায় নির্বাচনীসভা। তখন মঠবাড়িয়া এতো কাছে ছিল না। লঞ্চযোগে তুষখালী, সেখান থেকে নৌকায় মঠবাড়িয়া। এই বন্ধুর পথ পেড়িয়ে সভা শুরুর আগেই মঠবাড়িয়া পৌঁছা। নির্বাচনীসভা মঠবাড়িয়ায় কে এম লতিফ ইনসটিটিউট মাঠ। সভা শুরুর আগেই লোকসমাবেশে পরিপূর্ণ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। স্থানীয় বক্তাদের বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ালেন। চারদিকে পিনপতন স্তব্ধতা। গুরুগম্ভীর কঠে উচ্চারিত হলো ‘ভায়েরা আমার...’ তারপর বক্তৃতা, দীর্ঘ বক্তৃতা। সে কী যাদুময়ী শব্দ উচ্চারণ আর প্রোক্ষোপণ! ‘কে রোধে তাঁহার বর্জকণ্ঠ বাণী’? বক্তৃতা যখন শেষ, সূর্য তখন লাল আলো ছড়িয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। উদ্বেলিত জন¯্রােত ত্যাগ করছে সভাস্থল। কারো কণ্ঠে কোনো উচ্চবাচ্চ নেই, যেন মোহাবিষ্ট দক্ষিণবাংলার বিশাল জন¯্রােত। আমাদের কাজ শেষ। ফিরে যেতে হবে বরিশালে, উদ্দেশ্য সংবাদ প্রেরণ। আবার সেই পথ চলা। সারা পথ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চর্চা। সঙ্গে ছিলেন শহীদ সেরনিয়বাদসহ আরো কয়েকজন সাংবদিক বন্ধু; ঠিক নাম মনে করতে পারছি না। তবুও সেই স্মৃতি অম্লান অবিনস্বর।

দিন যায়, ইতিহাস এগিয়ে চলে। আসে ১৯৭১। ৭ মার্চ। ঢাকাতেই ছিলাম। গেলাম ঘোরদৌঁড় মাঠে। বেশ পেছনে দাঁড়িয়ে শুনলাম অমর কবিতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’। ২৬ মার্চ সন্ধ্যার দিকে বরিশালে পৌঁছল বাংলাদশের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা। ছোটো একটু কাগজে ‘টরেটক্কা’ টেলিপ্রিন্টারের মুদ্রিত সেই বার্তা। তখন বরিশালে ফটোষ্ট্যাট করার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই হাতে লেখাই ভরসা। গুলবাগের ‘হক ভাই’ (আবদুল হক) চটজলদি আধা দিস্তা সাদা কাগজ কিনিয়ে এনে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি কপি করতে লেগে যাও। টেলিপ্রিন্টারের ছাপা বেশিক্ষণ থাকে না। সেই বার্তার নিচে লেখা ছিল ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। তারপর সংগ্রাম, অস্ত্র, যুদ্ধÑদেশ স্বাধীন। পৃথিবীর বুকে নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

আসে ১৯৭২। ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন মুক্ত স্বদেশের ঢাকায়। আগের দিন ৯ জানুয়ারি। প্রায় পূর্বসিদ্ধান্ত ছাড়া ঢাকার পথে চার জন। আমিই সর্বকনিষ্ঠ। জ্যেষ্ঠরা হলেন অগ্রজ ওবায়দুর রহমান, অগ্রজতুল্য আবদুল কাইউম (এডভাকেট) এবং অগ্রজ-বন্ধু শহীদ সেরিয়াবাত। চারজনই বাম রাজনীতির পথিক। শহীদ ভাই একটু অতি বাম।  

প্রথমে আলুবাজার ঢাকা হোটেল তারপর আবার ঘোরদৌঁড় মাঠ। মাঠের মাঝ বরাবর মাটিতে বসে কবির আগমন অপেক্ষায়। কবি ্এলেন। চেহারা দেখেই অশ্রুসিক্ত হলেন অসংখ্য দর্শক-¯্রােতা। চার দিকে কেবল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উত্তাল তরঙ্গ ভেদ করে মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধু। আবার উচ্চারিত হবে অমোঘ বাণী। মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন কবি। কথা শুরুর আগে কিছুটা সময় নিথর নিস্তব্ধ। যেন সামলে নিচ্ছেন সবকিছু। হয়তো হৃদয়ের ক্ষুদ্র পরিসরের বিপুল আবেগ-উৎসরণ। তারপর? তারপর, শুরু হলো বক্তৃতা। ঋজু ভঙ্গিমায় অবেগঘন উচ্চারণ, ‘ভায়েরা আমার..। তারপর, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পেছনে আছে অযুত রক্তক্ষরণ। ক্রমে ক্রমে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেশীবিদেশী কারও নাম অনুচ্চারিত থাকেনি কৃতজ্ঞতার উৎসারণ থেকে। অবেদন কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকারের। দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। সেই সঙ্গে দৃপ্ত ঘোষণা, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বাংলাদেশ টিকে থাকবে এবং বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, এখানে থাকবে না কোনো অন্যায়, অত্যার দুর্নীতি’। বিশাল জন¯্রােতের সঙ্গে সভাস্থল ত্যাগ। হৃদয়ের গভীরতায় কেবল ‘শেখ মুজিব’ আর স্বাধীন বাংলাদেশ।
এর পরে বঙ্গবন্ধুকে দেখা ১৯৭৩-এর ১৬ মার্চ আর ২৩ মে। বলা যায় অনেকটা কাছ থেকে দেখা। ১৬ মার্চ দেখা বঙ্গভবনে। সেদিন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন আবদুর রব সেরনিয়াতের। ‘সেরনিয়াত চাচা’ নামেই ডাকি তাঁকে। আমার অন্যতম রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আমাদের তিনজনকে কার্ড পাঠিয়েছেন, বরিশালে। এই আমরা হলাম, এডভোকেট আবদুল কাইউম, এডভোকেট এম. আবদুস সামাদ আর বদিউর রহমান, শহীদ সেরনিয়াবাদ কার্ড পেয়েছেন পারিবারিক সূত্রে। চারজনের পথ চলা। যথারীতি ঢাকা গমন, আবার আলুবাজার ঢাকা হোটেল। নির্ধারিত সময় বঙ্গভবনে হাজিরা। অনেক মানুষের ভীড়ে আমরা চারজনই যেন আত্মার আত্মীয় কাছের মানুষ। শপথ শেষে আপ্যায়নের পালা। ব্যবস্থাটা ‘বুফে’Ñ ইচ্ছে মত নাও, আর খাও। এরই মধ্যে চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা বঙ্গবন্ধুর। ছোটো একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে হাঁটছেন আর কুশল বিনিময় করছেন। সবাই যেন পরম পরিচিত আত্মার আত্মীয়। নানা জনকে নাম ধরে ডাকা, হালকা চালে কথা বলা। সে এক বিরল দৃশ্য। বেশ রসালো কথা বললেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ আর ভাবী আমেনা আহমেদের সঙ্গে। দু’জনই সমানে-সমান। ন্যাপের সূত্রে আমরা আগে থেকেই অধ্যাপক সাহেবের একটু কাছ-ঘেষা অবস্থানে ছিলাম। তাই আমরা সেই রস-নির্যাস থেকে বঞ্চিত হইনি। দেখলাম আর এক বঙ্গবন্ধুকে। ‘মাটির মানুষে’র যথার্থ প্রতীক। সোজা, সরল নিরাভরণ, স্বচ্ছ সাধারণ একজন মানুষ, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 
এবছরই ২৩ মার্চ বিশ্ব শান্তি পরিষদের এশিয়া মহাদেশীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। অন্যতম উদ্দেশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী পদকে’ ভূষিত করা। বিশ্ব শান্তিপরিষদ ১৯৭২-এর ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরী পদক প্রদানের ঘোষণা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই অয়োজন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সদস্য হিসেবে। উপস্থিত ছিলেন আমার অগ্রজ ওবায়দুর রহমানও। অনুষ্ঠানে অভিভূত হয়ে শুনছিলাম বিশ্ব শান্তিপরিষদের সেসময়ের সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্রের বক্তৃতা। সে এক সম্মোহনী ভাষণ। ইংরেজিতে বললেন তিনি, কিন্তু এমন সহজ সরল আর প্রাণবন্ত বক্তৃতা খুব কমই শুনেছি। ভাষণ শেষে পদক প্রদান। তিনিই পদক পরিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুকে; সাথে সাথে মুহুর্মুহ করধ্বনি আর ‘জয় বাংলা’ শ্লোলগান। এরপর পদকপ্রাপ্তির অভিব্যক্তি প্রকাশের পালা। নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আবারও করতালি আর শ্লোগান। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়াতেই পিনপতন নিস্তব্ধতা। স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা। মুক্তিযুদ্ধের শহিদ এবং  মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিশ্বনেতৃবৃন্দকে অভিনন্দন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। বললেন, ‘প্রয়োজনে আলেন্দে হবো, তবু সা¤্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না’। আরও কত কথা। কিন্তু ওই কথা ক’টি, ‘আলেন্দে হবো’ আজও কানে বাজে, মর্মে বড়ো লাগে। 

বঙ্গবন্ধু আলেন্দে হয়েছেন, কারও কাছে মাথা নত করেননি। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে তোয়াক্কা না করে মানবমুক্তির পথে হেঁটেছেন জীবন দিয়ে। গণতন্ত্র, সামাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদÑ মানবমুক্তি তথা সমাজমুক্তির এই চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে গ্রহণ এবং ধারণ করেছেন জীবনভর। এ আমাদের বড়ো অহংকার। শত শোকেও আমাদের অহংকারী করে তোলে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ উচ্চারণ, কায়েমী স্বার্থবাদীর কাছে আপসহীনতা। সেই উচ্চারণ আজও মুক্তির পথে দৃঢ়তার মন্ত্র শোনায়। উদ্বুদ্ধ করে ভবিষ্যৎ বাঙালি প্রজন্মকে। স্মরণ করায় সা¤্রাজ্যবাদী থাবার হিং¯্র নখরকে।

আরও পরের ঘটনা। একটি নয়, দু’টি। ১৯৭৫-এর শুরুর দিকের এবং মাঝামাঝি সময়ের। দু’বারই গণভবনে এবং কাছে থেকেও চোখের আড়ালে। দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই। দুটি ঘটনাই বঙ্গবন্ধুর উদার হৃদয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আজও অন্তরে বাজে। 
নলিনী দাশ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বরিশালের নলিনী দাশ। একদিন বললেন, ‘দেখো, বরিশালের যা অবস্থা..., বিষয়টা বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি জানাতে চাই’। সেভাবেই সিদ্ধান্ত এবং কাজ। যথারীতি আমরা দুজনে (নলিনী দাশ আর আমি) বরিশাল থেকে ঢাকা। তারপর গণভবনে গমন এবং সাক্ষাৎ প্রত্যাশী। সাক্ষাৎ করবেন নলিনী দাশ একা। তোফায়েল আহমদ তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব আর বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুর রহমান মোস্তফা সহকারী ব্যক্তিগত সচিব। এরা দু’জনই আমার পূর্ব পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের সমসাময়িক আবাসীছাত্র হিসেবে তোফায়েল আহমদ আর বরিশালের বাসিন্দা হিসেবে ওবায়দুর রহমান মোস্তফা। এঁদের সহযোগিতায় সহজেই সাক্ষাত পেলেন নলিনী দাশ। কেবল দেখলাম কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে নলিনী দাশকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসালেন। দুজনে কথা হলো, অনেক কথা। কী কথা, তাতো শোনার উপায় নেই। এক সময় পরম তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে নলিনী দাশ এসে বললেন, ‘কাজ হয়েছে। আমার সামনেই ফোন করে বলে দিয়েছেন। চলো এবার’। চলে এলাম। 

দ্বিতীয় দফা মাসিমা’র সঙ্গে। বরিশালের মনোরমা বসু মাসিমা। তাঁর ইচ্ছা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করবেন, কিছু কথা বলবেন। যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ। এবার সঙ্গের সাথী আরও একজন। তিনি আমাদের সুহৃদ ও বন্ধু শাহজাহান খান। (শাহজাহান খান বর্তমানে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ২০১৯-এর ১৬ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সম্মেলনে নির্বাচিত))। আগের পথেই হাঁটা। ব্যতিক্রম কেবল বঙ্গবন্ধুর আচরণে। সাক্ষাতকারের কলিং বেল, বঙ্গবন্ধু দরজার কাছে এসে মাসিমাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের টেবিলের উপরেই বসালেন। এটুকুই আমরা দেখলাম। এর পরেরটা মাসি’মার কাছে শোনা। 
বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন, তুমি কী চাও মাসি? কেন এসেছ। 
মাসি বললেন, আমি কিছু চাই না। তুমি আমার দুটা কাজ করে দেবে।
Ñ বলো মাসি কী কাজ?
Ñ বরিশালে আমার মাতৃমন্দির স্কুলটা তুমি নিয়ে নাও, আর বাকাই জমিদার বাড়ি আমার শশুর বাড়িটায় একটা হাসপাতাল বানিয়ে দাও।
একথা শুনে, মাসির কাছ থেকে শোনা, বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ‘দেখ্, দেখ্, সবাই আসে শেখ মুজিবের কাছ থেকে নিতে আর আমার মাসি এসেছেন আমাকে দিতে’।
ফল যা হওয়ার হয়েছে। মাসিমা’র ‘মাতৃমন্দির’ এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মনোরমা বসু কল্যাণ ট্রষ্টের পক্ষে এই বিদ্যালয়ের জমি সরকারকে দেওয়ার দলিলে স্বাক্ষর প্রদান আজও আমাদের তৃপ্তি দেয়। বাকাই জমিদার বাড়ির হাসপাতালের কী হয়েছে তা আর জানা নেই। 

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার আরও সুযোগ হয়েছে। যখনই বরিশালে এসেছেন, তখনই দেখা মিলেছেÑ সাংবাদিকতার সূত্রে। মাঠে, জনসভায় কিংবা বরিশাল সার্কিট হাউসে বা খাবার টেবিলে। যতদূর মনে পড়ে অন্তত দু’বার এমন ঘটেছে। স্বাধীনতার পর বরিশালে জনসভা। জনসভা হলো ‘বরিশাল বেল’স পার্কে’। ওই জনসভার তারিখ থেকেই ‘বেল’স পার্ক’ হলো ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’। সেবারই বঙ্গবন্ধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বরিশাল শহীদ মিনারের। সেদিনটি ছিল বাংলা ১৩৭৯ সনের ১৯ পৌষ, ১৯৭৩-এর ৩ জানুয়ারি। আর একবার সম্ভবত পটুয়াখালী যাবার পথে যাত্রাবিরতি। 
দেখেছি, খাবার টেবিলে নিজের পাতের চাইতে অন্যের পাতের দিকে বেশি নজর। সবাইকে ঠিক মতো পরিবেশন করা হচ্ছে কি না, সে-সব খোঁজখবর নিতে। 

বঙ্গবন্ধু কেবল একজন রাজনীতিক, জাতীয়নেতা বা রাষ্ট্রনায়কই নন, তিনি একজন শিক্ষক। তিনি শিখিয়েছেন, ‘ব্যক্তির উর্ধে দল আর দলের উর্ধে দেশ’। বর্তমান বাংলাদেশের সবচাইতে স্পর্শকাতর দুর্বলতা দুর্নীতি। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথই এই অন্ধগহ্বর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। স্বাধীন বাংলাদেশে (১৯৭২-১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম এবং বক্তৃতা-ভাষণের মধ্যেই নিহিত আছে শোষণমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। সে পথে এগিয়ে চললে দুর্নীতিসহ সকল কলঙ্কমুক্তি ঘটতে পারে সহজেই। হাজারো হতাশার মধ্যে এমন আশার বাণী উচ্চারিত হোক বাঙালির বর্জ্রকঠিন কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এই আমাদের প্রত্যাশা। জয়তু বঙ্গবন্ধু।